৪ জানুয়ারি, ২০২১ ০৮:৩৫

ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা কে কোথায়?

সোহেল সানি

ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা কে কোথায়?

সোহেল সানি

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক মুসলিম হলের মিলনায়তন কক্ষে নাজমুল করিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় ‘পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামে একটি ছাত্র সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আওয়ামী লীগের মাতৃ সংগঠন কেবল নয়, ছাত্রলীগকে বলা হয় স্বাধীনতার পতাকাবাহী সংগঠন। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই যার বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের শুরু।

চুয়ান্নোর নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির বাঙালি মুক্তির সনদ ছয় দফা, উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ,স্বাধীনতা ত্তোর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, নব্বই এর গণঅভ্যুত্থানসহ সকল আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের রয়েছে অবিস্মরণীয় ভূমিকা।

ছাত্রলীগের নেতৃত্বেই গঠিত হয় মুজিব বাহিনী। স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ইশতেহার, জাতীয় সঙ্গীত ইত্যাদি ছাত্রলীগের কীর্ত।  বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জাতির পিতা’ উপাধী ছাত্রলীগের উপহার।

রাজশাহীর নঈমউদ্দীন আহমেদকে আহ্বায়ক করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট ‘আহবায়ক কমিটি’ গঠনের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আত্মপ্রকাশ। সদস্য: বরিশালের আব্দুর রহমান চৌধরী, ফরিদপুরের শেখ মুজিবুর রহমান, কুমিল্লার অলি আহাদ, নোয়াখালীর আজিজ আহমেদ, পাবনার আব্দুল মতিন, দিনাজপুরের দবিরুল ইসলাম, রংপুরের মফিজুর রহমান, খুলনার শেখ আব্দুল আজিজ, ঢাকার নওয়াব আলী, ঢাকা সিটির নুরুল কবির, কুষ্টিয়ার আব্দুল আজিজ, ময়মনসিংহের সৈয়দ নুরুল আলম, চট্টগ্রামের আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী। এরা কেউ বেঁচে নেই।  এর মধ্যে শেখ আব্দুল আজিজ দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থেকে মৃত্যুবরণ করেন। 

আওয়ামী লীগেরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শেখ আজিজ বঙ্গবন্ধু সরকারের অন্যতম মন্ত্রী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কারাবরণ করেন মোশতাকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে। ‘৯২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন শেখ আব্দুল আজিজ। খুলনা জেলা আওয়ামী লীগেরও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি। 

অলি আহাদ পরলোকে। ‘৫৩ সালে আব্দুর রহমান বহিস্কৃত হলে প্রচার সম্পাদক হিসাবে উঠে শীর্ষে উঠে আসেন কুমিল্লার অলি আহাদ। ‘৫৫ সালে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার পর সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশী হয়ে ওঠেন। শেখ মুজিবের একই সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রিত্ব গঠনতন্ত্র পরিপন্থী বলে দলে উপদলীয় কোন্দলের সৃষ্টি করেন। শেখ মুজিব মন্ত্রীত্ব ছেড়ে সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকলে বিতর্কের অবসান ঘটে। পাকিস্তানে সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রীত্বে ও প্রদেশে আতাউর রহমান খানের মুখ্যমন্ত্রীতত্বে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতাসীন সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী বিরোধ’ চরমে পৌঁছে। বিশেষ করে বৈদেশিক নীতি নিয়ে। মাওলানা ভাসানীর সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ সম্পর্কিত একটা পত্র সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদ দলীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবের হাতে তুলে না দিয়ে তা সংবাদপত্রে প্রকাশ করে দেয়। ফলে অলি আহাদ বহিস্কার হন। এর প্রতিবাদে যে ৯ জন এম এল এ পদত্যাগ করেন, তার মধ্যে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ও প্রথম সভাপতি দবিরুল ইসলাম অন্যতম। দবিরুল ইসলাম যে কারণে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত হন। পাবনার আব্দুল মতিনও এম এল এ ছিলেন। পরলোকে চলে যাওয়া ভাষা সৈনিক মতিনও পরবর্তীতে ভাসানী ন্যাপে অন্তর্ভুক্ত হন। 

রংপুরের মফিজুর রহমান, নোয়াখালীর আজিজ আহমেদ, কুষ্টিয়ার আব্দুল আজিজ, ময়মনসিংহের সৈয়দ নুরুল আলম, চট্টগ্রামের আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী ‘৫৪ সালের মার্চের নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগের পক্ষে যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে এম এল এ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঢাকার নওয়াব আলী ও ঢাকা সিটির নুরুল কবির ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক কমিটির সদস্য পদ অলংকৃত করলেও জাতীয় রাজনীতিতে শীর্ষতম স্থানে উঠে আসতে পারেননি।  
 
ছাত্রলীগের প্রথম কার্যালয়

পুরান ঢাকার ১৫০ মোগলটুলী ‘মুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ই ছিল পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম কার্যালয়।   

যোগসূত্র

অবিভক্ত বাংলার সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী ও নিখিল বঙ্গ মুসলিম লীগের কর্ণধার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কলকাতা ফেরত অনুগত সমর্থক কর্মীরাই মূলত পূর্বপাকিস্তানে ছাত্রলীগের আত্মপ্রকাশ ঘটান। পূর্বপাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সমর্থনপুষ্ট ছাত্রসংগঠন হিসাবে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ এর বিপরীতে এটাই ছিল মূলত প্রথম কার্যকর সংগঠন। ছাত্রলীগকে আওয়ামী লীগের মাতৃসংগঠন বলা হয়ে থাকে।

প্রথম বহিস্কার

‘৪৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই ১৬ এপ্রিল শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আহ্বায়ক নঈমউদ্দীন আহমেদ ও আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও সলিমুল্লাহ হলের ভিপি আব্দুর রহমান চৌধুরী বহিস্কৃত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন দানের অপরাধে যে ২৭ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ছাত্রত্ব হারান, তাদের মধ্যে নঈমউদ্দীন অন্যতম ছিলেন। ধর্মঘটের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তিনি বন্ড দিয়ে ছাত্রত্ব বহাল করায় সংগঠনের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। ফলে তাকে বহিস্কার করে দিনাজপুরের দবিরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করা হয়।

বরিশালের আব্দুর রহমান চৌধুরীকেও একই অভিযোগে বহিস্কার করে কাজী গোলাম মাহবুবকে কোঅপট করা হয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হিসাবে। তাকে যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। সলিমুল্লাহ হলের ভিপি আব্দুর রহমান চৌধুরী রাজনীতিতে বিশিষ্ট ভুমিকায় কখন অবতীর্ণ না থাকলেও আইনজীবী হিসাবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। তার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা বিরোধী অবস্থান গ্রহণের অভিযোগ ওঠে। স্বাধীনত্তোর আব্দুর রহমান চৌধুরী বিচারপতি পদ অলংকৃত করেন। 

ছাত্রলীগের প্রথম নারী

ছাত্রলীগের প্রথম নারী ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদিকা লুলু বিলকিস বানু। ‘৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৭ বহিস্কৃত শিক্ষার্থীর মধ্যে বিলকিস বানু অন্যতম। শেখ মুজিবুর রহমান যেমনি মুচলেকা বা বন্ড দিয়ে ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে যাননি আর তার অনুসরণ করেই পথ চলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নেত্রী বিলকিস বানু।

ছাত্রলীগের নেতৃত্ব যারা

“নাঈমুদ্দীন”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল মিলনায়তনে নাঈমুদ্দীন আহমেদকে আহ্বায়ক করে ছাত্রলীগের ১৫ সদস্যের যে কমিটির যাত্রা তা শুরুতেই হোঁচট খায়। ভাষা সংগ্রামের উত্তাল তরঙ্গে যখন সংগঠনটির প্রায় সকলে গা ভাসিয়ে তখন নাঈমুদ্দীন আহমেদ বিতর্কিত হয়ে পড়েন। নেতৃত্বগ্রহণের দু'মাস ১২ দিনের ব্যবধানে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে বহিস্কৃত হন। ‘৫৪ সালের মার্চের আইন পরিষদ নির্বাচনে রাজশাহী থেকে আওয়ামী লীগার হিসাবে যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে জয়ী হলেও দলে শীর্ষ নেতৃত্বের সারিতে উঠে আসতে পারেননি। 

দবির-নেওয়াজ  

ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক দবিরুল ইসলাম ‘৫৩ সালে ছাত্রলীগের প্রথম সম্মেলনে সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন খালেক নেওয়াজ খান। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দু’জনকেই পরের বছর বিদায় নিতে হয়  ‘৫৪ এর নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ায়। পূর্বপাকিস্তানের ক্ষমতার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে শেরেবাংলা-সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর যুক্তফ্রন্ট কোন্দলের মুখে পড়ে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান শেরেবাংলার কৃষক শ্রমিক পার্টির  সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেন। আওয়ামী লীগের ১৯ জন আইন পরিষদ সদস্য কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যোগ দেয়। ছাত্রলীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান শেরেবাংলার পার্লামেন্টারি সচিবের পদ গ্রহণ করেন। পূর্বপাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে ঢাকার একটি আসনে হারিয়ে দিয়ে গোটা পাকিস্তানে চমক সৃষ্টি করলেও রাজনীতিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। ফিরতে পারেননি আওয়ামী লীগেও।

ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি রাজশাহীর দবিরুল ইসলাম। দবিরুল ইসলামের ‘হেবিয়াস কপার্স মামলা’ পরিচালনার জন্যই ঢাকায় আসেন। এতে বিখ্যাত হয়ে যান দবিরুল ইসলাম। ‘৫৪ এর নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ায় দবিরুল ইসলামকেও ছাত্রলীগ থেকে বিদায় নিতে হয়। ‘৫৫ সালে তাকেও নেতৃত্বের উপদলীয় কোন্দলের শিকার হয়ে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কার হতে হয়।

কামরুজ্জামান-ওয়াদুদ 

'৫৪ সালের দ্বিতীয় সম্মেলনে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। শিক্ষকতা পেশা জড়িয়ে নামের সঙ্গে অধ্যক্ষ যোগ করেন।  আওয়ামী লীগের থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। তবে নেতৃত্বের শীর্ষে উঠে আসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বগ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ে। '০২ সাল পর্যন্ত কামরুজ্জামান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হলেও এমপি নির্বাচিত না হওয়ায় মন্ত্রীত্বের দেখা পাননি। তিনি পরলোকে গমন করার আগেও লাঠি ভর দিয়ে আওয়ামী লীগের অফিসে ছুটে যেতেন। '৫৪ সালে কামরুজ্জামানের শুধু নয়, ৫৫ সালে পরবর্তী সভাপতি আব্দুল মমিন তালুকদারেরও জুটি রূপে এম এ ওয়াদুদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপালন করেন। দু'বার নির্বাচিত হওয়ার মূলে ছিল তার একাগ্রতা ও অপরিসীম   সাংগঠনিক দক্ষতা। যদিও এম এ ওয়াদুদ পরবর্তীতে কর্মাধ্যক হিসাবে ইত্তেফাককেই জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে বেছে নেন। ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠাতা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ন্যায়   পদপদবীতে না থাকলেও আওয়ামী লীগের ওপর প্রভাব বিস্তার করতেন ওয়াদুদের মেয়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। ছাত্রইউনিয়ন মতিয়াগ্রুপ করা দীপু মনি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। 

মমিন- ওয়াদুদ

৫৪-৫৫ এবং '৫৬-৫৭ দু' মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতির পদে দায়িত্বপালনকারী আব্দুল মমিন তালুকদার স্বাধীনতাত্তোর বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। আওয়ামী লীগের কোন বড় পদ কখনও অলংকৃত করতে পারেননি। কেন্দ্রীয় সদস্য পদে বেশ কিছুদিন ছিলেন।এখন পরলোকে। 

মমিন-আউয়াল 

আব্দুল মমিন তালুকদারের দ্বিতীয় মেয়াদে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এম এ আউয়াল। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বেশ কাটেনি তার কখনো। স্বাধীনত্তোর ছাত্রলীগের ভাঙ্গনকে কেন্দ্র করে '৭২ সালে স্বাধীনতার অন্যতম নিউক্লিয়াস সিরাজুল আলম খানের তন্ত্র-মন্ত্রে এবং জলিল-রব-সিরাজের নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)গঠিত হলে তাতে যোগ দিয়ে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। তার আগে তিনি বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক আদমজী জুট মিলের প্রধান নির্বাহীর পদ থেকে বরখাস্ত হন। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তিনি আ স ম আব্দুর রবের মতো '৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনে ঢাকা থেকে প্রার্থী হলেও জামানত হারান। সিপাহী জনতার বিপ্লবের পর প্রয়াত এ  সমাজতন্ত্রী এম এ আউয়াল নিজেকে জাসদের মূল নেতা হিসাবে দাবি করেন। 

রফিকউল্লাহ-আজহার 

"৫৭-৬০ মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন রফিক উল্লাহ চৌধুরী। সিএসপি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী রফিক উল্লাহ আমলাতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থা বেছে নেন। সৎ ও নিষ্ঠার পরিচয় মেলে স্বাধীনতাত্তোর তাকে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুখ্যসচিব পদে নিযুক্তির ঘটনায়। রফিক উল্লাহ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিনয়ের সঙ্গে বলেন,'পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র যা করেছে, তা দয়া করে আপনি করবেন না। আমার নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা লংঘণ হয়েছে। যদি আমাকে আপনার পাশে রাখতেই চান, তাহলে আমাকে প্রধানমন্ত্রীর সচিব করতে পারেন।" বঙ্গবন্ধু তাই করেন। রফিক উল্লাহ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু হত্যার পর চাকুরী থেকে বরখাস্ত হন। বর্তমান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী তার মেয়ে।

রফিক উল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে দু'বছর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কাজী আজাহারুল ইসলাম। ব্যারিস্টারি পড়তে বিলাতে গমন করায় পরবর্তী এক বছর (৫৯-৬০) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপালন করেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। ৬০-৬৩ ওই দুই মেয়াদেই সভাপতি হন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। স্বাধীনতাত্তোর প্রথম জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নির্বাচিত হওয়া মোয়াজ্জেমের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে জুটি বাঁধা শেখ ফজলুল হক মনির সম্পর্কের টানাপোড়ন ছাত্রলীগের শুরু থেকেই। আওয়ামী লীগে কাঙ্খিত পদ না পাওয়ায় বরাবরই অসন্তোষ ছিল তার মনে। চিফ হুইপ ছিলেন প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায়। বাকশাল হলে শেখ মনি অন্যতম সম্পাদক হিসাবে ১৫ সদস্যের সর্বেশ্বরী নীতিনির্ধারক মন্ডলীতে ঠাঁই পেলেও কেবল সদস্য পদ নিয়ে খুশী থাকতে হয় শাহ মোয়াজ্জেমকে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোচতাকের প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে বিতর্কিত হয়ে পড়েন। জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার অন্যতম আসামী শাহ মোয়াজ্জেম খুনী মোশতাক ডেমোক্রেটিক লীগ গঠনে বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখেন। এরশাদ জমানায় প্রথমে মন্ত্রী ও পরে উপপ্রধানমন্ত্রী   এবং জাতীয় পার্টির মহাসচিব নিযুক্ত হন। শাহ মোয়াজ্জেম আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে কখন স্থাব পাননি। বর্তমানে তিনি বিএনপিতে আছেন না থাকার মতো। 

"শেখ মনি" 

৬০-৬৩ পর্যন্ত শাহ মোয়াজ্জেমের সঙ্গে শেখ ফজলুল হক মনির জুটি ছিল ছাত্রলীগের ইতিহাসে একটি বলিষ্ঠ জুটি। মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ও স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। বাকশাল হলে শেখ মনি ১৫ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাহী পরিষদে সদস্য হন অন্যতম সম্পাদক হিসাবে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার দিন তার বাসভবনও খুনীরা হামলা চালায়। এতে তিনি এবং তার অন্তঃ সত্তা স্ত্রী আরজু মনিও নিহত হন। ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এমপি তার পুত্র। 

ওবায়দুর রহমান

৬৩-৬৫ মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন কে এম ওবায়দুর রহমান। তার সঙ্গে জুটি বেঁধে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। ইতিহাসে দু'জনই বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। তুখোড় রাজনীতিবিদ। কিন্তু আওয়ামী লীগে টিকে থাকতে পারেননি ওবায়দুর রহমান। তিনি ‘৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সমাজ কল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৭০ সালে জাতীয় পরিষদে ও স্বাধীনতার পর '৭৩ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য হন। এরপর প্রতিমন্ত্রী হন। বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর খুনী মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী হয়ে বিতর্কিত হয়ে পড়েন। জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার আসামী হয়েছিলেন মোশতাকের দোসর হিসাবে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে মোশতাক মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যকে টেনে আনা হলেও কে এম ওবায়েদের জন্য তা নিষিদ্ধ ছিল। সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান তাকে কাছে টেনে মন্ত্রী করেন। কিছুদিন পর অব্যাহতি দেন। জিয়া নিহত হলে বিচারপতি সাত্তার মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু তাতে স্থান পাননি তিনি। এরশাদের সামরিক আদালতে দুর্নীতির দায়ে কে এম ওবায়েদের ১৪ বছর জেল হলেও তা ভোগ করতে হয়নি। বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারম্যান হলে কে এম ওবায়েদ মহাসচিব নিযুক্ত হন। '৮৭ সালে তাকে এরশাদের সঙ্গে যোগসাজশের দায়ে বহিস্কার করা হয়। মন্ত্রী হওয়ার গুঞ্জণ গুজবে পরিণত হয়। জনতা দল নামে একটা দল গঠন করলেও '৯৬ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিতে ফিরে গিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য পদ লাভ করেন। '০১ সালে বিএনপি সরকারে এলেও মন্ত্রী হতে পারেননি কে এম ওবায়দুর  রহমান। তিনি পরলোকে।

"সিরাজুল আলম খান"

বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা সিরাজুল আলম খান ৬৩-৬৫ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। স্বাধীনতার অন্যতম নিউক্লিয়াস বলে খ্যাত এই নেতা মুজিব বাহিনীরও কান্ডারী ছিলেন। স্বাধীনতার পতাকা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা ইত্যাদির নেপথ্যে মূল ক্রীড়নকের ভুমিকায় থাকা সিরাজুল আলম খান আওয়ামী লীগের কোন পদে ছিলেন না। স্বাধীনতার পর মুজিববাদ নয়, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে সর্বদলীয় সরকার গঠণের দাবি জানান তিনি। ছাত্রলীগের মুক্তিযুদ্ধে চার খলিফা খ্যাত ছাত্রনেতা ডাকসু ভিপি আসম রব ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন অংশ সিরাজুল আলম খানের মতবাদের প্রতি সমর্থন দেন। ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও ডাকসু জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন মুজিববাদের পক্ষে অবস্থান নিলে ছাত্রলীগ ভেঙ্গে যায়। '৭২ সালে গঠিত হয় সিরাজুল আলম খানের দর্শনেই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ। বঙ্গবন্ধু ও পরে জাতীয় চারনেতা নিহত হওয়ার পর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান হলে জাসদ ও কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী বিপ্লব সংঘটন করা হয়। জিয়াকে সরিয়ে সেনাপ্রধান হওয়া খালেদ নিহত হন। মোশতাককে সরিয়ে  বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করেছিলেন খালেদ মোশাররফ। খালেদ নিহত হলে জিয়া সেনাপ্রধান পদে ফিরে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। সিরাজুল আলম খানের জাসদীয় দর্শন বা তাহের ১২ দফা মানতে অস্বীকার করে জেনারেল জিয়া উল্টো তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলান এবং সিরাজুল আলম খান কারাদন্ড দেন সামরিক আদালতে। সিরাজুল আলম খান পরবর্তীতে রাজনীতির অদৃশ্য হয়ে যান। আজো রহস্যময় এক রাজনীতিবিদ বটে। 

 ফেরদৌস কোরেশী

ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী ও আব্দুর রাজ্জাক ও মাজহারুল হক বাকী ও আব্দুর রাজ্জাক জুটিও ছাত্রলীগের ইতিহাসে এক অনবদ্য চরিত্র। ফেরদৌস কোরেশী ছাত্রলীগের সভাপতি শুধু নন, ডাকসু'রও ভিপি ছিলেন।৬৫-৬৬ মেয়াদে। কোরশীও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে স্থান পাননি। স্বাধীনতাপূর্বই তিনি বঙ্গবন্ধু ঘরণার বিরোধী। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হয়েছিলেন জেনারেল জিয়ার আমলে। বিগত ওয়ান ইলেভেনকালে তিনি আলোচনায় উঠে এসেছিলেন। নতুন এক পার্টি গঠনেরও  দৌড়ঝাঁপ ছিল নিত্যদিনের মিডিয়ার খবর। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে যায় তার সব পরিকল্পনা। যখন সেনাবাহিনী সমর্থিত ফখরুদ্দীনের সরকারের টু মাইনাস থিউরি ভেস্তে যায়। 

মাজহারুল হক বাকী

৬৫-৬৬ মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন মাজাহারুল হক বাকী। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনের তুখোড় নেতা হিসাবে সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকের ন্যায় বলিষ্ঠ ভুমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন বাকী।  তাকে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দেখা যায়নি।  

আব্দুর রাজ্জাক

বঙ্গবন্ধু যাকে আদর করে বলতেন "আমার রাজ্জাক" সেই রাজ্জাক ছাত্রলীগের দু'বার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার অন্যতম নিউক্লিয়াস আব্দুর রাজ্জাকই ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে একমাত্র নেতা যিনি আওয়ামী লীগের দু'বার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একবার আব্দুল মালেক উকিলের সঙ্গে আরেকবার বঙ্গবন্ধু কন্যা শেং হাসিনার সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। '৮৩ সালে বাকশাল পুনরুত্থানের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কার্যত রাজ্জাকেরই ১৪ শতাংশ সমর্থনপুষ্ট ছিল।'৯২ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাকশালকে একীভূত করে প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। '০৯ সালে কাউন্সিলে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও আব্দুল জলিল প্রমুখ নেতার ন্যায় প্রেসিডিয়াম থেকে ছিটকে পড়েন। অনেকটা নীরবে নিভৃতে না ফেরার দেশে চলে গেছেন জননেতা আব্দুর রাজ্জাক। বঙ্গবন্ধুর রাজ্জাক। 

আব্দুর রউফ

'৬৮-৬৯ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হন আব্দুর রউফ। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারেননি তিনি। '৭৩ সালের ৭ মার্চের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনী বিজয়ী হওয়ার পর হুইপ হয়েছিলেন উপমন্ত্রীর মর্যাদায়। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর খুনী মোশতাকেরও হুইপ হন '৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুর রউফ। জীবদ্দশায়ই রাজনীতি থেকে হারিয়ে যান। 

খালেদ মোহাম্মদ আলী

আব্দুর রউফের সঙ্গে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন খালেদ মোহাম্মদ আলী। ৬৯ গণঅভ্যুত্থানের সময়ে তিনি বিশিষ্ট ভুমিকাপালন করেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই পেলেও শীর্ষ পদে তাকে কখনো দেখা যায়নি। বর্ষীয়ান এ নেতা বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনেও ভুমিকা রাখেন।  বর্তমানে রাজনীতিতে নেই।

তোফায়েল আহমেদ

ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে কিংবদন্তীতুল্য মহানায়ক। '৬৯র গণঅভ্যুত্থান হয় তার নেতৃত্বে।

তোফায়েল আহমেদ '৬৯'র গণঅভ্যুত্থানত্তোর ২৩ ফেব্রুয়ারি কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধীতে ভূষিত করেন। ছাত্রলীগের সভাপতি হন এরপর পরই। তার সাধারণ সম্পাদক আসম আব্দুর রবও পরের বছর ডাকসু ভিপি হন। তোফায়েল আহমেদ মুজিব বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। স্বাধীনতাত্তোর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব নিযুক্ত হন মন্ত্রীর মর্যাদায়। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও '৯২ -'০৯ পর্যন্ত প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের '৯৬-'০১ মেয়াদে শিল্প ও বানিজ্য মন্ত্রী ছিলেন। প্রেসিডিয়াম থেকে বিস্ময়করভাবে তাকেও সরিয়ে দেয়া হয়। পাঁচ বছর রাখা হয় মন্ত্রিসভার বাইরে। সর্বশেষ নির্বাচনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ আবার সরকারে এলে বানিজ্য মন্ত্রী হন বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল আহমেদ। 

আ স ম রব

জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আসম আব্দুর রব ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসু ভিপি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধককালীন খলিফা খ্যাত স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম আসম রব প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং বঙ্গবন্ধুকে 'জাতির পিতা' উপাধী দেন। রাজনীতির কঠিন বাস্তবতায় তাকে আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতি করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে '৭৩ এর নির্বাচনে প্রার্থী হতে হয়েছে। জেনারেল জিয়ার সামরিক আদালতে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র মামলায় কারাদন্ডলাভ করতে হয়েছে। '৮৮ সালে প্রহসনের নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ) নেতা হিসাবে তিনি বিরোধী দলীয় নেতার আসনে বসেন।'৯৬ সালের শেখ হাসিনা সরকারের নৌ পরিবহন মন্ত্রী হন। তিনি জাসদের সভাপতি।

নূরে আলম সিদ্দিকী

রাজনীতির ময়দানে অনলবর্ষী বক্তা বলে পরিচিত নূরে আলম সিদ্দিকী একাত্তরের আগুনঝরা দিনগুলোর অন্যতম নির্মাতা। ছাত্রলীগের সভাপতি হিসাবে স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের প্রতিটি সভা-সমাবেশের সভাপতিত্ব করেন। তার জ্বালাময়ী ভাষণ ইতিহাসের একেকটি স্পূলিঙ্গ।

মুজিববাদের সমর্থক। '৭৩ সালে আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা হলে তিনি তার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাকশাল বিরোধী নূরে আলম সিদ্দিকী '৯৬ সালে আওয়ামী লীগে ফিরে এলেও কার্যকর ভুমিকা রাখার সুযোগ পাননি। 

শাহজাহান সিরাজ

মুক্তিযুদ্ধকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা। তিনি স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করেন। '৭২ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বরখাস্ত হন। পরে জাসদ হলে যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। জাসদ (সিরাজ) বিলোপ করে তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদে প্রতিমন্ত্রী ও পরের মেয়াদে মন্ত্রী হন। তবে বিএনপিতে সাংগঠনিক মর্যাদা লাভে ব্যর্থ হন। 

ইসমাত কাদির গামা

শাহজাহান সিরাজ বহিস্কার হলে ইসমাত কাদির গামাকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। '৭২ সালে ছাত্রলীগ(সিদ্দিকী-মাখন) সম্মেলনে শেখ শহীদুল ইসলাম সভাপতি ও এম এ রশীদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অপরদিকে ছাত্রলীগ(রব-সিরাজ) আফম মাজবুবুল হককে সভাপতি ও মাহমুদুর রহমান মান্নাকে সাধারণ সম্পাদক করে। বঙ্গবন্ধু শেখ শহীদ ও এম এ রশীদের ছাত্রলীগকে সমর্থন দেয়ায় তা মূল ছাত্রলীগ বলে বিবেচিত হয়। ছাত্রলীগ (মাহবুব-মান্না) পরিচিতি লাভ করে জাসদ ছাত্রলীগ নামে।  

শেখ শহীদ

'৭২ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হন শেখ শহীদুল ইসলাম। তিনি পরে আওয়ামী লীগের সমাজসেবা সম্পাদক ছিলেন। '৭৫ সালে বাকশাল হলে অঙ্গফ্রন্ট জাতীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন সাংবিধানিক কাঠামোয়। বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন। এরশাদের সময়ে মন্ত্রী নিযুক্ত হন। বর্তমানে মঞ্জুর বিজেপির মহাসচিব তিনি। 

এম এ রশীদ

 ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন সংকটময় মুহূর্তে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অবস্থান করে নিতে পারেননি এ নেতা। 

মনিরুল হক চৌধুরী

'৭৩ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়া মনিরুল হক চৌধুরী জাতীয় পার্টি শাসনামলে চিফ হুইপ ছিলেন। এখন বিএনপিতে আছেন দায়সারাভাবে ।

শফিউল আলম প্রধান

মনিরুল হক চৌধুরীর সময়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন শফিউল আলম প্রধান। '৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেভেন মার্ডার সংঘটিত হওয়ার দায়ে প্রধানকে বরখাস্ত করে কারারুদ্ধ করা হয়। তার সাজাও হয়। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার জেনারেল জিয়া তাকে কারামুক্তি দিয়ে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেন। চরম আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী শফিউল আলম প্রধান মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জাগপা সভাপতি ছিলেন। শফিউল আলম প্রধান বরখাস্ত হলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারির সাংবিধানিকভাবে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। শিক্ষমতা বলে একই বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে দেশে জাতীয় দলীয় ব্যবস্থা স্বরূপ 'বাকশাল' কায়েম করেন। বাকশালের পাঁচটি অঙ্গফ্রন্টের মধ্যে ছাত্রলীগ একটি। বাংলাদেশ  ছাত্রলীগ 'জাতীয় ছাত্রলীগ' নামধারণ করে। সভাপতি বলে কোন পদ না রেখে অন্যান্য সংগঠনের ন্যায় এর একজন সাধারণ সম্পাদক নিয়োগ করা হয় বাকশাল চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক। 

শেখ শহীদ
বাকশালের অন্যতম অঙ্গফ্রন্ট জাতীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নিয়োগ লাভ করেন স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রথম সম্মেলনে নির্বাচিত সভাপতি শেখ শহীদুল ইসলাম। 

জাতীয় ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মনিরুল হক চৌধুরী ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীনের (সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে সেভেন মার্ডারের দায়ে বহিস্কৃত হন) নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বিলুপ্ত হয়ে যায়।  
'৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু প্রায় সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর খুনী খন্দকার মোশতাক কর্তৃক ১ সেপ্টেম্বর বাকশাল আদেশ বাতিল করা হয়। ফলে বাকশালসহ অন্যান্য অঙ্গফ্রন্টের মতো জাতীয় ছাত্রলীগেরও অস্তিত্ব লোপ পায়। 
প্রসঙ্গত, শেখ শহীদুল ইসলামও বঙ্গবন্ধু হত্যাত্তোর রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মীনী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের একমাত্র বোনের ছেলে শেখ শহীদুল ইসলাম জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে এরশাদের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) মহাসচিব। 

রাজনৈতিক দলবিধি আইনের আওতায় '৭৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনর্জীবিত হয়। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন ভাবে আত্মপ্রকাশ করে। 

ওবায়দুল কাদের

'৭৬ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পুনর্জীবিত হলে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কারাগারে অন্তরীন  মেধাবী ছাত্রনেতা ওবায়দুল কাদের সভাপতি ও বাহা উল আলম চুন্নুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে ছাত্রলীগ নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করে। আওয়ামী লীগের উপদলীয় কোন্দলের প্রভাব ছাত্রলীগের ওপরও পড়ায় দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন অনুষ্ঠান সম্ভবপর হয়নি। এরপর '৮৩ সালে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওবায়দুল কাদের সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক সংগঠক হিসাবে তিল তিল করে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে উঠে এসেছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য থেকে যুব ক্রীড়া সম্পাদক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি মন্ডলীর সদস্য এবং আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। শেখ হাসিনার '৯৬-'০১ সরকারের যুব ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী হওয়া ওবায়দুল কাদের বর্তমানে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী। ছাত্রলীগের ইতিহাসে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক ও ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ অলংকৃত করেন। তিনি দ্বিতীয় দফা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন।

বাহা উল মজনু চুন্নু

ওবায়দুল কাদের ও বাহা উল আলম মজনু চুন্নু র নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ '৮৩ সাল পর্যন্ত টিকে থাকে। আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল চাঙ্গা হয়ে ওঠে। চলে বহিস্কার পাল্টা বহিস্কারের ঘটনা। আবারও ভাঙ্গনের মুখে পড়ে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের দুটো নেতৃত্ব আত্মপ্রকাশ করে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীন সভাপতি ও আখম জাহাঙ্গীর হোসাইন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে ছাত্রলীগের কমিটি অনুমোদন করেন।  অপরদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক ও সভাপতি মন্ডলীর সদস্য মহিউদ্দীন আহমেদসহ সহমত পোষণকারীরা 'বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) পুনরুজ্জীবিত করেন এবং ফজলুর রহমানকে সভাপতি এবং বাহা উল আলম মজনু চুন্নুকে সাধারণ সম্পাদক করে 'জাতীয় ছাত্রলীগকেও পুনর্জীবিত করেন। '৮৬ সালের নির্বাচনে ফজলুর রহমান কিশোরগঞ্জ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে এমপি নির্বাচিত হন। '

৯২ সালে বাকশাল আওয়ামী লীগে একীভূত হলে অনলবর্ষী বক্তা ফজলুর রহমান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পান।  পরে বহিস্কৃত হয়ে বিএনপিতে যোগ দেন। অপরদিকে উভয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাহা উল আলম মজনু জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছলেও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অবস্থান করে নিতে পারেননি। 

মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীন 

'৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেভেন মার্ডার সংঘটিত হওয়ার জের ধরে ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান বহিস্কার হন। তখন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপালন করেন ৬৯ এ জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ পড়ুয়া মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন '৮৩ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের সহ প্রচার সম্পাদক হওয়া মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীন '৮৭- ০৯ সাল পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বপালন করেন। বর্তমানে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিতে রয়েছেন। '০৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা-৭ আসনে জয়ী হলেও সর্বশেষ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে হেরে যান। বিএমএ'র সাবেক এ মহাসচিব স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বিশিষ্ট ভুমিকা রাখেন। ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীন বিএমএ এর বর্তমান সভাপতি।

আ খ ম জাহাঙ্গীর

মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীনের সঙ্গে ছাত্রলীগে জুটি বেঁধে ছিলেন আখম জাহাঙ্গীর হোসাইন সম্প্রতি ইন্তেকাল করেছেন। আওয়ামী লীগের সহ দপ্তর সম্পাদক ছিলেন ।'০৯ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসাবে দায়িত্বপালন করেন। '০৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন হাতছাড়া হয় চার বারের এ সংসদ সদস্যের। সর্বশেষ নির্বাচনের আগের নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন পুনঃউদ্বার করে জয়ী হন। গত নির্বাচনে মনোনয়ন না পেলেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ফিরে আসেন। সম্প্রতি তিনি মারা যান। 

আব্দুল মান্নান

'৮৪ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে আব্দুল মান্নান সভাপতি ও জাহাঙ্গীর কবির নানক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আব্দুল মান্নান  বগুড়া-১ আসনে এমপি থাকা অবস্থায় সম্প্রতি ইন্তেকাল করেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ২০০৯ সালে কমিটি থেকে বাদ পড়েন।

আব্দুল মান্নান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী নেতা হয়ে উঠেছিলেন। ছিলেন আওয়ামী লীগ প্রধানের বিশ্বস্তভাজন হিসাবেও পরিচিত। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি আব্দুল মান্নান '৮৭ সালে কেন্দ্রীয় সদস্য, '৯২ সালে সহ প্রচার সম্পাদক '৯৭ সালে প্রচার সম্পাদক এবং '০২ সালে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন আব্দুল মান্নান। 

জাহাঙ্গীর কবির নানক

জাহাঙ্গীর কবির নানক '৮৪ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বরিশাল বিএম কলেজের ভিপি ও জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি অবস্থান থেকে সরাসরি কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। জাহাঙ্গীর কবির নানক ডাকসু নির্বাচনে জিএস পদে ছাত্রলীগ প্যানেলে নির্বাচনও করেন। যে প্যানেলে আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভিপি পদে প্রার্থী ছিলেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে উঠে আসতে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয় তাকে। '০২ সালে পর্যবেক্ষক সদস্য হিসাবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় অভিষেক ঘটলেও তিনি '০৩ সালে আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন যুগ্ম সম্পাদক থেকে। '০৯ সালে সাংগঠনিক সম্পাদক ও কিছুদিন পর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন নানক। সর্বশেষ কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক এ এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী। তিনি ঢাকা থেকে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন।   

সুলতান মনসুর

রাজনীতির ক্লিনম্যান বলে পরিচিত সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ '৮৬ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সুলতান মনসুর স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত  ছাত্রলীগের ডাকসুতে নির্বাচিত হওয়া একমাত্র ভিপি। সাবেক এমপি সুলতান কেন্দ্রীয় সদস্য পদ থেকে '০২ সালে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন।  কিন্তু '০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন হাতছাড়া হয় তার। '০৯ সালে হারান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ। সেই থেকে রাজনীতির মাঠে নেই সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী সদস্য ছিলেন। গত নির্বাচনে বিএনপি জোট থেকে মৌলভীবাজারের একটি আসনে গণফোরাম প্রার্থী হিসাবে জয়ী হন এ নেতা। তবে বঙ্গবন্ধুর আর্দশের সৈনিক বলেই সংসদে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

আব্দুর রহমান

সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেম আব্দুর রহমান। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে উঠে আসেন '০২ সালের কাউন্সিলে। '০৯ সালের কাউন্সিলে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ হাতছাড়া হয়। শুধু সদস্য করা হয় তাকে। পরে তিনি  আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন। ফরিদপুর-১ আসনের  এমপি হন। গত নির্বাচনে মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ হলেও  কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হন।

হাবিবুর রহমান হাবিব

'৯০ সালের সম্মেলনে ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়া হাবিবুর রহমান হাবিবকে '৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে পাবনার একটি আসনে মনোনয়ন দেয়া হয়।  কিন্তু '৯০ ছাত্রগণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা হাবিবুর রহমান হাবিব '৯৬ সালের নির্বাচনে মনোনয়নলাভে ব্যর্থ হন। যোগ দেন বিএনপিতে। অবশ্য বিএনপির মনোনয়ন পেলেও জয়ী হতে পারেননি। বর্তমানে তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচকও ছাত্রলীগের এ সাবেক সভাপতি।

শাহে আলম

বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে '৯০ এর ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের সহ সভাপতি পদে থেকেই ভিপি পদে মনোনয়ণ পেয়েছিলেন মোহাম্মদ শাহে আলম। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ভেঙ্গে যাওয়ায় ছাত্রলীগকে এককভাবে লড়তে হয়। ফলে ডাকসু হাতছাড়া হয়ে চলে যায় ছাত্রদলের হাতে। '৯০ এর ছাত্রগণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ছাত্রলীগ সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তিনি '৯১ এর নির্বাচনে প্রার্থী হলে সংগঠনের সহ সভাপতি শাহে আলমকে ছাত্রলীগের সভাপতি ঘোষণা করা হয়। সাধারণ সম্পাদক পদে অসীম কুমার উকিলই থেকে যান পরবর্তী সম্মেলন না হওয়া পর্যন্ত। শাহে আলম '০২ সালে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলের আগে পর্যবেক্ষক সদস্য হিসাবে কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় ডাক পেলেও কাউন্সিলে নির্বাচিত কমিটিতে স্থান পাননি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে অবস্থান করে নিতে পারেননি।  সর্বশেষ নির্বাচনে বরিশাল-২ আসনে বিজয়ী হন ছাত্রলীগের এ সাবেক সভাপতি। 

অসীম কুমার উকিল 

হাবিবুর রহমান হাবিব ও মোহাম্মদ শাহে আলমের সঙ্গে জুটি বেঁধে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব করেছেন অসীম কুমার উকিল। সাধারণ সম্পাদক হিসাবে তিনি '৯০ এর ছাত্রগণঅভ্যুত্থানেও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন। '০২ সালে আওয়ামী লীগে উপ প্রচার সম্পাদক হন তিনি। '০৯ সালেও একই পদে নির্বাচিত হন। বিগত কাউন্সিলে অসীম কুমার উকিল আওয়ামী লীগোর সাংস্কৃতিক সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এমপি হয়েছেন নেত্রকোনা থেকে। তার স্ত্রী সাবেক এমপি (সংরক্ষিত) অপু উকিল যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদিকা।

"মঈনুদ্দীন হাসান চৌধুরী" 

'৯২ সালে কথিত আদু ভাইদের বিদায় দিয়ে নিয়মিত ছাত্রদের দিয়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়েছিল। মঈনুদ্দীন হাসান চৌধুরীকে সভাপতি ও ইকবালুর রহিমকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে ছাত্রলীগ নব উদ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। '৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৪ আসনে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মঈনুদ্দীন হাসান চৌধুরীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হয়। কিন্তু তিনি হেরে যান। এরপর থেকে তাকে আর মনোনয়ন দেয়া হয়নি।  আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও স্থান হয়নি তার।

ইকবালুর রহিম

ইকবালুর রহিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন '৯২ সালের সম্মেলনে। সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগের এককালীন কেন্দ্রীয়  সহ সভাপতি প্রয়াত আব্দুর রহিমের পুত্র ইকবালুর রহিম বর্তমান সংসদের হুইপ। দিনাজপুর-৩ আসনের এ সংসদ সদস্য এখনো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই না পেলেও জাতীয় সংসদের হুইপ নির্বাচিত হয়েছে এবারও।

"এনামুল হক শামীম"

জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি এ কে এম এনামুল হক শামীম ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন '৯৪ সালের সম্মেলনে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার হলেও গত কাউন্সিলে বাদ পড়েন। তিনি  শরিয়তপুর-২ আসনর তিনি এমপি এবং উপমন্ত্রী।

ইসহাক আলী খান পান্না

ছাত্রলীগে এনামুল হক শামীমের সঙ্গে জুটি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক হিসাবে ইসহাক আলী খান পান্না। ৯৪ সালের সম্মেলনে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। '০৮ সালের নির্বাচনে পিরোজপুর-২ দলীয় মনোনয়ন পেলেও পরে জোটগত কারণে হাতছাড়া হয়ে যায়। তিনিও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বাইরে অবস্থান করছেন। তবে রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। 

"বাহাদুর বেপারী"

'৯৬ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হন বাহাদুর বেপারী ও সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকন। বাহাদুর বেপারী এখনো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাননি। শরিয়তপুর-৩ আসনে প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে ছিলেন তিনি।

অজয় কর খোকন 

ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকনেরও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে এখনো অভিষেক ঘটেনি। কিশোরগঞ্জের একটি আসনে মনোনয়ন চেয়েও পাননি গত নির্বাচনে। 
 
লিয়াকত শিকদার

লিয়াকত শিকদার। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। বিএনপি জামাত জোট সরকারের আমলে কারারুদ্ধ ছিলেন দীর্ঘদিন। ফরিদপুর-১ আসনে প্রার্থী হতে চান আগামী নির্বাচনে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে অবস্থান হয়নি তার এংনো। 

নজরুল ইসলাম বাবু

নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এখনো কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়নি তার। নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য তিনি। 

মাহমুদ হোসেন রিপন

মাহমুদ হোসেন রিপন ও  মাহহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন যথাক্রমে ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। 
আওয়ামী লীগে তাদের অভিষেক ঘটেনি এখনো। তবে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হোসেন রিপন গাইবান্ধা-৫ আসনে শক্তিশালী প্রার্থী হিসাবে আলোচনায় ছিলেন। 

মাহফুজুল হায়দার রোটন

ছাত্রলীগের  সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার রোটন চৌধুরীও চট্টগ্রামের একটি আসনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। 

বদিউজ্জামান সোহাগ

 ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এখনও নাম লেখাতে না পারলেও মনোনয়ন দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন  বাগেরহাটের একটি আসনে।  

নাজমুল আলম সিদ্দিকী

ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আলম সিদ্দিকীরও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে পরিচিতি গড়ে ওঠেনি।

সাইফুল ইসলাম সোহাগ 

ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম সোহাগ আওয়ামী লীগের  রাজনীতিতেই সক্রিয় রয়েছেন। 

বিএম জাকির হোসেন 

ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বিএম জাকির হোসেনও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। 

রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন 

ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন বিতর্কিত হয়ে বরখাস্ত হন। তিনি এর আগে ডাকসু ভিপি পদে হেরে যান। 

গোলাম রাব্বানী 

ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে আলোচিত সমালোচিত ছিলেন গোলাম রাব্বানী। ডাকসু জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। নৈতিক স্খলন জনিত অপরাধের অভিযোগে সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরীর সঙ্গে তিনিও বরখাস্ত হন। 
 
জয়- ভট্টাচার্য 

ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়। প্রথমে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হলেও গত প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা সম্মেলন ছাড়াই তাদের সরাসরি নিযুক্ত করেন।

পাদটীকাঃ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া সংগঠন ছাত্রলীগ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ঐশ্বর্যকে স্মরণ করে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে ঘুরে দাঁড়াবে - এটাই হোক প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর শপথ। 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

বিডি প্রতিদিন/কালাম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর