২৭ ডিসেম্বর, ২০২০ ১২:৩৬

যেখানটায় মানুষ খুব অসহায়

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

যেখানটায় মানুষ খুব অসহায়

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী। ফাইল ছবি

একটা অদ্ভুত বিষয় পৃথিবীতে কাজ করে। সেটা হয়তো সবার কাছে সাধারণ মনে হতে পারে। তবে এর পেছনের লজিকটা বোঝা খুব কঠিন। যেমন একটা মানুষ চুরি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়লো। তাকে উত্তম-মধ্যমও দেওয়া হলো। কিন্তু লোকটা কিছুতেই স্বীকার করছে না সে চোর। সে চুরি করেছে। একটা মানুষ পাগল হয়ে গেছে। সবাই বলছে লোকটা পাগল কিন্তু সে কিছুতেই এটা স্বীকার করছে না। তাহলে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি চোর যে, চোর তা সে স্বীকার করে না। পাগল যে পাগল তা সে স্বীকার করে না। তবে এ দুটোর মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। সেটি হলো পাগল মানসিক ভারসাম্য হারালেও চোর তা হারায় না। তাহলে না স্বীকার করার লজিকটা কী হতে পারে। লজিকটা হলো, চুরি করতে করতে চোরটার কাছে মনে হয়েছে চুরি করাটা তার অধিকার।এটা কোনো অপরাধ না। খুব সহজভাবে বললে এভাবে বলা যায়, মানুষ যখন একটা মন্দ কাজে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকে তখন সে মন্দটিকে আর মন্দ বলে মেনে নেয় না। বরং মন্দ কাজটা যে সঠিক হয়েছে, সেটা বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে। 

পাগলের ক্ষেত্রে বিষয়টি ঠিক তার উলটো। কারণ, আমরা যাদের পাগল বলছি, তারাই হয়তো পাগল নয়। আর আমরা যারা নিজেদের পাগল ভাবছি না, তারাই হয়তো পাগল। পার্থক্য কেবল মানসিক ভারসাম্যহীনতায়। চিন্তা ও বাস্তবতায়। তবে এটা খুব দৃঢ়ভাবে বলা যায়, চোর যতই নিজেকে সাধু বলুক, অপরাধের  দায়টা তাকে নিতেই হবে। তবে পাগল নিজেকে পাগল বললে, তাতে অপরাধের কিছু নেই। তবে সমস্তটাই জটিল একটা মনস্তাত্বিক খেলা। যার কোনো ব্যাখ্যা নেই। কিংবা আছে। আবার যেটা আছে, সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ। যেমন একটা কথা প্রচলিত আছে সব চোর চোর নয়। সব পাগল পাগল নয়। কথাটা সাদাসিধা তবে ব্যাখ্যাটা খুব ক্রিটিকাল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটা মানুষ নিজেকে পাগল বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। সে বিশ্বাসটা মানুষের মধ্যে তৈরি করার একটা ক্ষেত্র তৈরি করছে। মানুষ যখন নিজেকে পাগল বলে স্বীকার করে নেবার প্রবণতা দেখায় তখন ধরে নিতে হবে সে পাগল নয়। বরং নিজেকে পাগল বানিয়ে সে কোনো একটা অপরাধকে ঢাকার চেষ্টা করছে। অথবা এখানে তার কোনো স্বার্থ কাজ করছে। অন্যদিকে মানুষ যখন নিজেকে চোর বলে স্বীকার করে নেয় তখন ধরে নিতে হবে, সে চুরির চেয়ে বড় কোনো অপরাধ করেছে। যেমন ঘুষ খেয়ে ধরা পড়া। এটা একটা বড় দুর্নীতি। সেটাকে ছোট করে দেখানোর জন্য লোকটা নিজেকে চোর বানাতে চাইলেও দুর্নীতিবাজ বানাতে চাইবে না। মনস্তত্ব সেটাই বলছে। মানুষ বড় কোনো অপরাধ করে ধরা পড়লে, সেটাকে ছোট করে দেখতে চায়। সেটা ছোটর থেকে ছোট বানাতে চায়। কতটা ছোট সেটা বলাটা কঠিন। কারণ, সেখানেও আপেক্ষিক একটা সূত্রের রেশ টেনে ধরার চেষ্টা চলে।

সাহেদকে মানুষ বাটপার বলে। পাপিয়াকে মানুষ রংবাজ-ধোকাবাজ বলে। জিকে শামীমকে মানুষ অপরাধ জগতের রাজা বলে। বিভিন্ন দেশে যারা অর্থ পাচার করে সে দেশে এখন আস্তানা গেড়েছে, তাদের মানুষ সুবিধাবাদী বলে। তবে কে বড় বাটপার তা বিচার করে দেখে না। এগুলো কয়েকটা দৃষ্টান্ত মাত্র। এমন অনেক কিছু ঘটে, যা ঘটবার মতো ছিল না। তারপরও ঘটে যায় সামনে। পেছনে। ভেতরে। বাইরে।

তবে সত্যের পেছনে সত্য থাকে। খেলার পেছনে খেলা থাকে। মানুষের পেছনে মানুষ থাকে। সাহেদ, পাপিয়া, শামীম যদি বাটপার হয় তবে বাটপারের উপর বাটপার থাকে। যারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকতে চায়। কিংবা থেকে যায়। একটা অদৃশ্য বলয় তাদের কখনো চিনতে দেয় না। কারণ, যারা অপরাধী তৈরি করে, তাদের মুখটা সবসময় আড়ালেই থেকে যায়। সেটা তাদের চেহেরার উপর মুখোশটা টেনে বের করা খুব কঠিন। তবে দুঃসাধ্য নয়। আমরা কেবল সামনের অপরাধীদের ধরেই হাত পা ছেড়ে দিয়। কারণ, ভেতরে ঢুকতে গেলে আর বের হওয়া যায় না। এই অপরাধীদের শেকড় খুঁজতে খুঁজতে মানুষ এমন একটা জায়গায় পৌঁছে, সেখান থেকে সে আর ফিরে আসতে পারে না। কী বলব। কী বলব না। সবকিছু সমাপ্ত করতে নেই, কিছু অসমাপ্ত পাপ রেখে দিতে হয়। সে পাপীদের বিচার যাতে সময় ও প্রকৃতি করতে পারে। হয়তো সেটা আমরা বুঝতে পারি না কিন্তু সেটা ঘটে যায় সবার অলক্ষ্যে। কারণ, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। যেখানটায় মানুষ খুব অসহায় ঠিক সেখানটায় মানুষ আবার নিজেকে জয় করে সত্যকে বিন্দু বিন্দু জলকণার মতো বের করে আনতে পারে। পৃথিবীর থমকে যাওয়া মানুষের ইতিহাসটা হয়তো এভাবেই লেখা হয়। যেখানে অপরাধ বিদায় নিয়ে মানুষ ‘মানুষ’ হয়ে উঠে। হয়তো কোনো একদিন। 

বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর