১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ১২:০৬

৩১ জানুয়ারি ২০০৭: আমার স্মৃতিতে এক ভয়াল কালরাত্রি

ড. মোঃ আওলাদ হোসেন

৩১ জানুয়ারি ২০০৭: আমার স্মৃতিতে এক ভয়াল কালরাত্রি

ড. মোঃ আওলাদ হোসেন

৩১ জানুয়ারি ২০০৭, স্মৃতি রোমন্থন করলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই ভয়াল রাতের ঘটনাগুলো। নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে দেশ শাসনের দায়িত্ব নিয়েছে। মাননীয় নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে গোপালগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় সাংগঠনিক কর্মসূচি শেষ করে শীতের সকালে ঢাকা ফিরছেন। সবারই মনে আনন্দের আমেজ। কারণ, গোপালগঞ্জ থেকে ফেরার পূর্বে মাননীয় নেত্রী সফরসঙ্গী সকল নিরাপত্তারক্ষী ও কর্মকর্তা, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে শীত মৌসুমের উপহার হিসেবে মাদারীপুরের বিখ্যাত ‘খেজুরের গুড়’ উপহার দিয়েছিলেন। ফেরীতে চরে নেত্রীর গাড়িবহর নিয়ে পদ্মা নদী পাড়ি দিচ্ছে। ফেরীতে বসেই টেলিফোনে যোগাযোগ করে নেত্রীর পরবর্তী কর্মসূচি প্রণয়ন করছি। টেলিফোনে জানতে পারলাম ঢাকায় রাজনৈতিক নেতাদের ধরপাকড় শুরু হয়েছে। সকলের মনেই ‌অজানা আতঙ্ক। মাননীয় নেত্রীকে সুধাসদনে পৌঁছে দিয়ে সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে আমার করণীয় সকল আনুষঙ্গিক কাজ যথারীতি শেষ করে সন্ধ্যার একটু আগে বাসায় ফিরছিলাম। আমি সাধারণত ধানমন্ডি লেকের পাড় দিয়ে পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরি। সুধাসদন থেকে আমার বাসার দূরত্ব কয়েক মিনিটের পায়ে হাঁটা পথ। প্রতিদিন পায়ে হেটেই বাসায় ফিরি। সারাদিনের কাজের শেষে ক্লান্ত শরীরে লেকের পাড়ের নিরিবিলি পরিবেশে হেঁটে আসতে ভালোই লাগে। কিন্তু সেদিন হেঁটে আসলাম না। ক্লান্ত শরীর, মাননীয় নেত্রীর উপহারের খেজুরের গুড় ছাড়াও গ্রামের বাজার থেকে কিনে আনা দেশি জাতের বড়ইসহ ভারী ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে ইচ্ছে করছিল না। কানাডা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি সরোয়ার ভাই-এর গাড়ি এসেছে। আমি ও মাহমুদুল হাসান বাবুল ভাই সরোয়ার ভাই এর সঙ্গী হলাম। 

আমাদের গাড়িটি সুধাসদন থেকে রওয়ানা হয়ে ধানমন্ডি ৬নং রোডের ক্রসিংএ এসে থেমে গেল। সামনে একটি গাড়ি আমাদের পথরোধ করে দাঁড়ালো। মনটা একটু খারাপই হলো। মাগরিব নামাজের ওয়াক্ত হয়ে যাচ্ছে, এখনই আযান দিবে। এমনিতেই আছরের নামাজ কা`যা হয়েছে। ডান পাশের গাড়িটি আমাদের গাড়ির দরজা ঘেঁষে দাড়ানো। দরজা সামান্যতম খোলার কোন উপায় নেই। আমি পিছনের সিটে বাম পাশে, বাবুল ভাই ডান পাশে এবং সরোয়ার ভাই সামনের সিটে বসা। এই তাড়াহুড়োর সময়ে এই উটকো জ্যামটা বিরক্তিই লাগছিল। আমার জানালার পাশে একজন লোক আমার পরিচয় জানতে চাইলে, আমি বললাম। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, ‘আমরাতো আপনাকেই খুঁজছি` বলেই তাৎক্ষণিকভাবে দরজা খুলে আমার পাশে বসলেন। দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কয়েকজন RAB এর সদস্য দেখতে পেলাম, সাদা পোশাকে অনেক লোক। অবস্থা বেগতিক, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরলাম। পরম করুনাময় আল্লাহর অশেষ রহমতে হঠাৎ হাতের মুঠোফোন বেজে উঠলো। (মরহুম) জলিল ভাইয়ের ফোন, কোনো প্রকার সৌজন্যমূলক কথাবার্তা না বলে সরাসরি বললাম, "জলিল ভাই, আমরা মনে হয় গ্রেফতার হয়ে গেছি"। সাথে সাথে হ্যাঁচকা টানে আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিল। ‌‌অল্পক্ষণ পরেই পাশে বসা ‘অচেনা‘ লোকটার হাতে আমার ফোনটা পুনরায় বেজে উঠলো। ফোন টোন শুনে বুঝলাম মাননীয় নেত্রী ফোন করেছেন। আমার ফোনে মাননীয় নেত্রীর নম্বরটি ভিন্ন ‘টোন`এ সেইভ করা ছিল। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠছে ‘Apa` । ঐ লোকটা জিজ্ঞাসা করলেন, "আপা, কে`? উত্তরে বললাম, "মাননীয় নেত্রী`। মূহুর্তের মধ্যে ফোনটা সুইচ অফ করে দিলেন। একটি কাপড় দিয়ে আমার চোখ বেঁধে ফেললেন এবং হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিলেন। গাড়ি ধীর গতিতে চলতে শুরু করলো। আমাদের তিনজনকেই গ্রেফতার করা হলো। গ্রেফতারের কোনো কারণ জানালো না, বা জিজ্ঞাসা করার সুযোগও পেলাম না। চোখ বাঁধা, হাতে হ্যান্ডকাফ পরানো তিন আসামি নিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা ঘুরে গাড়ি ঘণ্টাখানেক চলার পর এক জায়গায় আমাদের নামিয়ে দিল। অল্পক্ষণ পর কোন এক জায়গায় ফ্লোরে বসিয়ে দিল। শীতের রাত ঠাণ্ডা মেঝে। বাবুল ভাই ও সরোয়ার ভাইকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল তখন জানতে পারিনি, পরে জেনেছি দূরত্ব রেখে তিনজনকে একই ফ্লোরে বসিয়েছিল। কয়েক ঘণ্টা পর একটি রুমের সামনে নিয়ে পিছন থেকে চোখে বাঁধা কাপড়টি খুলে ধাক্কা দিয়ে রুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। 

দৈর্ঘ্য-প্রস্থে একেবারেই ছোট একটি রুম। মশা ভ্যান ভ্যান করছে, মুখ খোলাই দায়। ‌অনেক উপরে ছাদের সাথে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি লাইট জালানো রয়েছে। যদিও শীতকাল, লাইট এর তাপে শীত লাগছে না। লোহার ফ্রেমে কাঠের ছাউনি দিয়ে তৈরি ছোট একটি চৌকি। চৌকির উপর দুইটি কম্বল, মেঝেতে এক পাশে অর্ধেক পানি ভর্তি একটি দেড় লিটারের প্লাস্টিকের পুরাতন একটি বোতল। বোতলের ভিতর লালচে রঙের আবরণ পরেছে। চৌকির লোহার ফ্রেমে JIC লেখা রয়েছে। বুঝতে বাকি রইলো না কোথায় আনা হয়েছে। সিনেমাতে দেখেছি, এই ধরনের রুমে এনে কি করা হয়। 

এরপর JIC (Joint Interrogation Cell) তে আমাকে ৫ রাত ৫দিন অমানুষিক শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। 

পরবর্তী বিবরণ আগামীকাল...

লেখক: ড. মোঃ আওলাদ হোসেন
ভেটেরিনারীয়ান, পরিবেশবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক কর্মী।

 

বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর