২ জুলাই, ২০২১ ১৫:৫৮

এমন নিঃস্বার্থ মানুষই তো আমাদের দরকার

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

এমন নিঃস্বার্থ মানুষই তো আমাদের দরকার

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী। ফাইল ছবি

একটা হারিয়ে যাওয়া সময়ের কথা, খুব বেশি দিন আগের কথা না। তবে অনেকটা পেছনে ফেলে আসা দিনের কথা। তখন নুন আনতে পান্তা ফুরানো মানুষরা মাটির ব্যাংকে কাঁচা পয়সা  জমাতো। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যা উপার্জন করতো তার যৎসামান্য এই ব্যাংকে জমাতো। প্রতিদিন এই মাটির ব্যাংকটাকে ঘিরে কত স্বপ্ন বুনেছে মানুষ। ব্যাংকটা ভাঙলে এটা করবে, ওটা করবে আরও কত কী। কিন্তু ব্যাংকটা ভাঙার সাথে সাথে স্বপ্নগুলো যেন ভেঙে গেছে। সময় যত গড়িয়েছে মানুষের কাছে মাটির ব্যাংকের কদর ততই কমেছে। এর সাথে কপাল পুড়েছে কুমোরদের। কাদামাটিকে হাতের জাদুতে যেমন চাইতো তেমন রূপ দিতে পারতো। একটা শৈল্পিক মনও তখন বেঁচে ছিল তাদের। সব যেন ভাগ্যের দোষ। তবে ভাগ্য মানুষের কপালে থাকে না, ভাগ্য থাকে মানুষের কর্মে। সেটা হতে পারে সুকর্ম, কুকর্ম কিংবা কৃতকর্ম। প্রযুক্তির যত হাত পা গজিয়েছে  মানুষের সাদাকালো জীবনটা তত রঙিন হয়েছে। যে রঙে না আছে স্বাদ, না আছে গন্ধ, না আছে সৌন্দর্য, যা হবার তাই হয়েছে। ইট পাথরের মানুষ সেই চিরচেনা অভূতপূর্ব শক্তি হারিয়েছে।

মরা নদীর মতো মানুষের মনটাও মরে গেছে। সে মরা মনে না আছে  জীবনের বৈচিত্র্য, না আছে উত্তাল স্রোতধারা, না আছে স্বপ্ন ছোয়ার আকুতি। মানুষের ভেতরে মানুষের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না। দেখতে মানুষের মতো অথচ মানুষ নয়। মানুষের ভেতর খুব সন্তর্পণে কী যেন একটা ঢুকে পড়েছে। কী যে সেটা বোঝাটা খুব কঠিন হয়ে গেছে। হয়তো অদৃশ্য কোনো শক্তি, যেটা মানুষের মধ্যে থাকার কথা ছিল না, সেটাই মানুষের ভেতরে জন্মেছে। অনেকটা আগাছা-পরগাছার আধিপত্যে হারিয়ে যাওয়া ফসলের মতো, যেখানে আমি আছি অথচ আমাকে কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। সেই খুঁজে না পাওয়া কী যেন একটার অভাববোধই হচ্ছে পুরোনো সেই মাটির ব্যাংকটার মতো, কুমোরদের মতো। যেখানে মানুষের স্বপ্ন ছিল, সৃষ্টি ছিল, একটা সাধাসিধা মানুষের  ভেতর অসাধারণ জীবনবোধের শক্তি ছিল। এখনকার মানুষ হারাতে জানে, খুঁজে পেতে জানে না। যেমন মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়েছে, তাকে খুঁজে পায়নি। কারণ, সেটা যে খোঁজার মতো মহামূল্যবান একটা উপাদান তার বোধ মানুষের মধ্যে আর নেই। 

‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’। আমি মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানোর জায়গা থেকে এমন কথা বলছি না বরং মানুষ এমন একটা অবস্থানে পৌঁছেছে যেখানে মানুষ আর মানুষ থাকছে না। সে ধরনের মানুষের কথা বলছি। কারণ, তারা  দেখতে মানুষের মতো হলেই তাদের সবার মধ্যে মানুষ বাস করছে না। দেশের টাকা দেশে থাকছে না। কেউ কেউ এতটা টাকা লুটেছে যে তা দেশের ব্যাংকগুলোতে রাখার সাহস পাচ্ছে না। কারণ, সেই টাকা যদি দেশের ব্যাংকগুলোতে রাখতো তবে দেখা যেত তার আয়-উপার্জনের চেয়ে সেই টাকার অংক অনেক বেশি। কতগুণ বেশি। অনেকগুণ বেশি। যেটা যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ দিয়ে মেলানো সম্ভব না। এটাই কালো টাকা। দেখতে সাধারণ মানুষের হাতে থাকা টাকার মতোই কিন্তু টাকাটা সাদা নয়, কালো টাকা। এখানে রং পাল্টে টাকা কালোবর্ণের হয়নি, বরং যে টাকা মানুষ অবৈধভাবে লুটেছে সে টাকাটাই কালো টাকা। টাকা তো টাকাই, যেমন মানুষ তো মানুষই। আবার এই টাকাই হয়ে যায় কালো টাকা, এই মানুষরাই হয়ে যায় অমানুষ। কেমন করে যেন টাকার পাখা গজায়। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে উড়ে উড়ে সে টাকা চলে যায় দেশ ছেড়ে বিদেশে। এটাই টাকা পাচার। না আছে সেখানে মাটির ব্যাংকের হাবাগোবা চেহারা, না আছে সেখানে দেশের ব্যাংকে টাকা রাখা আমজনতার সরলতা।

আচ্ছা এই টাকা পাচারকারীদের আমরা কি চিনি? হয়তো চিনি। হয়তো চিনি না। কারণ, আর দশটা মানুষের মতোই তো মানুষ তারা। আমরা এমন কজনের খোঁজ জানি। যাদের খোঁজ জানি তাদেরই বা কী করতে পারি। সব যে গোলকধাঁধার খেলা। কতজন যে এই টাকার বস্তা মাথায় নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমালো, জমাচ্ছে, জমাবে তার খবর কি আমরা রাখি? বিদেশে বাড়ি গাড়ি আরও কত কী তাদের। খবরের পাতায় কিছু খবর হয়তো আসে। সবকিছু তখন সরগরম হয়। নড়েচড়ে বসে। তারপর খেলার পেছনে খেলা চলতে চলতে একসময় তা হারিয়ে যায়। অদৃশ্য হাত বাড়তে বাড়তে অদৃশ্যই থেকে যায়। এই মানুষগুলো কি দেশপ্রেমিক নাকি দেশদ্রোহী? এখনও তো  আমরা সে দেশদ্রোহীদের তালিকা করতে পারেনি। তাদের বিদেশ থেকে ধরে এনে আইনের হাতে সোপর্দ করতে পারিনি। তারা কি তবে ধরা ছায়ার বাইরে? আমি এটা বিশ্বাস করি না। কারণ, আমি ইতিবাচকতাকে বিশ্বাস করি। এই দেশদ্রোহীদের তালিকাটা দেশের আনাচে কানাচে থাকা দরকার, মানুষদের তাদের চিনতে হবে। মানুষদের বুঝতে হবে দেশদ্রোহীদের প্রতি কোনো ধরনের ক্ষমা প্রদর্শনের সুযোগ নেই। এটাই তো সময়ের দাবি, জীবনবোধের দাবি, মানবিক মূল্যবোধের দাবি। এই দেশদ্রোহীদের বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর ও মোশতাকদের মতো ঘৃণার পাত্রে পরিণত করতে হবে। তাদের শাস্তি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। খুব কঠিন শাস্তি, যাতে মানুষ বুঝতে পারে, দেশদ্রোহী হয়ে কেউ পার পাবে না।

আমি দেশপ্রেমিক মানুষদের কথা ভাবছি। যারা দেশের মাটিতে বুক আগলে রেখে প্রতিদিন সততার শক্তিতে জীবন গড়ছে। যারা নিজেদের শ্রমের ঘামে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে। পাওয়া না পাওয়ার টানাপোড়েনকে ভুলে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখছে। ত্যাগের মন্ত্রে উজ্জীবিত হচ্ছে। এমন নিঃস্বার্থ মানুষই তো আমাদের দরকার। যাদের চোখে দেশ আছে, দেশপ্রেম আছে আর মানুষ নামের মানুষ আছে।

বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর