২২ ডিসেম্বর, ২০২০ ১০:০৪

জীবনের ঘানি টানাটা আর কতটা কাল

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

জীবনের ঘানি টানাটা আর কতটা কাল

জীবনের ঘানি টানা মানুষকে অনেকদিন ধরে দেখছি। যাদের জীবন মৃত্যুর সাথে প্রতিদিন লড়ছে। সে জীবনে আকাশকে ছোয়ার সাধ আছে, সাধ্য নেই। সেখানে টানাপোড়েনের বাঘবন্দী খেলা আছে, পালাবার পথ নেই। ঘানি টানা কথাটা মনে করতেই চোখে ভেসে উঠলো ইতিহাস। একটা ফেলে আসা ধূসর সময়। সে সময়টাতে তেলবীজ থেকে তেল উৎপাদনের কোনো প্রযুক্তিগত যন্ত্র বা মেশিন তৈরী হয়নি। ঘানিকে কেন্দ্র করে একদল জীর্ণ শীর্ণ হত দরিদ্র মানুষ তেল উৎপাদন শুরু করে। তেল উৎপাদনের জন্য কাঠের গুঁড়ির ভিতরে তেলবীজ রেখে কাঠের দন্ডটিকে চারপাশে চক্রাকারে ঘোরানো হতো। কাঠের ভারী দন্ডটিকে ঘোরানোর জন্য শক্ত সামর্থ বলদ ব্যবহার করার কথা থাকলেও তা হতোনা। মানুষকে বলদ হতে হতো। চামড়াটা ঝুলে থাকা শরীরটা নুয়ে পড়া এক একটা মানুষ বলদের বদলে কাঠের দন্ডটা চারপাশে বৃত্তাকারে ঘোরাতো। এটাকে মানুষ বলতো ঘানি টানা। 

কখনো কখনো আবার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা মিলে বুক দিয়ে ঠেলতো এই দুঃসহ ঘানির ভার। শরীরটা কষ্টে আর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তো বিন্দু বিন্দু নদীর মতো। নোনা ঘামে রক্তাত্ত হতো মাটি। এ যেন জীবনকে টেনে চলা জীবনের  ঘানি টানা। জীবনকে বাঁচাতে জীবনের কঠিন বোঝার সাথে আমৃত্যু লড়ে চলা। বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষগুলোর কষ্টকে চারপাশের মানুষ কখনো উদার চোখে দেখার চেষ্টা করেনি। বরং অবজ্ঞা, অপমান আর অসম্মান যেন ছিল তাদের আজন্ম প্রাপ্তি। বা কি চমৎকার চারপাশের বিষধর স্বার্থপর মানুষ। যাদের মায়া ছিলো না, মমতা ছিলো না, ভালোবাসা আর আবেগ ছিলো না। 

একটা বিবর্ণ কাচের চশমা চোখে ঝুলিয়ে মানুষ এই ঘানি টানা মানুষদের পশু ভেবেছে। যদিও সে পশুত্বের দাসত্বে বন্দি ছিল চারপাশের বিবেক শূন্য মানুষগুলোর আত্মায়, দেহে, সর্বাঙ্গে। খুব ব্যঙ্গ করে কলুর বলদের মতো ঘানি টানা মানুষদের তারা নাম দিয়েছিলো তেলি বা তৈলিক। আবার সময়ের বিবর্তনে এ প্রাণহীন বোবা সমাজ তাদের নাম দিয়েছে কলু। হায়রে জীবনের ঘানি টানা। হায়রে জীবন। যার মূল্যটা ঝুলিয়ে রাখা মুলোর মতোই মূল্যহীন ছিল। হয়তো তেল তৈরীর সেই প্রাচীন সময়টা আর নেই। কিন্তু জীবনের ঘানি টানা তো এখনো থেমে যায়নি। বরং সেটা অদৃশ্য হাতের অদৃশ্য খেলার মতো বেড়েই চলেছে। 

সারাজীবন যে মা সংসারের ঘানি টেনেছে মমতাময়ী মায়ের রূপের জৌলুস হারিয়ে গেছে। পড়ন্ত বেলায় এসে সন্তানরা তাকে বোঝা মনে করেছে। যে বাবা তিলে তিলে রক্ত ক্ষয় করে সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে, তাকে সমাজের নামিদামি একজন মানুষে পরিণত করেছে সময় তাকেও একটা মূল্যহীন বোঝা বানিয়েছে। হয়তো সেই ঘানিটানা মায়াবী মুখগুলো খরতাপে পুড়েছে জীবনের দুঃসহ যন্ত্রনায়। শেষ আশ্রয় হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। বাবা-মায়ের জীবনের ঘানিটানা কঠিন সত্যটা চাপা পড়েছে অমানবিক সভ্যতার চাকচিক্যে ও ভোগ বিলাসিতায়। একজন অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে মা-বাবা নিয়ে যে মানবিক আচরণের আকুতি দেখা যায় তা নামের পিছনে বড় বড় ডিগ্রি লাগানো শিক্ষিত মানুষের মধ্যে দেখা মেলেনা। জীবনের ঘানি টানা কঠিন সত্যকে একটা অশিক্ষিত ও দারিদ্র পীড়িত সন্তান যেভাবে বুঝে একজন শিক্ষিত সন্তান তা বোঝার ক্ষমতা অর্জন করেনা। এটা কোনো কল্পনা নয়, এটাই পোড়া রুটির মতো আগুনে পুড়তে পুড়তে কঠিন বাস্তবতা। 

একটা তরুণ। যার মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকতো। একদিন যে সবাইকে জীবন জয়ের স্বপ্ন দেখাতো, সে যেন কেমন মুষড়ে পড়েছে। একটার পর একটা চাকরির ভাইভা দিচ্ছে। কিন্তু চাকরি তো মিলছে না। বেকার জীবনের ঘানিটানা তরুণটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে তার পুরো পরিবার। তরুণটা ভেবেছিলো চাকরি পেয়েই মায়ের জন্য একটা লাল রঙের শাড়ি কিনে দিবে। সবার চোখ এড়ালেও বেকার ছেলেটা মায়ের পড়া শাড়িটা আনমনে দেখেছিলো। যে শাড়িটার পরতে পরতে ছিল লজ্জা লুকানোর চেষ্টা, কষ্টের কাব্য।  ছেলেটার বাবার খুব শখ ছিল একটা মখমলের দামি পাঞ্জাবি কিনবে। জীবনের ঘানি টানতে টানতে সেটা আর কখনো কেনা হয়ে উঠেনি। ছেলেটা ভেবেছিলো চাকরি পেয়েই বাবার শখটা পূরণ করবে। সেটা আর হয়ে উঠছে না। বেকার জীবনের ঘানি টানাটা যে এখনো চলছে। সেটা কবে শেষ হবে কেউ তা জানে না। দুঃসহ সময়ে মানুষ তো মানুষের খবরই রাখে না। 

একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ। সে একটা গাড়ি কেনা স্বপ্ন দেখেছিলো। সেটা সারাজীবন অপূর্ণই থেকে গেছে। সারাটা জীবন গাড়ির হ্যান্ডেলটা ধরে ঝুলতে ঝুলতে জীবনের ঘানিটা সে টেনেই চলছে। হয়তো সেটা গরিবের ঘোড়া রোগ ছিল। পাওয়া না পাওয়ার তার আক্ষেপটা একদিন মাথা থেকে নেমে মাটিতে হেঁটেছে, জীবনের খরায় দগ্ধ হয়েছে। তবু মুখ ফুটে কাউকে কখনো সে স্বপ্নের কথাটা জানাতে পারেনি। একটা রাস্তায় পরে থাকা নামহীন টোকাই, কি আছে তার। জন্মের ঠিক নেই। নিজের ঠিক নেই। বেঁচে থাকার মৌলিক উপাদান কি তা সে কখনো জানতেও পারেনি। তবুও জীবন বাঁচাতে সে জীবনের ঘানি টেনে চলেছে। তার নেই কোনো ভবিষৎ, নেই কোনো গন্তব্য। তাকে নিয়ে বড় বড় সাহিত্য রচিত হয়েছে, গবেষণা হয়তো হয়েছে, নতুন নতুন থিওরি বের হয়েছে কিন্তু  রাস্তার টোকাই সে রাস্তায় পড়ে আছে এখনো। তার খবর হয়তো সবাই জানে কিন্তু তার পরেরটা কেউ জানে না।

হয়তো জীবনের ঘানি টানাটা খুব কঠিন। এর নেতিবাচক দিকটা হয়তো আমরা দেখি। কিন্তু ইতিবাচক দিকটা কখনো দেখিনা। যে মানুষ জীবনের ঘানি টানতে পারে সে জীবনের অদৃশ্য স্বপ্নগুলোকে দেখতে পায়। কঠিন সত্যকে উপলব্ধি করার শক্তি অর্জন করতে পারে। জীবনের  ঘানিটানা মানুষগুলোই পৃথিবী বদলানোর সাহস দেখাতে পারে। যেটা আর অন্য কেউ পারে না। জীবনের ঘানিটানাটা মানুষকে ভালো মন্দ চিনতে শেখায়। মানুষকে চেনায়। দুঃখের মধ্যে যে সুখের সূর্য জেগে উঠার চেষ্টা করে সেটা ঘানিটানা মানুষটাই বেশি জানে। জীবনের ঘানি টানাটা আত্মশক্তি হোক। ঘানি টানতে টানতে মানুষ পৌঁছে যাক নির্মম সত্যের কাছে। যেখানে স্বপ্নের সাথে স্বপ্নের লড়াইটা চলতে চলতে অনেকটা পথ পাড়ি দেয়, কখনো থেমে যায় না। জীবনের ঘানি টানা মুখটাতে কখনো পচন ধরেনা যেমন পচন ধরে ভোগবাদী মানুষের মুখটায়। তারপরও নাটকের পর নাটক শেষে বাস্তবতার নগ্ন দেহটা পড়ে থাকুক ঘানিটানা পিচের রাস্তায় মানুষদের জীবনের মিছিলে।

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর