২৫ মার্চ, ২০২১ ১১:৫৭

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ; মুজিব থেকে হাসিনা

এফ এম শাহীন

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ; মুজিব থেকে হাসিনা

এফ এম শাহীন

বঙ্গোপসাগর উপকূলের নদী বিধৌত উর্বর ভূমির বাংলাদেশ ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে অতি প্রাচীনকাল থেকেই স্বতন্ত্র এক ভূখণ্ড। এই ভূখণ্ডের আত্মমর্যাদাসম্পন্ন সচেতন জনগোষ্ঠী বাঙালি- ভাষার অধিকার, জাতির স্বীয় সত্তা ও জনগণের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভূত। একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ডের প্রশ্নে বাংলাদেশের জনগণের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উন্মেষ ঘটাতে অনবদ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ২৬শে মার্চ বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে সোচ্চার হয় বাঙালি। শত্রুর ভয়াল থাবাকে নির্ভীকচিত্তে প্রতিহত করতে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি বাহিনীর করাল গ্রাসের সাথে অকুতোভয় লড়াই করে ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর বেদনা নিয়ে বাঙালি দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রাম শেষে পরাজিত করতে সমর্থ হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। একে একে পঞ্চাশটি বছর পেরিয়ে আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর লগ্নে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। 

সুদীর্ঘ এই সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতি বঙ্গবন্ধুকে হারানো, দেশের ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড। তবে অর্জনের তালিকা নেহাতই ছোট নয়। কারণ, ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বাঙালির অধিকার আদায়ে সোচ্চার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান '৪৮ থেকে '৫২ পর্যন্ত লড়াই করে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা, '৫৮ এর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, '৬৬ তে বাঙালির বাঁচার দাবি ছয় দফা আন্দোলন, '৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১১ দফা দাবির ভিত্তিতে '৭০ এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়ে বাঙালির হাতে তুলে দেন স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ। '৭১ এর পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত তাঁরই সুশাসনে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়ায়। তবে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ তাঁর হাতেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি, ঘাতকদের কালো থাবা কেড়ে নেয় বাঙালির পরম বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের প্রাণ। তবে সেই প্রাণ চলে নিরন্তর, অন্য প্রাণে উৎসারিত হয়ে। জাতির পিতা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই সোনার বাংলায় তাঁর বাংলাদেশকে পৌঁছে দিতে এই অভিযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন তারই সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।

একাত্তর পরবর্তী  সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ ভঙ্গুর অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ায় বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। স্বাধীনতার উষালগ্নে বাংলাদেশকে যেতে হয় এক অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বুদ্ধি প্রজ্ঞার শাণিত হস্তক্ষেপে জনসাধারণের অন্ন-বস্ত্র সমস্যার সমাধান, কৃষি-শিল্পখাতে উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করা থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রনীতিকেও সবল করে তোলেন। বঙ্গবন্ধু পুনর্বাসন ও পুর্নগঠন প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে যে সাফল্য অর্জন করেছিলেন, ঢাকায় জাতিসংঘ রিলিফ অপারেশন দল তাদের রিপোর্টে তা উল্লেখ করেন।" বাংলাদেশ: ক্ষয়ক্ষতির ও পুনর্গঠন সংক্রান্ত জরিপ" ( তথ্যপত্র নম্বর-১৭, আনরড) রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলে এই দেশ "দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে নিপতিত হয়নি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত সরকারি কর্মপ্রচেষ্টা অপরিহার্য পরিণতি হিসেবে বাংলাদেশ একটি সুশৃঙ্খল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে।' 

বাংলাদেশের শান্তি-সমৃদ্ধির পথকে সংকুচিত করতে একদল ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতক ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট রাতের আঁধারে বাংলা ও বাঙালির পরম বন্ধু জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। থেমে যায় বাংলাদেশের উন্নয়নের চাকা। এরপর সুদীর্ঘ একটা বন্ধ্যা সময়- ক্ষমতার পালাবদল, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম, লুটতরাজের অবাধ বিচরণ, ভরাডুবিতে  বাংলাদেশ এই সবই হয়ে যায় বাস্তব প্রেক্ষাপট।  '৭৫ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে স্বদেশের মাটিতে দীর্ঘদিন আসতে দেয়নি ঘাতকচক্র। আওয়ামী লীগ ১৯৮১ সালে সর্বসম্মতিক্রমে শেখ হাসিনাকে তার অনুপস্থিতিতে দলের সভাপতি নির্বাচিত করে। ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষ করে অবশেষে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। তিনি ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ ও ১৯৯১-১৯৯৫ পর্যন্ত বিরোধী দলের নেতা এবং ১৯৯৬-২০০১পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে জনগণের বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসেন। ২০১৪ সালে তৃতীয়বারের মতো এবং ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি বাংলার হাল ধরে আছেন পরম বিশ্বস্ততার সাথে। উন্নয়নের মূলমন্ত্রে শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশকে উজ্জীবিত করে রেখেছে।

শেখ হাসিনার সুশাসনের এই সময়কালে রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথেই বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি ৮০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তৈরি পোশাকে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ। ৪০ লাখের বেশি শ্রমজীবী এ খাতের পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। ইতিমধ্যেই অর্থনৈতিকভাবে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। একসময় বৈদেশিক অনুদান ও ঋণ ছাড়া মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন অকল্পনীয় ছিল। এখন আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা বহুমুখী সেতুর মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণ ঘটেছে। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এ তিনটি সূচকের যে কোন দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদণ্ডেই উন্নীত হয়েছে। ক্ষুদ্র আয়তনের একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সারা বিশ্বের নিকট প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র দূরীকরণে তার ভূমিকা, জনবহুল দেশে নির্বাচন পরিচালনায় স্বচ্ছ ও সুষ্ঠুতা আনয়ন, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের ইতিবাচক পরিবর্তন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদণ্ড অনুযায়ী একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তার থেকে অনেক বেশি অর্থাৎ ২০৬৪ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দমমিক ৯। ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ - যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস’। সরকারের রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের এটি একটি বড় অর্জন। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে-  যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছে।

উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় স্বাধীনতার ৫০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে কীভাবে বাংলাদেশ দ্রুতগতিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মতো সফলতা দেখিয়েছে। জাতির পিতা কীভাবে সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতার জন্য একতাবদ্ধ করেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে কীভাবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব, দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানীমুখী শিল্পায়ন, ১০০ টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রপ্তানী আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ। এই বিষয়ে দেশবাসীর প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদাত্ত আহ্বান, ‘আসুন দলমত নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে বাংলার হাল ধরে আছে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। তার অদম্য প্রচেষ্টায় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আনন্দলগ্নে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা- অপার সম্ভাবনার জাদুকরী দুয়ার খুলে।

লেখক : সম্পাদক, ডেইলি জাগরণ ডট কম
সাধারণ সম্পাদক, গৌরব '৭১

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর