৩ জানুয়ারি, ২০২১ ১৩:২২

বাংলাদেশে সাওলের হৃদরোগ চিকিৎসার ১২ বছর

মোহন রায়হান

বাংলাদেশে সাওলের হৃদরোগ চিকিৎসার ১২ বছর

হৃদয় ছাড়া আর কী আছে একজন কবির? ২০০৮ সালের মার্চে কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালের নিঃসঙ্গ করিডরে হার্ট অপারেশনের পরামর্শ পেয়ে বিমর্ষ হয়ে ভাবছিলাম- আমার হৃদয়ই আজ আমার ঘাতক! চেকআপ করাতে গিয়ে ঘাতক হৃদয়ের সন্ধান আমাকে দিশাহারা করে দেয়। কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না, ডাক্তারের ছুরির নিচে এ হৃদয়কে সঁপে দিতে।

মন খারাপ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাসপাতালের গেটের পাশে হঠাৎ একটি ছোট্ট বুক কর্নার চোখে পড়ল। নানা বই-পুস্তকের ভিড়ে একটি বই নজর কাড়ল- ‘হৃদয়রোগ থেকে মুক্তি ৫টি সহজ পদক্ষেপ’। লেখক ডা. বিমল ছাজেড়। অবরুদ্ধ হৃদয়-মুক্তির সোনালি হাতাছানির সেই বইটি পরবর্তী সময়ে বদলে দেয় আমার চিকিৎসা দৃষ্টিভঙ্গি, আমার জীবন।

ছুটে যাই ডা. বিমল ছাজেড়ের হার্ট সেন্টারে। সেই ছুটে চলা আজও ফুরায়নি। সেই ছুটে চলার পরিণতি, এ বছর ৯ জানুয়ারি সাওল হার্ট সেন্টার, বাংলাদেশ-এর ১২ বছর পূর্তি।

বিশ্বে হার্ট ব্লকেজের চিকিৎসার ৬০ বছরের প্রচলিত বাইপাস সার্জারি পদ্ধতির পরিবর্তে ‘বিনা অপারেশনে হৃদরোগ মুক্তি’ কথাটা যেমন চমকে ওঠার মতন, তেমনি অবিশ্বাস্যও শোনায়! বিষয়টা সত্য এবং বাস্তব প্রমাণ ও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা সহজসাধ্য নয়। কিস্তু গত ১২ বছরে আমরা সেটাই প্রমাণ এবং বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছি। 

হৃদরোগ চিকিৎসার হাসপাতালগুলো যখন বলেছে, ‘অপারেশন না করলে রোগী যেকোনো সময় মারা যাবে’। আমিসহ এ রকম ৪০ হাজারের বেশি হৃদরোগীকে বিনা রিং, বিনা অপারেশনে সুস্থ রেখেছে সাওল হার্ট সেন্টার, বাংলাদেশ। লক্ষাধিক মানুষকে হৃদরোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। হার্ট, ডায়াবেটিস, ব্লাডপ্রেশার, মানসিক চাপমুক্ত থেকে সুস্থ ও সাবলীল জীবনযাপনের জন্য লাইফস্টাইল পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমেরিকার নতুন ধারার চিকিৎসা পদ্ধতির জনক ডা. ডিন অরনিশ উদ্ভাবিত ‘রিভার্সাল হার্ট ডিজিজ’ চিকিৎসা পদ্ধতির অনুসারী উপমহাদেশের কিংবদন্তি হৃদরোগ ও লাইফস্টাইল বিশেষজ্ঞ ডা. বিমল ছাজেড়কে বাংলাদেশে এনে ১৮টি জাতীয় হার্ট ক্যাম্প, বাংলাদেশের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা ৪২টি আঞ্চলিক সেমিনার, ২২১টি সাপ্তাহিক ফ্রি সেমিনার আয়োজন করা হয়েছে।

মানুষ এখন বিশ্বাস করছে, সাওল পদ্ধতিতে বিনা রিং, বিনা অপারেশনে হার্ট ব্লকেজের রোগীদের সুস্থ থাকা সম্ভব। সারা দেশ থেকে প্রতিদিন সাধারণ, অসাধারণ মানুষ আসছে সাওল হার্ট সেন্টারে চিকিৎসা নিতে। এমনকি অপারেশন করেছে বা একাধিক রিং পরেছে এমন রোগীরাও আসছে। কারণ রিং বা বাইপাস হার্ট ব্লকেজের স্থায়ী চিকিৎসা নয়। সাওল কাটাছেঁড়া ছাড়া EECP মেশিনের সাহায্যে মানব দেহের অসংখ্য সুপ্ত রক্তনালী খুলে দিয়ে সারা শরীরে রক্ত প্রবাহের ব্যবস্থা বা ন্যাচারাল বাইপাস করে দিচ্ছে। আর কার্ডিও ডিটক্স পদ্ধতিতে রক্তনালীর ব্লক কমিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি মানুষের অধিকাংশ রোগের কারণ যে লাইফস্টাইল, তাকে বদলে দিচ্ছে সাওল হার্ট সেন্টার। 

বিনাতেলে রান্না, তেল-চর্বিযুক্ত খাবার পরিহারসহ খাদ্যভ্যাস পরিবর্তন, হাঁটা-চলা, ব্যায়াম, যোগ্যাভ্যাস, ধ্যান প্রশিক্ষণসহ হৃদরোগের ১৫টি কারণ দূর করার শিক্ষা দিয়ে, একজন রোগীকে নিজেকেই নিজের ডাক্তার হিসেবে গড়ে তুলছে। ফলে সাওল পদ্ধতিতে করোনারি হার্ট ডিজিজের রোগী স্থায়ীভাবে সুস্থ হচ্ছে।

অপারেশন করা বা রিং পরানো রোগী নতুন করে আবার আক্রান্ত হয়। কারণ প্রচলিত চিকিৎসা অপূর্ণাঙ্গ এবং বাণিজ্যপ্রধান। সেখানে সাওল একটি সর্বাধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা এবং মানবসেবামূলক চিকিৎসা। 

সাওল অর্থ (SAAOL- Science And Art Of Living) বিজ্ঞান ও জীবনযাপন পদ্ধতির সুন্দর বোঝাপড়া।  মানুষকে হৃদরোগ মুক্ত রাখার স্বাস্থ্য আন্দোলন হিসেবেই বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সাওল হার্ট সেন্টার। সাওল- দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় হৃদরোগ চিকিৎসা সহজলভ্য করে তোলার সামাজিক আন্দোলনও। 

গত একযুগে এসবই আমাদের অর্জন। আর ব্যর্থতা হলো- বাংলাদেশে প্রতিবছর দুই লাখ মানুষ মারা যায় এই ব্যাধিতে। দেশে ৩০ ঊর্ধ্ব ৫০ শতাংশ মানুষ হৃদরোগের ঝুঁকির মধ্যে আছে। অথচ এক যুগে সামান্য কিছু মানুষকেই আমরা চিকিৎসাসেবা দিতে সমর্থ হয়েছি বা সচেতন করতে পেরেছি। এর কারণ, যদিও আমাদের কনসেপ্ট সেরা, উদ্দেশ্য মহান, লক্ষ্য সুদূর কিন্তু সামর্থ্য অতি সীমিত। এ যেন ঝিনুক দিয়ে সমুদ্র সেঁচার মতন। যে কাজ রাষ্ট্রের, সে কাজ করছে এক চুনোপুঁটিতুল্য হার্ট সেন্টার!

কিন্তু মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। কোনো কোনো সময় মানুষ স্বপ্নের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে। সাওলের যুগপূর্তিতে আমাদের স্বপ্ন ও অঙ্গীকার- সাওলের একটি নিজস্ব ভবন, পূর্ণাঙ্গ একটি নন ইনভেসিভ লাইফস্টাইল হাসপাতাল, দেশের সমস্ত মানুষকে স্বাস্থ্য সচেতন করে সুস্থ, সুন্দর, সজীব, সক্রিয়, দীর্ঘজীবী রাখার সফল স্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলা।

লেখক: কবি এবং চেয়ারম্যান সাওল হার্ট সেন্টার (বিডি) লি.

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর