১৯ আগস্ট, ২০২১ ১৮:৪২

আফগান যুদ্ধ কি ব্যর্থ? মার্কিন যুদ্ধবাণিজ্য সে কথা বলে না!

ড. মঞ্জুরে খোদা

আফগান যুদ্ধ কি ব্যর্থ? মার্কিন যুদ্ধবাণিজ্য সে কথা বলে না!

ড. মঞ্জুরে খোদা

আফগান যুদ্ধে মার্কিনীদের পরাজয় ও ব্যর্থতার কথা শোনার পর থেকে আমার প্রায়ই মান্নাদে’র বিখ্যাত একটা গানের লাইন বার বার মনে পড়ছে। ‘তুমি অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছ, দিতে পারোনি, যদি বলি আমি কি হেরেছি, তুমিও কি একটুও হারোনি?’ বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক ও লেখক জন সোয়ার্জ তার এক কলামে মন্তব্য করেছেন, আফগান যুদ্ধে কি আমেরিকা পরাজিত হয়েছে? তাদের কোন অর্জন নেই? তিনি বলেছেন, মার্কিন রাজনীতির হিসেবে যাই থাকুক অন্তত আমেরিকার সর্ববৃহত পাঁচটি প্রতিরক্ষা ঠিকাদার কোম্পানী ও তাদের অংশীদারদের ক্ষেত্রে সে কথা বলা যাবে না। কারণ, যুদ্ধ থেকে তারা তাদের মুনাফা ধাবারাহিকভাবে ধরে রেখেছেন।  

১৮ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ নিতে যখন সামরিক শক্তি ব্যবহারের অনুমোদন করেন তখন আমেরিকার শীর্ষ ৫টি প্রতিরক্ষা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ছিল ১০ হাজার মার্কিন ডলার, তাদের সেই শেয়ারের দাম এখন ৯৭ হাজার ২৯৫ মার্কিন ডলার। তারমানে সেই ১০ হাজার ডলার ২০ বছরে ১০ গুন বেড়ে এখন ১ লাখ ডলারে পরিণত হয়েছে। গড়ে বাৎসরিক ৫ শতাংশ করে মুনাফা অর্জন করেছেন। তাদের অন্যান্যসহ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বেড়েছে আরো। এ আয় অনেক বেশী না হলেও- তাদের কোনভাবেই ক্ষতি হয়নি, বরং তাদের এ বিনিয়োগের উপর ধারাবাহিক দীর্ঘস্থায়ী রিটার্ন পেয়েছেন। আর কথিত এ পরাজয়ে তাদের শেয়ারের কোন দরপতন ঘটেনি। সেটা না হলে কিভাবে বলি তাদের শুধু ক্ষতিই হয়েছে? তারমানে আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধ বাণিজ্যে যে বিনিয়োগ করেছিল সে মুনাফা ঠিকাদার কোম্পানীগুলো তুলে এনেছেন। বৃহৎ মার্কিন প্রতিরক্ষা ঠিকাদার কোম্পানীগুলো হচ্ছে, বোয়িং, রেথিয়ন, লকহিড মার্টিন, নর্থ্রপ গ্রুমম্যান ও জেনারেল ডায়নামিক্স। আর এ সব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে আছেন অবসরপ্রাপ্ত শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা। যাদের কাজ যুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহে সাহায্য করা।  

আফগান যুদ্ধের খরচ নিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন ইন্সটিটিউট সম্প্রতি এক তথ্য প্রকাশ করেন। তাতে দেখা যায় এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ কোটি টাকা। ওয়াটসন ইন্সটিটিউটের ‘কস্ট অব ওয়ার’ প্রকল্পের প্রতিবেদনে বলা হয়, মোট খরচের প্রায় ১ লাখ কোটি ডলার মানে ৮৪ লাখ কোটি টাকা সরাসরি যুদ্ধ বাবদ খরচ হয়। আর এই যুদ্ধের অর্থ যোগানে যে ঋণ নেয়া হয় তার সুদ বাবদ খরচ হয় ৫৩ হাজার কোটি ডলার, মানে ৪ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা। আফগান সামরিক বাহিনীতে কর্মরত তিন লাখ সদস্যের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র ক্রয় বাবদ ২ দশকে খরচ হয়েছে ৮ হাজার ৮০৮ কোটি ডলার, মানে ৭ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা। 

এই বিপুর পরিমান অর্থের সংস্থান করাও হয়ে উঠছিল মার্কিনীদের জন্য কঠিন, উপরন্ত আফগানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতও ছিল অনিশ্চিত। আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া নানা প্রজেক্ট-প্রকল্পের মাধ্যমে শতগুন মুনাফা করবেন সে নকসাও কাজে লাগছে না। তখন চাল থাকে কত কম ক্ষতির মধ্যে দিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে আসা যায়। সে লক্ষ্যেই চলতে থাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তালেবানের সাথে মার্কিনীদের একটা শান্তিপূর্ণ বোঝাপড়ার দরবার। 

দীর্ঘ আফগান আগ্রাসনের পর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দোহায় এক শান্তিচুক্তির মাধ্যমে সেখান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারে সম্মত হয় যুক্তরাষ্ট্র। এর বিপরীতে আফগানিস্তানে কথিত শান্তি প্রতিষ্ঠা, মার্কিন বাণিজ্য ও স্বার্থ সংরক্ষনে সম্মত হয় তালেবান। তার অংশ হিসেবে এ বছর জানুয়ারিতে আফগান বিষয়ক মার্কিন বিশেষ দূত সালমাই খালিলজাদ এক ঝটিকা সফরে কাতারের দোহায় থাকা তালেবান নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করেন। একে আফগানিস্তানের শান্তি আলোচনার কথা বলা হলেও তা ছিল এক ধরণের বাণিজ্যিক বোঝাপড়া। এ বেঠকের কিছুদিন পর তালেবান মুখপাত্র শাহীন সুহেল এক বিবৃতিতে জানান, তারা প্রস্তাবিত ট্রান্সন্যাশনাল গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। ১০ বিলিয়ন ডলার ব্যায়ে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ নির্মাণ এই প্রকল্প একটি আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। যে কনসোর্টিয়ামের ৫৪ ভাগ শেয়ারের মালিক মার্কিন কোম্পানি ইউনিকল। শুরুতে এই প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে টানাপোড়েন চললেও এখন তা অনেকটাই মিটে গেছে বলে মনে করা হয়। 

এ সব হিসেবের পর এক কথায় এ সিদ্ধান্তে আসা কঠিন যে, মার্কিন সৈন্য আফগান ত্যাগের পর তালেবানের তৎক্ষনিক ক্ষমতা দখল মানে- এ যুদ্ধে মার্কিনীরা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে! এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সামরিক বিশ্লেষকের এক অংশ মনে করেন- এ যুদ্ধ মার্কিনের একটা অসাধারণ সাফল্য হতে পারে। 

এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র’ দেশে দেশে সামরিক ও বেসমারিক সাহায্য-সহযোগিতা, শান্তি, গণতন্ত্র, মানবতা ও উন্নয়নের নামে মুনাফাটাকেই প্রধান বিষয় হিসেবে দেখেন। ইরাক, লিবিয়া কোথাও এর ব্যতিক্রম নেই। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মার্কিন স্বার্থের ছোট-বড় যুদ্ধের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে বড় অস্ত্র কারখানার মালিক ও প্রতিরক্ষা ঠিকাদার কোম্পানীগুলোর সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্কের কথা জানা যায়। এবং যুদ্ধ হচ্ছে মার্কিন অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় ও ক্ষেত্র।

লেখক: গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর