১৬ মার্চ, ২০২১ ২০:১৬

করোনার টিকা নিয়ে সংশয়, রক্ত জমাট বাধার ভিত্তি কতটুকু?

ড. মোহাম্মাদ সরোয়ার হোসেন, ড. রেজাউল করিম

করোনার টিকা নিয়ে সংশয়, রক্ত জমাট বাধার ভিত্তি কতটুকু?

ফাইল ছবি

এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনার কারণে বিশ্ব স্থবির হয়ে আছে। এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১২ কোটি মানুষ নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত হয়েছে এবং ২৬ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে কোভিডের কারণে। এই অস্বাভাবিক ও অজানা অবস্থা মোকাবিলা করার পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা বিশ্বের নেই। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী পন্থার মধ্যে ভেকসিনেশনকে অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়। একটি নতুন টিকা বাজারে আসতে ৫ থেকে ১০ বছর সময় প্রয়োজন। কিন্তু বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টার কারণে আশাতীতভাবে এক বছরের মধ্যে ৪টি ভেকসিন জরুরিভিত্তিতে অনুমোদন পেয়েছে। এত অল্প সময়ে বাজারে আসার কারণে যেকোনো সময়ের চেয়ে টিকার কার্যকারিতা ও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত উৎকণ্ঠা থাকা স্বাভাবিক এবং তা এথিক্সেরই অংশ।

সম্প্রতি অক্সফোর্ড-এট্রাজেনেকার টিকার সন্দেহজনক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। নরওয়ে সর্বপ্রথম রক্তজমাট বাধার (thromboembolic event) কয়েকটি সন্দেহজনক কেইসের ওপর ভিত্তি করে টিকাদান কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করে। এরপর ইতালি, আইসল্যান্ড, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, নেদারল্যান্ডস, থাইলান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশ সাময়িকভাবে অক্সফোর্ড-এট্রাজেনেকার টিকার কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে্ 

রক্তজমাট বাধার কেইসগুলো কি কোভিডের টিকার কারণে হয়েছে? 

অত্যন্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে যে, রক্তজমাট বাধা বিশ্বব্যাপী একটি স্বাভাবিক ঘটনা। প্রসংগত, আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের তথ্যানুযায়ী, শুধু  আমেরিকাতে প্রতি ১০০০ জনে এক বা দুইজনে রক্তজমাট বাধার ঘটনা ধরা পড়ে। আর প্রতিবছর ৬০ হাজার থেকে এক লাখ মানুষ (মূলত বয়স্ক) মারা যায় এই রক্তজমাটা বাধার ঘটনায়।     
 
ইউরোপে এ পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ অক্সফোর্ড-এট্রাজেনেকার টিকা নিয়েছে। এর মধ্যে  রক্তজমাট বাধার (thromboembolic events) ঘটনার পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় বৃদ্ধি পায়নি। গত ৮ মার্চ পর্যন্ত ইউরোপে মোট ৩৭টি রক্তজমাট বাধার ঘটনা ঘটেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই ৩৭টি ঘটনা স্বাভাবিকের চেয়েও কম। আরেকটি বিষয় হচ্ছে যে, ফাইজার-বায়োনটেক এবং মডার্নার টিকার ক্ষেত্রে মোটামুটি একই হারে রক্তজমাট বাধার ঘটনা ঘটেছে।  

যদিও এখন পর্যন্ত টিকার সাথে রক্তজমাট বাধার কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে। এ জন্য দু-সপ্তাহের মতো সময় লাগতে পারে। প্রসঙ্গত, নেদারল্যান্ডস যে স্থগিত ঘোষণা করেছে, সেটি মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য। বহুল ব্যবহৃত যেকোনো মেডিসিন (যেমন প্যারাসিটামল, এটনাসিড)  ১০০ ভাগ রিস্কমুক্ত নয়। সেভাবে ভ্যাকসিনেও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া কিছুটা থাকবে তা স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য। করোনায় সারাবিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৮০০০-১০,০০০ লোক মারা যাচ্ছে। সেই অনুপাতে টিকার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত কেউ মারা যায়নি। ব্লুমবার্গের রিপোর্ট অনুযায়ী সারাবিশ্বে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৮ কোটি কোভিডের টিকা দেওয়া হয়েছে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, রক্তজমাট বাধার বিষয়টি এখন পর্যন্ত টিকার সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। এটিকে একটি র‌্যান্ডম বিষয় হিসেবে মনে করছে ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি। 

অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন কি নিরাপদ?

অসুস্থ মানুষের চিকিৎসায় মেডিসিন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু টিকা দেওয়া হয় সুস্থ মানুষকে। তাই টিকার সেফটি ইস্যুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে ড্রাগ রেগুলেটরিবডিগুলো এই বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকে। ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সির ফার্মাকো-ভিজিলেন্স রিস্ক এসেসমেন্ট কমিটির (পিআরএসি) তথ্যানুযায়ী রক্তজমাট বাধার ঘটনা স্বাভাবিক হারের চেয়ে বেশি নয়। সে কারণে এখন পর্যন্ত তারা অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার টিকাকে নিরাপদ মনে করছেন। 

টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মনিটরিং বডি নিবিড়ভাবে যে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে তা সাম্প্রতিক ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই ধরনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ নিশ্চিত করে যে, কোভিড ভ্যাকসিন এখন পর্যন্ত নিরাপদ।

লেখক:  ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন, জনস্বাস্থ্য গবেষক, নির্বাহী পরিচালক, বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউণ্ডেশন, বাংলাদেশ এবং সহযোগী অধ্যাপক, ইন্ডিপেনডেন ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ

ড. রেজাউল করিম, ইমিউনোলজিস্ট ও বিশেষজ্ঞ ড্রাগডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি এফেয়ারস, WHO-Utrecht Centre of Excellence for Affordable Biotherapeutics, The Netherlands এর প্রাক্তন প্রজেক্টলিডার এবং সায়েন্টিস্ট, বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ

বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ


 

সর্বশেষ খবর