২৯ মে, ২০২১ ১১:৫৯

দেশের আকাশে মিথেন গ্যাসের ধোয়া নিয়ে প্রচারণা কৃষিখাত ধ্বংসের সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র

ড. মোঃ আওলাদ হোসেন

দেশের আকাশে মিথেন গ্যাসের ধোয়া নিয়ে প্রচারণা কৃষিখাত ধ্বংসের সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র

ড. মোঃ আওলাদ হোসেন

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সময়ে বাংলাদেশে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। বর্তমানে (২০২১ সালে) প্রায় ১৮ কোটি। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আবাসন, শিল্পকারখানা স্থাপন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নগরায়ন, রাস্তাঘাট নির্মাণ ইত্যাদির প্রয়োজনে দেশের আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রতিনিয়তই কমছে। এছাড়া নদী ভাঙনের ফলেও প্রতি বছর হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার কারণে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তাছাড়া একই কারণে ফসলি জমিও নষ্ট হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে খাদ্যের চাহিদা। কিন্তু মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কৃষি বিজ্ঞানীদের নতুন জাত উদ্ভাবন এবং কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশ খাদ্যে আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। 

চলমান করোনা কালে World Food Program (WFP) অনুমান করেছিল ‘করোনা সংকট মোকাবেলায় লকডাউনের কারণে কৃষিতে উৎপাদন কম হবে, ফলে বিশ্বে ৩ কোটি মানুষ অনাহারে মারা যেতে পারে‘। বাংলাদেশে WFP-এর অনুমান ভুল প্রমাণিত হয়েছে। করোনা সংকটে বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে যাচ্ছে এবং চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং তা উদ্বৃত্ত হয়েছে। বাংলাদেশে খাদ্য সংকট হয়নি। ঠিক এমনি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের Bloomberg পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের বরাত দিয়ে গত ১০ এপ্রিল ২০২১, Daily Star পত্রিকার প্রকাশিত সংবাদে আমরা অবগত হয়েছি যে, প্যারিসভিত্তিক কোম্পানী  Kayrros SAS দাবী করেছে, স্যাটেলাইট ইমেজে বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের ধোঁয়া শনাক্ত করেছে, এর উৎস সুস্পষ্টভাবে নিশ্চিত না হওয়ায় বিষয়টিকে ‘রহস্যময়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

Bluefield Technologies Inc. এর প্রতিষ্ঠাতা Yotam Ariel বলেছেন, ‘আমাদের গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশ সর্বোচ্চ মিথেন গ্যাস উৎপাদনকারী, Satellite image এ শনাক্ত হয়েছে।’

একই সংবাদে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, নিঃসরণের ট্র্যাকিং সংস্থা GHG Sat. Inc, এর president Stephanie Germain জানিয়েছেন, বাংলাদেশের আকাশে শক্তিশালী মিথেন গ্যাসের আবরণ শনাক্ত হয়েছে, তবে এই গ্যাসের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। 

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বর্নহীন, গন্ধহীন মিথেন গ্যাস বাতাসের সাথে মিশে আবরণ তৈরি করে সূর্যের আলো পৃথিবী থেকে প্রতিসরণে বাধার সৃষ্টি করে ভূপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে ও পরিবেশ-জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে।

বাংলাদেশ থেকে নির্গমনকৃত মিথেন গ্যাসের উৎস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সবুজ ধানক্ষেত, ময়লার ভাগাড়, ঢাকা শহরে জালের মত বিছিয়ে থাকা জ্বালানী গ্যাস সরবরাহকারী পাইপলাইনে অসাবধানতাবশতায় সৃষ্ট খুবই সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া গ্যাস। বাংলাদেশ থেকে নির্গমিত মিথেন গ্যাসের উৎস হিসেবে চিহ্নিত তিনটির মধ্যে একটি ‘সবুজ ধানক্ষেত‘। 

কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, সবুজ ধানক্ষেত থেকে নিঃসরিত মিথেন গ্যাসের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে খুবই নগন্য। অথচ তাদের প্রতিবেদনে আমাদের সবুজ ধানক্ষেতকেই টার্গেট করে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা বাংলাদেশের উন্নয়নের বিরুদ্ধে সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের প্রাথমিক উদ্যোগ বলেই মনে হয়।

বাস্তবতা হচ্ছে, গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলো, সবসময়ই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দোষারোপ করার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কেননা ধান উৎপাদনে বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ সাফল্য দেশে ও দেশের বাইরে অনেকেই ঈর্ষান্বিত হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। বিশেষ করে যারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সফলতায় ঈর্ষান্বিত ‌অথবা যারা বাংলাদেশকে ব্যর্থ এবং আজীবন পরনির্ভরশীল রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়, তারাই শুধু এ ধরনের নেতিবাচক প্রচারণায় ব্যস্ত। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষে ক্ষতিপূরণের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলোর নিকট দাবী জানাচ্ছিলেন, তাই তাঁর কন্ঠকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যও এই ষড়যন্ত্র হতে পারে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, এক কেজি ধান উৎপাদন করতে ধানগাছ থেকে ৬৬৬ গ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড, ৫৩ গ্রাম মিথেন এবং শূন্য দশমিক ৫ গ্রাম নাইট্রাস অক্সাইড নিঃসরিত হয় এবং একই সাথে এক কেজি ধান উৎপাদনে ধানগাছ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় ২ হাজার ২০০ গ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। এছাড়া নিঃসৃত মিথেন গ্যাস বায়ুমণ্ডলের জলীয়বাষ্পের সঙ্গে বিক্রিয়া করে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস ও হাইড্রোজেন গ্যাসে রূপান্তরিত হয় যা ধান ও অন্যান্য সবুজ গাছ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় গ্রহণ করে। একইভাবে নাইট্রাস অক্সাইড বায়ুমণ্ডলের জলীয়বাষ্পের সঙ্গে বিক্রিয়া করে অ্যামোনিয়াম ও হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন করে এবং এই অ্যামোনিয়াম বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে অ্যামোনিয়ায় রূপান্তরিত হয় এবং বৃষ্টির মাধ্যমে মাটিতে আসে, যা গাছ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রেও ধান গাছের অ্যারেনকাইমা চ্যানেল দিয়ে বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন ধান গাছের শিকড়ের মাধ্যমে মাটিতে আসে, যা মিথেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে মিথানোট্রফিক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন করে, যা গাছ গ্রহণ করে এবং এ প্রক্রিয়া বায়ুমণ্ডলে মিথেন নিঃসরণে বাধা দেয়। ফলে প্রতিয়মান হয় যে, ধান গাছ বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের চেয়ে অনেক বেশি শোষণ করে, বায়ুমণ্ডলকে পরিচ্ছন্ন করছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণায় শুধুমাত্র নিঃসরণের তথ্যটি খুব কৌশলে তুলে ধরে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে, যাহা ষড়যন্ত্র।

স্যাটেলাইট ইমেজে বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের যে ধোঁয়া শনাক্ত করেছে বলে দাবি করেছে জিএইচজিস্যাট ও কায়রোস, তার উৎস সুস্পষ্টভাবে নিশ্চিত না হওয়ায় বিষয়টিকে ‘রহস্যময়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আলোচিত মিথেনের সম্ভাব্য উৎস বাংলাদেশ বলা হলেও এসব গ্যাসের পরিমাণ ও ব্যাপ্তি বাংলাদেশের তুলনায় সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ, বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় অনেক গুণ বেশি। সুতরাং মিথেন গ্যাসের ধোঁয়া যেকোনো জায়গা থেকে বাংলাদেশের আকাশ সীমায় আসতে পারে।

দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সব দেশে ধান চাষ, জলাভূমি ভরাট ও কয়লার ব্যবহার জাতীয় কার্যক্রম কম-বেশি রয়েছে। বাংলাদেশে যেখানে একটিমাত্র কয়লা খনি আছে, সেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রায় ১ সহস্রাধিক এবং চীনে প্রায় ২ সহস্রাধিক কয়লা খনি আছে, যেগুলো মিথেন গ্যাসের অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। সুতরাং প্রতিবেদনটিতে বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের যথেষ্ট ঘাটতি আছে এবং সামগ্রিকভাবে এটি গ্রহণযোগ্য প্রতিবেদন হিসেবে বিবেচিত নয়। এ ধরনের বিশ্লেষণহীন অবৈজ্ঞানিক তথ্য প্রকাশ করা উদ্দেশ্য প্রণোদিত বৈ কিছু নয়। 

বাংলাদেশের জলবায়ু বিজ্ঞানীদের মতে, মিথেনের উৎস সম্পর্কে জানতে কার্বন আইসোটোপ বিশ্লেষণ জরুরি। সেটি না করে একটি দেশের বায়ুমণ্ডল নিয়ে এমন নেতিবাচক প্রচারণা জনমনে আতঙ্ক তৈরি করতে পারে।

করোনা সংক্রমণ রোধে দেশে এক বছরেরও অধিক সময় শিল্প-কারখানা বন্ধ প্রায়, শুধু কৃষিক্ষেত্রই একমাত্র স্বাভাবিক গতিতে চলমান রেখে খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা হচ্ছে, সেখানে এ ধরনের প্রচারণা প্রকারান্তরে কৃষিকেই পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী করা হচ্ছে, যা খুবই দুঃখজনক। কৃষি সম্পর্কে এমনি একটি নেতিবাচক প্রচারণা, পরিবেশ দূষণের অজুহাত দেখিয়ে ধান চাষ কমিয়ে খাদ্য সংকট তৈরি করে বাংলাদেশকে পরনির্ভরশীল করার সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র। যা প্রকারান্তরে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষে ক্ষতিপূরণের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলোর নিকট যে দাবি জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, সেই কন্ঠকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য শিল্পোন্নত দেশসমূহকে মোক্ষম সুযোগ তৈরি করে দেয়ার একটি অপচেষ্টা।

বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশেষ করে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রধান খাদ্য চাল উৎপাদন এর কোনো নেতিবাচক বিষয় নিয়ে লেখার আগে অবশ্যই সবাইকে এর  পেছনের  উদ্দেশ্য এবং সুদূরপ্রসারী কুফল ভেবে দেখতে হবে। গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ন্যায় যেকোনো নেতিবাচক বিষয় নিয়ে প্রচার-প্রচারণার আগে সেটি বিজ্ঞানসম্মত ও তথ্যনির্ভর কিনা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের জন্য প্রয়োজনে যারা এ-সংক্রান্ত গবেষণা করেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রকৃত তথ্য উপস্থাপন করাই সমীচীন, অন্যথায় দেশের বড় ক্ষতি হতে পারে।

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর