৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ১২:৪১

গভীর রাতে পুলিশের হাতে হস্তান্তর: আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতার

ড. মোঃ আওলাদ হোসেন

গভীর রাতে পুলিশের হাতে হস্তান্তর: আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতার

ড. মোঃ আওলাদ হোসেন

অফিসিয়ালি সাদা কাগজে লিখিত মুচলেকাপত্র শেষ পর্যন্ত হাতে পেলাম। বিনা বাক্য ব্যয়ে মুচলেকাপত্রে স্বাক্ষর করে ফেরত পাঠালাম। গভীর রাতে যথারীতি চোখ বেঁধে, হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আমাকে সাথে নিয়ে কয়েকজন বেরিয়ে পড়লো। ঘণ্টাখানেক গাড়ি চলার পর তারা থেমে পরলো, আমার হ্যান্ডকাফ খুলে গাড়ি থেকে নামিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দিল। আমি দেখলাম, আমার ধানমন্ডিস্থ বাসার গেইটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি। গেইট খুলে ভিতরে প্রবেশ করলেই আমার স্ত্রী ও দু‘কন্যার সাক্ষাৎ পাবো। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। পরক্ষণেই অন্য একজন লোক অপেক্ষাকৃত পাতলা একটি কালো কাপড় দিয়ে আবারও আমার চোখ বেঁধে দিয়ে হ্যান্ডকাফ পরালো।

আবারও আমাকে অন্য একটি গাড়িতে তুলে তারা রওয়ানা হলো। চোখের বাঁধন দেওয়া কাপড়টি অপেক্ষাকৃত পাতলা হওয়ায় আবছা আবছা বুঝা যাচ্ছে কয়েকজন পুলিশসহ পুলিশের পিকআপের পিছনে বসে আছি। মনে হচ্ছিল রাস্তা খুবই ফাঁকা, গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটে চলছে। বেশ কিছুক্ষণ ছুটে চলার পর গাড়ি যেখানে থামলো সেটা ছিল ক্যান্টনমেন্ট থানা। আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দিল, কয়েদখানায় প্রবেশ করানোর সময় হ্যান্ডকাফও খুলে দিল।

রাত থেকে ভোর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-এর অসংখ্য নেতাকর্মীকে এখানে ধরে আনা হয়েছে। জনাব সালমান এফ রহমান, কাজী জাফরউল্লাহ, মহিউদ্দিন খান আলমগীর, নাজমুল হুদা, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, পংকজ দেবনাথ, জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু, গুলশানের কমিশনার কাইয়ুম, আমার সাথে গ্রেফতার হওয়া মাহমুদুল হাসান বাবুল, ডাকসুর সাবেক সদস্য স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রাজ্জাকসহ অসংখ্য রাজনৈতিক নেতাকর্মী। কয়েদখানায় স্থান সংকুলান হচ্ছে না। সালমান এফএম রহমান, কাজী জাফরউল্লাহ, মহিউদ্দিন খান আলমগীর, নাজমুল হুদা, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ সিনিয়র নেতাদের রাখা হয়েছে থানার বিভিন্ন পুলিশ অফিসারদের কক্ষে। 

রাত শেষে ভোর হয়েছে, আমার পা ফুলে বালিশের মত হয়ে আছে। JIC-এর কর্তব্যরত ডাক্তারদের দেওয়া ঔষধ সংগে আনা হয়নি। ফলে গতরাতে Antibiotics গ্রহণ করা হয়নি। আমাদের মধ্যে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে নিজ নিজ পরিবার পরিজনদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। আমিও একজন পুলিশ কনস্টেবলের সহযোগিতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চিকিৎসক প্রফেসর আবু নাসার রিজভী ভাইকে ফোন করে আমার পায়ের অবস্থা জানিয়ে বললাম, ‘Antibiotics ও ব্যাথানাশক ঔষধ জরুরি প্রয়োজন’। রিজভী ভাইকে আরও বললাম, ‘গত ৩১ জানুয়ারি থেকে আমার বাসার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমার বৃদ্ধা মা সহ বাসার সকলে নিশ্চয়ই খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। দয়া করে আমার বাসায় একটা ফোন করবেন প্লিজ’। উত্তরে তিনি বললেন, ‘টেনশন করবেন না, আমি এখনই রওয়ানা হয়ে আপনার কাছে আসছি। আপনার বাসায় ফোন করে জানিয়ে দেবো’।

সকাল ৭টার দিকে ডাঃ রিজভী ভাই সকালের নাস্তা নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানার কয়েদখানার দরজায় এসে হাজির। চোখে পানি এসে ছলছল করছিল। এই বিপদে একজন আপনজন রাজনৈতিক বন্ধু সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে এসেছেন। তিনি আমার পা পরীক্ষা করে ‘আমি ঔষধ নিয়ে আসছি’ বলে বেরিয়ে গেলেন। কয়েদখানায় প্রায় পঞ্চাশোর্ধ সংখ্যক লোক রয়েছে। এতজন মানুষের জন্য কয়েদখানার এক কোনে একটি কমোড রয়েছে। সামান্য ফাঁকা রেখে চারিদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা, পানি ব্যবহার করার জন্য একটি ‘বদনা’ রয়েছে। একে একে প্রায় সকলেই টয়লেট ব্যবহার করাতে এক পর্যায়ে ময়লা উপচে পরেছিল। ময়লার গন্ধে রুমে থাকাটা কষ্টকর হয়ে পরেছিল। কিন্তু মোটা লোহার রড দিয়ে তৈরি দরজা তালাবদ্ধ। 

ঘণ্টাখানেক পরে আমার পায়ের জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধ নিয়ে ডাঃ রিজভী ভাই হাজির হলেন। ঔষধ সেবন করার নিয়মাবলী বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, এমনি সময় আমার ছোট ভাই মোজাম্মেল ও মেয়ে দু'টি সাথে নিয়ে আমার স্ত্রী স্বর্ণা হাজির। আমাকে দেখে স্ত্রী ও ছোটভাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। আমিও নিজেকে সামলাতে পারলাম না, অঝোরে কাঁদছিলাম। আমার স্ত্রী জানালো, আমাদের সাথে গ্রেফতার হওয়া সরোয়ার ভাই আগেই মুক্তি পেয়েছেন। সরোয়ার ভাইয়ের নিকট থেকে আমার গ্রেফতার হওয়ার বিবরণ আগেই পেয়েছিল। উভয়ের আনা নাস্তাগুলো কয়েদখানায় অবস্থানরত রাজনৈতিক কর্মীরা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে খেয়ে নিলাম। ডা. রিজভী ভাইসহ সকলেই একে একে চলে গেল। আমার স্ত্রীকে বললাম, ‘ওরা নিশ্চয়ই আমাকে জেলখানায় পাঠিয়ে দিবে। কতদিন থাকতে হবে জানি না। প্রয়োজনীয় কাপড় ও জিনিসপত্রসহ একটি লাগেজ মোজাম্মেলকে (ছোট ভাই ) দিয়ে পাঠিয়ে দিও। পায়ের জুতা কখন হারিয়ে গেছে জানি না, এ কয়দিন খালি পায়ে থাকতে হয়েছে। একজোড়া সেন্ডেলও পাঠিয়ে দিও’।

থানার পুলিশ অফিসাররা সকলেই খুবই ব্যস্ত। আসামিদের সংখ্যা অনেক। সকলেই রাজনৈতিক নেতা, রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রচলিত আইন অনুযায়ী সকল আসামিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সুনির্দিষ্ট মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করতে হবে। সকলেই ব্যস্ত মামলা তৈরির কাজে।

চলবে...

লেখক: ড. মোঃ আওলাদ হোসেন
ভেটেরিনারীয়ান, পরিবেশবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক কর্মী।

 

বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর