৩০ জানুয়ারি, ২০২১ ০৯:৩০

হয়তো সেটাই মানুষের নিঃশব্দ আহ্বান

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

হয়তো সেটাই মানুষের নিঃশব্দ আহ্বান

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী। ফাইল ছবি

পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে, তারা নিজেও হয়তো জানে না, নীরবে নিভৃতে তারা পৃথিবীর কত উপকার করে চলেছে। এমন মানুষটা কখনো নিজে বুঝে উঠতে  পারে না, তার বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা দায়িত্ববোধ কত মানুষের জীবন বদলে দিচ্ছে। এক টুকরো কুড়িয়ে পাওয়া লেখা খুব মূল্যবান মনে হলো। লেখাটা অনেকটা এমন ছিল, চোখ বন্ধ করে বুকের ওপর হাত রাখলে একটা ডাক শুনতে পাওয়া যায়। সেটা আর কিছু নয়, সেটা প্রাণের ব্যাকুলতা, মনের টান। হয়তো সেটাই আহ্বান। যতক্ষণ পৃথিবীতে এই আহ্বান আছে ততক্ষণ বুঝতে হবে পৃথিবীর কেউ না কেউ পেছনে দাঁড়িয়ে সবার অজ্ঞাতেই মানুষের নতুন করে বেঁচে উঠার বীজ বুনে যাচ্ছে। এই  মানুষগুলো নিজেরা কখনো জানতেও পারে না, সেই বীজ একদিন বড় একটা বৃক্ষে পরিণত হবে। যে বৃক্ষের ভেঙে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, দমে যাবার কোনো পদচিহ্ন নেই। কারণ, সেই বৃক্ষটি যে মাটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে উপরে উঠার মতো অসীমশক্তি তার মধ্যে গড়ে তুলেছে! যে মানুষটা নিভৃতে এই কাজটি করে চলেছে, সে কখনো হয়তো জানতেও পারবে না, যে বৃক্ষের ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে সে তীব্র রোদের সাথে লড়াই করে চলেছে সেই বৃক্ষটার জন্ম তার হাত ধরেই হয়েছে।  সুকান্ত ভট্টাচার্যের রানার কবিতাটার কথা মনে পড়ে গেল। এটা কবিতা না জীবনের গভীরে লুকিয়ে থাকা অমোঘ সত্য, তা সেটার ভেতরে ঢুকেই বের করে আনাটা সম্ভব। যেমন সুকান্ত ভেবেছেন তার দর্শন থেকে এমন করে :

রানার ছুটেছে তাই ঝুম্‌ঝুম্ ঘণ্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,
রানার চলেছে, রানার !
রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার।
দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার-
কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।

হয়তো এমনটাই জীবনের আহ্বান। যে রানার একটুকরো মূল্যহীন কাগজে কালো অক্ষরের চিঠির বোঝার ভার কাঁধে বয়ে নিয়ে চলেছে সে হয়তো নিজেও জানে না সে অনেক মানুষের জীবন বদলের স্বপ্ন বুনে চলেছে। মুঠো মুঠো করে, তিল তিল করে, একটা বেকার ছেলের চাকরি পাওয়ার সাফল্যের চিঠিটা রানার নিয়ে আসে। সন্তানের চিঠি পাবার জন্য মায়ের দীর্ঘ ব্যাকুলতায় আনন্দ অশ্রু এনে দেয় রানার। প্রিয়ার চিঠি পাবে বলে এক জীবনসঙ্গিনীর বসে থাকা ভালোবাসার বিষন্ন চোখ অলৌকিক আনন্দে চিকচিক করে উঠে রানার কাঁধের বোঝা থেকে বেরিয়ে আসা চিঠির মাধ্যমে। প্রিয়জন হারানোর দুঃস্বপ্নটা রানারের চিঠির ঝুলিতে কঠিন এক কষ্টের সুর তোলে। সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনার মহাকাব্য হয়ে উঠে চিঠিগুলো। কখনো আবার চিঠিগুলো ইতিহাস হয়। রানার- কি আছে তার, কিছু নেই। মানুষ তাকে তাচ্ছিল্য করে, অবহেলা করে, বঞ্চিত করে, শোষণ করে। কিন্তু রানার তো মহামূল্যবান, সে তা নিজে জানে না, নিজে বুঝে না। কিন্তু মানুষের চোখে রানার তো মূল্যহীন। কত মানুষের জীবন বদলে দেয় রানার তা সে নিজে জানে না। কত মানুষের স্বপ্ন গড়ে দেয় রানার তা সে নিজে বুঝে না। নিজের অজ্ঞাতেই রানার মহানায়ক হয়ে উঠে। মানুষের পোড়া চোখ আর বিবর্ণ কপাল তা বোঝার ক্ষমতা রাখে না। সময়ও রানারকে বুঝতে পারেনি। প্রযুক্তির ধোয়া তুলে সময় কাগজের চিঠিকে মূল্যহীন করেছে। 

কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে রানার। কিন্তু নীরবে নিভৃতে তার না জানা মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। রানার কবিতাটি লিখেছিলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু সুকান্ত  সমন্ধে বলেছেন এমন করে -“গর্কীর মতো, তার চেহারাই যেন চিরাচরিতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কানে একটু কম শোনে, কথা বেশি বলে না, দেখামাত্র প্রেমে পড়ার মতো কিছু নয়, কিন্তু হাসিটি মধুর, ঠোঁট দু’টি সরল”। বুদ্ধদেব বসু সুকান্তের বিষয়ে জানাতে গিয়ে বলেছেন , “যে চিলকে সে ব্যঙ্গ করেছিল, সে জানতো না সে নিজেই সেই চিল; লোভী নয়, দস্যু নয়, গর্বিত নিঃসঙ্গ আকাশচারী, স্খলিত হয়ে পড়ল ফুটপাতের ভিড়ে, আর উড়তে পারল না, অথবা সময় পেল না। কবি হবার জন্যই জন্মেছিল সুকান্ত, কবি হতে পারার আগে তার মৃত্যু হলো”। শেষের কথাটা খুব মর্মস্পর্শী। "কবি হবার জন্যই জন্মেছিল সুকান্ত, কবি হতে পারার আগে তার মৃত্যু হলো"। জীবনবোধের কথা, শেকড়ের খুব গভীরের কথা। কবি হতে পারেননি হয়তোবা সুকান্ত, কিন্তু তিনি কবিদের কবি হয়েছেন। কবিতা লিখেছেন দু'হাত খুলে। নিজের বিশ্বাসকে নিজের আবেগের সাথে মিলিয়েছেন মহানন্দে। হয়তোবা কবি হতে চাননি তিনি। মানুষের কঠিন জীবনের কথা বলতে চেয়েছেন। মানুষের নগ্ন মুখটাকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে শুভবোধের ভাবনায় নিজেকে যুক্ত করতে চেয়েছেন। এভাবেই নিজের অজান্তেই তিনি ক্ষণজন্মা কবি হয়েছেন। ছাড়পত্র লিখেছিলেন তিনি। যক্ষা রোগের সাথে লড়তে লড়তে মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি পৃথিবী থেকে ছাড়পত্র নেন। মৃত্যুর আগে যে তিনি অনেককিছু আমাদের দিয়েছেন তা হয়তো তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। কিন্তু তার মৃত্যু আমাদের জানিয়ে দিল আমরা কি হারিয়েছি। যা হারিয়েছি তা ছিল মহাজীবন, যেমনটা তিনি নিজে ভেবেছেন:

হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়
এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো,
পদ-লালিত্য ঝঙ্কার মুছে যাক
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো!
প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা—
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়:
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্‌সানো রুটি॥

ফেসবুকে একটা লেখা পেলাম। কে লিখেছে, জানি না। হয়তো নিভৃতে নিজের অজান্তে তিনি লিখছেন। কিন্তু সে লেখাটি আমার কাছে খুব মূল্যবান হয়ে উঠল। হয়তো এটাই নিজের চোখের আড়ালে দায়িত্ববোধ। মানুষের জন্য চিন্তা। লেখাটা অনেকটা এমন :
একটা পুরাতন নৌকাকে ভালো করে রঙ করার জন্য একজন রঙ মিস্ত্রিকে নিয়োজিত করা হলো। রং মিস্ত্রী নৌকায় রং করতে করতে লক্ষ্য করলেন নৌকার তলায় একটা ছোট ফুটো রয়েছে। রং মিস্ত্রি তার দায়িত্ব অনুযায়ী নৌকাটি সুচারুভাবে রং করার পর এর নিচে থাকা ফুটোটিকে মেরামত করে সেটির ওপরে রং লাগানোর পর  মজুরি নিয়ে চলে গেলেন।

ঠিক এর পরদিন নৌকার মালিক রং মিস্ত্রির বাড়িতে এলেন ও তাকে বড় অংকের একটা চেক দিতে চাইলেন। রং মিস্ত্রি অনেকটা অবাক হয়ে বলল, আমি তো গতকাল আমার প্রাপ্য মজুরি পেয়েছি। তবে, এই বাড়তি অনেকগুলো টাকার চেক আবার কেন আমাকে দিচ্ছেন?

নৌকার মালিক উত্তরে বললেন, আমি খুব বেশি দিচ্ছি না বরং অনেক কম দিচ্ছি। আপনি আমার যা করেছেন তা টাকার অংকেও দেওয়া সম্ভব না।
কথাটা শুনে রং মিস্ত্রি আবার অনেকটা অবাক হয়ে বললেন, আমি তো আপনার কোনো কথায় বুঝতে পারছি না। আমি আপনার কি এমন উপকার করলাম, যার জন্য আপনি আরও বাড়তি টাকা দিতে চাচ্ছেন।

নৌকার মালিক বললেন, খুব ব্যস্ততার কারণে আমি আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম নৌকার নিচে একটা ফুটো আছে। অথচ, আপনি নিজ দায়িত্বে সেটি মেরামত করে দিয়েছেন।

রংমিস্ত্রি বললেন, অরে ওটাতো সামান্য একটা ফুটো, সেজন্য এতো টাকার চেকের কি প্রয়োজন?

নৌকার মালিক বললেন, না, সেটা সামান্য না। আমি কাজ থেকে ফিরে এসে দেখি ঘাটে আমার নৌকা নেই। রং শুকানোর পরপরই আমার দুই ছেলে নদীতে নৌকা ভ্রমণে বের হয়েছে। নৌকার তলানিতে যে ফুটো আছে তারা তা জানতো না। বুঝতেই পারছেন, আমি কতটা দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম। সন্ধ্যা হবার পরও ছেলেরা নৌকা নিয়ে ফিরছে না দেখে আমার অস্থিরতা বেড়েই চলছিল। ছেলেদের ফেরার আশায় দীর্ঘক্ষণ নদীর দিকে মুখ চেয়ে বসেছিলাম। কোনো নৌকা ঘাটে ভিড়লেই মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আমার ছেলেরা ফিরে এসেছে। অস্থিরতায় ছটপট করতে করতে আপনার বাসায় এসে দেখি আপনিও বাড়িতে নেই, বাজারে গেছেন। এরপর আবার নদীর ঘাটে ফিরে আসি। হঠাৎ দেখি, আমার ছেলেরা নৌকা নিয়ে ফিরছে। আমার আদরের ধন দুটো ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরি। ওরা বুঝে উঠতে পারছিল না, কি এমন ঘটনা ঘটেছে। এরপর নৌকা পরীক্ষা করে দেখি, আপনি নৌকার নিচে থাকা ফুটো সবার অজান্তে মেরামত করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে কাজটি অতি সামান্য মনে হলেও এই সামান্য কাজটি যদি আপনি না করতেন তবে আমার আদরের সন্তানরা আজ নৌকা ডুবিতে মারা যেত। আপনার দায়িত্ববোধ ও ঈশ্বরের কৃপায় তারা আজ বেঁচে এসেছে।

এরপর সংগৃহীত লেখার শেষাংশে বলা হয়েছে :

"জীবনের ঘাটে ঘাটে এরকম কত রং মিস্ত্রি আছে। যারা নিজেও হয়তো জানে না; নীরবে নিভৃতে নৌকার ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দিয়ে কত মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। চোখ বন্ধ করে বুকের ওপর হাত রাখলে একটা ডাক শুনতে পাওয়া যায়... আহ্বান। যতক্ষণ পৃথিবীতে এই আহ্বান আছে ততক্ষণ বুঝতে হবে পৃথিবীর কেউ না কেউ কারো সামান্য সহযোগিতা পেয়ে পুরো একটা নতুন জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছে।"

একটা ছোট পিঁপড়া ও তার মতো অসংখ্য পতঙ্গ নিজেদের অজান্তে পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করে চললেও তারা তা কখনো জানতে পারে না। একটা শ্রমিক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আধুনিক সভ্যতা গড়ে তুললেও সে জানে না এই পৃথিবী বদলানোর কাজটা তার মাধ্যমেই ঘটে চলেছে। একজন শীর্ণকায় কৃষক সারাজীবন প্রাণের তাগিদে ফসল ফলায় কিন্তু সে কখনো জানতে পারে না মানুষের মুখের অন্নের সংস্থান তার মাধ্যমেই হয়। মা তার সন্তানদের পরম যত্নে মানুষ করে তুললেও প্রতিদানে মা সন্তানদের কাছে কি পাবে তা কখনো ভেবে দেখে না। এমন করে প্রতিদিন কত মানুষ তার নিজের অগোচরে পৃথিবীর উপকার করে চলেছে তার খবর সে নিজেও রাখে না। চারপাশের মানুষেরাও রাখে না। সবকিছু যে স্বার্থের পৃথিবী। স্বার্থের খেলা। সে খেলায় কেউ হারে, কেউ জিতে। কিন্তু নিভৃতে কাজ করে যাওয়া মানুষটা আমৃত্যু তার দায়িত্বটা দায়িত্ব ভেবে জীবনের অতিরিক্ত মূল্যটা দিয়ে যায়। সেটা হয়তো সে বুঝে কিন্তু বুঝতে চায় না। হয়তো এটাই মানুষের জীবন।

বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর