৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০৮:৩৬

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজাতে ব্যর্থ হয়ে জিজ্ঞাসাবাদে নাটকীয় মোড়

ড. মোঃ আওলাদ হোসেন

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজাতে ব্যর্থ হয়ে জিজ্ঞাসাবাদে নাটকীয় মোড়

ড. মোঃ আওলাদ হোসেন

নিয়মিত জিজ্ঞাসাবাদ ও অকথ্য শারিরীক মানসিক নির্যাতন চলছিল। এখানে বলে রাখা দরকার, জিজ্ঞাসাবাদের পূর্বে যিনি চোখ বাঁধেন ও হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দেন, তাকে কখনো দেখিনি। তিনি দরজার সামনে আসার আগে আমাকে দরজার সামনে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। তিনি আমার পিছনের দিক থেকে চোখে কম্বলের মত মোটা একটা কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে দেন। তারপর হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দেন। এ ছাড়াও যারা জিজ্ঞাসাবাদ করেন তাঁদেরও কখনো দেখতে পাইনি।

৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৭। প্রতিদিনের ন্যায় সন্ধ্যা নাগাদ যথারীতি চোখ বেঁধে হ্যান্ডকাফ পরানো হলো। আমাকে রুম থেকে বের করে নিয়ে কয়েক মিনিট হাঁটার পর সিড়ি বেয়ে দোতলায় কোন একটি রুমে নেওয়া হলো।

সেই রুমে থাকা কে একজন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘উনি কে’?

প্রত্যুত্তরে জানানো হলো, ‘শেখ হাসিনার এপিএস’। 

রুমে থাকা লোকটি তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন, ‘এটারে দিয়ে কোন কাজ হবে না, চোখ তুলে কোথাও ফেলে দে’।

কথাটা শুনে মনে ভীষণ ভয় পেলাম। বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে এমন ঘটনাতো অহরহ ঘটছে।

যাক, ওখান থেকে রুমে ফিরিয়ে আনা হলো। এশার নামাজ আদায় করার পরপরই সেবাদানকারী একজন লোক রাতের খাবারের প্লেটটি হাতে নিয়ে রুমে ঢুকতে ঢুকতে খুবই হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল, ‘স্যার, সুখবর আছে। শুনলাম আপনাকে ছেড়ে দিবে’। 

‘ছেড়ে দিবে’ কথাটা শুনে মনে একটু ভালো লাগলেও অজানা আতঙ্কে ভয়ও পাচ্ছিলাম। সন্ধ্যায় শুনলাম লোকটা বললেন, ‘চোখ তুলে কোথাও ফেলে দে’। এখন শুনছি ‘ছেড়ে দিবে’। ‘চোখ তুলে ফেলে দেওয়া‘ এবং ‘ছেড়ে দেওয়া‘ এই দুই এর সাথে সামঞ্জস্য কি, ভাবছি। তবে এত দিনের নির্যাতনের তীব্রতা ও জিজ্ঞাসাবাদের ধরন দেখে মনে হয় না এত সহজে ছেড়ে দিবে।

রাত যতই বড়ছে, গুজব ততই ঘনীভূত হতে লাগলো। এক পর্যায়ে সেবাদানকারী লোকগুলো আমাকে বললো, ‘স্যার, আপনাকে ছেড়ে দিবে, তবে মুচলেকা দিতে হবে যে আপনাকে কোন নির্যাতন করা হয় নাই’। প্রস্তাব শুনে হাসিই পেল। আমার শরীরের নিচের অংশ-কোমড়ের নিচ থেকে পায়ের পাতা কোথায়ও বিন্দুমাত্রও স্থান নেই যেখানে নির্যাতনের চিহ্ন নেই। চামড়া ফেঁটে রক্ত বের হচ্ছে, হাঁটুর নিচের লম্বা হাড়টায় ব্যাথা অনুভব করছি। পায়ের হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ফুলে আছে। রাত ও দিন সবসময় পায়ের নিচে বালিশ দিয়ে উচু করে রাখতে হয়। ওদের চিকিৎসকরা নিয়মিত চিকিৎসা দিচ্ছেন। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করছি। নির্যাতনের ফলে জখমের মাত্রা এত বেশি ছিল যে ব্যাথানাশক ঔষধ সেবন করা সত্ত্বেও হাঁটতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। পায়ের উরু থেকে নিচে পায়ের পাতা পর্যন্ত ক্ষতস্থান এত খারাপ ছিল যে, পরবর্তীতে কয়েক মাস চিকিৎসা নিতে হয়েছিল এবং ক্ষতস্থানসমূহ কয়েক সপ্তাহ নিয়মিত গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ধুয়ে পরিষ্কার রাখতে হয়েছিল। এ ব্যাপারে আমি কৃতজ্ঞ ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতা জনাব মাহফুজুল হায়দার রোটন, জুয়েল, কাজল, কালামসহ আরো অনেকের কাছে। ওরা সকলেই ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতা। আমার গ্রেফতার হওয়ার কয়েকদিন আগে ওদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জেলখানায় গরম পানি কোথায় পাবো? ওরাই চৌকা (জেলখানায় রান্নাঘরকে চৌকা বলা হয়) থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় গরম পানি সংগ্রহ করে আমাকে সহায়তা করতো। এমনকি আমি কাশিমপুর কারাগারে থাকা অবস্থায় সেখানে আমার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সুবিধা না থাকায় আমাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রায় প্রতি শনিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলে রাখা হতো। সেখান থেকে পুলিশ ও কারারক্ষী প্রহরায় চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হতো। এক্ষেত্রে চিকিৎসা সহযোগিতা দেওয়ার জন্য প্রফেসর আবু নাসের রিজভী ভাই এর নিকট আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।

নির্যাতনের ভয়াবহতা সম্পর্কে আরো একটি ঘটনা বর্ণনা না করলেই নয়। জেলখানায় আসামি ও কয়েদিদের নিকট জেল সুপার বা জেলার পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাঁর সাথে কদাচিৎ দেখা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার জনাব আলী হায়দার সাহেব ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার বাসিন্দা। একদিন সকালে তিনি স্বশরীরে ৭ নং সেলে আমার কক্ষের সামনে এসে হাজির। আমি একটু আশ্চর্যই হয়েছিলাম। কুশলাদি বিনিময়ের পর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার পায়ের চিকিৎসা কেমন হচ্ছে? সার্বক্ষণিক দেখভাল করার জন্য একজন কারারক্ষী নিয়োজিত থাকবে। দিন বা রাত যে কোন সময় আপনার প্রয়োজনীয় জরুরী চিকিৎসার জন্য কারাগারের চিকিৎসকরা সহযোগিতা করবেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার হিসেবে আমি যখন সাব-জেলে মাননীয় নেত্রী (বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম তখন তিনি আমাকে আপনার চিকিৎসার খোঁজ নিতে বলেছেন এবং চিকিৎসার অবহেলায় আপনার পায়ে যাতে ‘গ্যাংগ্রিন’ না হয় অর্থাৎ পায়ে যেন পচন না ধরে, পা যেন কেটে ফেলতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন’। 

চলবে...

লেখক: ড. মোঃ আওলাদ হোসেন
ভেটেরিনারীয়ান, পরিবেশবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক কর্মী।


বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর