৮ জুলাই, ২০২১ ১৮:৩৪
বহু প্রতিভার আকর মুম্বাই চলচ্চিত্র শিল্পে

প্রথম খান সাচ্চা দেশপ্রেমী

এম জে আকবর

প্রথম খান সাচ্চা দেশপ্রেমী

দিলীপ কুমার ও এম জে আকবর (ডানে)

জীবনও আসলে মৃত্যুর মতোই বৈচিত্র্যময়। হঠাৎ একটা দুর্ঘটনা, আমাদের কল্পনার বাইরে থাকা কোনো ঘুঁটির চাল এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটতে থাকা ঘটনা। যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না, আমাদের ভেবে রাখা সবকিছুকে ওলটপালট করে দেয়। আমাদের অজানা-অনিশ্চিতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। মুহাম্মদ ইউসুফ খানের যখন ২৮ বছর, তখন দেশ ভাগ হচ্ছিল। আর ওনার জন্মস্থান পেশোয়ার মুসলিম পাকিস্তানের মধ্যে পড়ে যায়। ইউসুফ খানের বাবা লালা গোলাম সারওয়ার খান অবশ্য ১৯৩০-এর দশকেই নিজের পরিবার নিয়ে মহারাষ্ট্রে চলে এসেছিলেন। তিনি ফলের ব্যবসা করতেন, পেশোয়ারে তাঁর ফলের বাগান ছিল। ইউসুফ খানের বাবা গর্ব করে নিজের নামের আগে লালা ব্যবহার করতেন, যা আসলে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি আর সমাজের ঐতিহ্যকে চেনাত। কিন্তু রাজনীতি ধীরে ধীরে এই বহুমাত্রিক সমাজে বিষ ছড়াচ্ছিল। আমরা স্কুলের বইতেও পড়ি যে ব্রিটিশরা ভারতে রেললাইন পেতেছিল। কিন্তু আমাদের স্কুলে এটা শেখানো হয় না, ওই একই রেললাইন দিয়ে ব্রিটিশরা আমাদের মস্তিষ্কে সাম্প্রদায়িকতার বীজ গেঁথে দিয়েছিল। 

কিশোর ইউসুফ যখন ফ্রন্টিয়ার মেইলে চড়ে যেতেন তখন প্রতিটা স্টেশনে শুনতেন চা-ওয়ালা হেঁকে বিক্রি করছে ‘হিন্দু চা’ আর ‘মুসলিম চা’। পেশোয়ার থেকে ঢাকা পর্যন্ত প্রতিটি জলের কলকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল, ‘হিন্দু জল’ আর ‘মুসলিম পানি’ বলে। অল্প বয়সে ইউসুফ খান বেশ কিছু কাজে হাত পাকানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কোনোটাতেই বিশেষ সফল হতে পারেননি। সবকিছু বদলে গেল যখন তাঁর সঙ্গে কিংবদন্তি নায়িকা দেবিকা রানী আর তাঁর স্বামী হিমাংশু রায়ের আলাপ হলো। হিমাংশু রায় তখন বোম্বে টকিজের মালিক। ইউসুফ খানের চেহারা, উচ্চারণ আর প্রতিভা দেখে বিস্মিত দেবিকা রানী এবং তাঁর স্বামী চলচ্চিত্রশিল্পে যোগ দিতে বলেন। কিংবদন্তি নায়িকা পেশোয়ারের যুবককে পর্দার জন্য আলাদা নাম নিতে পরামর্শ দেন, এমনকি নিজেই এই তরুণের জন্য কয়েকটি নামও ঠিক করে দেন। ইউসুফ খান বেছে নেন দিলীপ কুমার। দিলীপ কুমারের প্রথম সিনেমা ‘জোয়ারভাটা’ ফ্লপ ছিল। ১৯৪৯-এর স্মরণীয় ছবি আন্দাজ-এর আগ পর্যন্ত তিনি ভারতীয়দের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারেননি। আন্দাজ-এ দিলীপ কুমারের সহঅভিনেতা ছিলেন তাঁর বন্ধু, আরেকজন পেশোয়ারে জন্ম নেওয়া নায়ক রাজ কাপুর। 

১৯৪৭-এ যখন দেশ ভাগ হচ্ছে, তখন ইউসুফ খান জানতেন না দিলীপ কুমার কোনো দিন ভারতবর্ষে কিংবদন্তিতে পরিণত হবেন। কিন্তু নতুন তৈরি হওয়া দেশ তাঁর সামনে সুযোগ এনে দিয়েছিল। সদ্যোজাত পাকিস্তানের চলচ্চিত্রশিল্প মরিয়া হয়ে প্রতিভার অন্বেষণে ছিল। কিন্তু ১৯৪৭-এ পাকিস্তানের পরিবর্তে ভারতকে বেছে নেন। কারণ আরও অনেক মুসলিমের মতো তিনিও মনে করেছিলেন একটি নির্দিষ্ট ধর্মের দেশে থাকার পরিবর্তে বহু সংস্কৃতির ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে থাকলেই তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটবে। বহু প্রতিভার আকর মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রথম খান আসলে প্রথম দেশপ্রেমিকও ছিলেন। 

স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও কিন্তু আমাদের ১৯৪৭-এর পরিস্থিতি, তার চাপকে ভুলে গেলে চলবে না। পরিকল্পিত করে বাঁধানো দাঙ্গায় গোটা দেশ জ্বলছিল। ভারতের অন্য যে কোনো শহরের মতো মুম্বাইয়ের পরিস্থিতিও খারাপ ছিল। এবং মুম্বাইতে সব সম্প্রদায়ের মানুষ থাকতেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে পাকিস্তানের ভাবনাকে এমনভাবে বিক্রি করা হয়েছিল যেন কোনো স্বপ্নের দেশ তৈরি হতে চলেছে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ভাষা ছিল হিন্দকো আর পেশোয়ারে জন্ম নেওয়া দিলীপ কুমার সেই ভাষা চমৎকার বলতে পারতেন। তাই পাকিস্তানে চলে যাওয়ার ভাবনাই ইউসুফ খানের জন্য স্বাভাবিক ছিল। দিলীপ কুমার যে ভারতীয়ই থেকে গিয়েছিলেন, সেটা আসলে সব প্রলোভনকে অতিক্রম করে বিশ্বাস আর আদর্শের জয় ছিল। দিলীপ কুমারের কোনো দিনই রাজনীতিতে খুব আগ্রহ ছিল না, যদিও কংগ্রেস তাঁকে রাজ্যসভায় মনোনীত করেছিল। কিন্তু ভারতের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ছিল অতুলনীয়। আর এই দায়বদ্ধতার কারণ ছিল তিনি মনেপ্রাণে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সামাজিক সাম্য আর ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন। 

গত তিন দশকের তিন খান শাহরুখ, আমির আর সালমানকে সিনেমার জন্য কোনো আলাদা নাম নিতে হয়নি। কারণ আজকের ভারতীয়রা, যাঁরা এই শিল্পের দর্শক, তাঁরা ১৯৪০-এর দ্বিধা আর সংশয়ের সময়কে অতিক্রম করে গেছেন। এটাই তফাত গড়ে দিয়েছে। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ইউসুফ খানকে দিলীপ কুমার হতে হয়েছিল। শাহরুখ, আমির আর সালমানদের জন্ম ভারতীয়দের ভারতে। দিলীপ কুমার এই প্রথম পুরুষ অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান, আবার কোনো সিনেমায় অভিনয়ের জন্য ১ লাখ টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে রেকর্ড গড়েছিলেন। যদি ডেভিড লিনের প্রস্তাব লুফে নিয়ে তিনি লরেন্স অব অ্যারাবিয়াতে অভিনয় করতে রাজি হতেন, তাহলে দিলীপ কুমারও হয়তো আন্তর্জাতিক তারকা হয়ে যেতেন। সেই সুযোগ চলে যায় মিসরের ওমর শরিফের কাছে। দিলীপ কুমারকে এই যে ট্র্যাজেডি কিং বলা হয়, এতে অবশ্য আমার ঘোরতর আপত্তি আছে। যাঁরা আজাদ এবং কোহিনূর দেখেছেন, তাঁরা জানেন ওঁর প্রতিভা একমাত্রিক ছিল না। একাগ্রতাই ওই সাফল্যকে এনে দেওয়া আরেকবার মধুবন মে রাধিকা নাচে গানের সঙ্গে দিলীপ কুমারের সেতার বাজানোর দৃশ্যটা দেখবেন আর বুঝবেন দুই ঘণ্টার সিনেমায় পাঁচ মিনিটের গানের সিকোয়েন্সের জন্য যিনি সেতার শিখতে পারেন তিনি অভিনয়ের জন্য কোনো ধরনের পরিশ্রম বা অনুশীলন করতে পারতেন। প্রতিভাকে ধার দিতে হয় কঠোর পরিশ্রম দিয়েই। দিলীপ কুমার ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন। পবিত্র কোরআনে যেমন লেখা আছে, তিনি আল্লাহর কাছ থেকে এসেছিলেন, আল্লাহর কাছেই চলে গেলেন। কিন্তু তিনি নিজের জীবন দিয়ে একটা কথাই আমাদের বলে গেলেন। ভারতীয় মুসলিম দেশপ্রেমিক।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর