৪ অক্টোবর, ২০২১ ১৩:০৬

জাতিসংঘে ভারত-পাকিস্তানের তুমুল বাহাস

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

জাতিসংঘে ভারত-পাকিস্তানের তুমুল বাহাস

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

জাতিসংঘের ৭৬তম সাধারণ অধিবেশনে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের ভাষণ ও বিতর্ক গত সপ্তাহে শেষ হলো। এবারের অধিবেশনটি বহু কারণে বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। করোনা টিকার বৈষম্যহীন বণ্টন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে মুক্তি, আফগানিস্তানে উগ্রপন্থি কট্টর ইসলামিস্ট তালেবান বাহিনীর ক্ষমতা দখল ও তার পরিণতি, পরাশক্তির দ্বন্দ্ব-সংঘাতে বিশ্বব্যবস্থার অকার্যকারিতা এবং রোহিঙ্গা সমস্যা; মূলত এ বিষয়গুলো নিয়েই বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বক্তব্য দিয়েছেন এবং বিতর্ক করেছেন।  কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভার্চুয়ালি যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে উপরোক্ত বিষয়গুলোর উল্লেখ ছিল খুবই সামান্য, ভাসাভাসা। তিনি সব কূটনৈতিক শিষ্টাচারকে উপেক্ষা করে অকস্মাৎ ভারতের বিরুদ্ধে প্রচন্ড আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়েছেন, যা আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ইমরান খানের বক্তব্যের কয়েকটি কথা তুলে ধরছি। বলেছেন, বিজেপি আর এসএস রিজিকা ভারতের সংখ্যালঘিষ্ঠ ২০ কোটি মুসলমানের বিরুদ্ধে চরম বৈষম্যমূলক আচরণসহ সীমাহীন অত্যাচার নির্যাতন চালাচ্ছে, মসজিদ ভেঙে ফেলছে এবং মুসলমানদের সব ঐতিহ্য ধ্বংস করছে। আরও বলেছেন, ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা বাতিল করে ভারত সরকার কাশ্মীরি জনগণের সব অধিকার হনন করেছে এবং কাশ্মীরবাসী এখন ভারতীয় সেনাদের হাতে বন্দী জীবনযাপন করছেন। ইমরান খান আরও অনেক অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, যার কোনো দালিলিক প্রমাণ বা বিশ্বাসযোগ্য রেফারেন্স তিনি উল্লেখ করেননি। ইমরান খানের হঠাৎ এ ধরনের আক্রমণাত্মক বক্তব্যে অধিবেশনের পরিবেশটাই পাল্টে যায়। ভার্চুয়াল ভাষণটি প্রচারের সময় ভারতের সিনিয়র কোনো কূটনীতিক অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত ছিলেন না। উপস্থিত ছিলেন প্রথম সচিব পদবির একজন জুনিয়র নারী কূটনীতিক যার নাম সিনহা দুবে। অধিবেশনের রীতি অনুযায়ী ৭৬তম অধিবেশনের সভাপতির কাছে সিনহা দুবে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করার জন্য সময় চান। মালদ্বীপের ঝানু কূটনীতিক ও সভাপতি আবদুল্লাহ শহিদ ১০ মিনিট সময় দেন সিনহা দুবেকে। তথ্য-উপাত্ত, রেফারেন্সসহ আকর্ষণীয় যুক্তি দিয়ে যেভাবে ইমরান খানের বক্তব্যকে খন্ডন করেছেন তাতে জাতিসংঘের কূটনৈতিক পাড়ায় সিনহা দুবে এখন রীতিমতো হিরো। সবার মুখে মুখে সিনহা দুবের নাম। একজন প্রথম সচিবের কাছে একজন প্রধানমন্ত্রীর এমন পরাজয়ের ইতিহাস জাতিসংঘের বিতর্কের ইতিহাসে নেই। সিনহা দুবে অত্যন্ত জোরালো ভাষায় বলেছেন, ভারতের একান্ত অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অত্যন্ত নগ্নভাবে একতরফা আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে জাতিসংঘের সব রীতিনীতি ও শিষ্টাচার ভঙ্গ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, যে মুসলমান সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করে ইমরান খান মায়াকান্না করেছেন সে রকম আরেকটি মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান মানব ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চালিয়েছে, যার ফলে জন্ম হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। দুবে বলেছেন, ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই গণহত্যার জন্য পাকিস্তান কখনো অনুতপ্ত হয়নি, দুঃখ প্রকাশ করেনি এবং গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিচারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সুতরাং অন্য দেশের মুসলমান নাগরিকদের জন্য পাকিস্তানের মায়াকান্না কুমিরের ক্রন্দন ব্যতিরেকে অন্য কিছু নয়। দুবে উল্লেখ করেছেন, সাতচল্লিশে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের দুঃখজনক স্থানচ্যুতির পরেও পঞ্চাশের দশকের শুরুতে পাকিস্তানের (পশ্চিম পাকিস্তান) মোট জনসংখ্যার শতকরা ২১ ভাগ ছিল হিন্দু। কিন্তু বর্তমানে এই সংখ্যা মাত্র শতকরা ২ ভাগ। বিপরীতে ওই সময়ে ভারতে মুসলমান ছিল মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ২০ ভাগ, এখনো ২০ ভাগ রয়েছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধান সেনাপতি ও প্রধান বিচারপতি হয়েছে। কিন্তু বিপরীতে সাংবিধানিকভাবে পাকিস্তানে ওইসব উচ্চ পদের জন্য মুসলমান ব্যতিরেকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের অযোগ্য করা হয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরে জঙ্গি সন্ত্রাসী আক্রমণের জন্য পাকিস্তানি নাগরিক ধরা পড়েছে এবং বিচারে তাদের শাস্তিও হয়েছে। পক্ষান্তরে এমন কোনো নজির নেই যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে ভারতীয় নাগরিক জড়িত। পাকিস্তান শুধু ভারতের বিরুদ্ধে নয়, বৈশ্বিক জঙ্গিবাদ বিস্তারে জড়িত, সেটি ভারত বা অন্য দেশের বিশ্লেষকরা বলছেন তাই নয়, পাকিস্তানের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীরাও তাদের গবেষণামূলক লেখার মধ্যে তুলে ধরেছেন। উদাহরণস্বরূপ হুসেন হাক্কানির ‘পাকিস্তান বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি’ এবং জাহিদ হুসেনের ‘ফ্রন্টলাইন পাকিস্তান’ গ্রন্থ দুটির কথা বলা যায়। একজন জুনিয়র কর্মকর্তার কাছে ইমরান খান এমনভাবে নাস্তানাবুদ হবেন তা বোধ হয় পাকিস্তানিদের ভাবনায় ছিল না। ইমরান খানের বক্তব্যের বড় অংশজুড়ে ছিল কাশ্মীর প্রসঙ্গ। তাই কাশ্মীর লেগেসির ওপর একটু নজর বোলাতে হবে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের প্রাক্কালে উপমহাদেশে পাঁচ শরও বেশি ছোট-বড় প্রিন্সলি স্টেট বা স্বশাসিত রাজ্য ছিল। ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া ভারতবর্ষ স্বাধীনতা আইনে বলা হয়, প্রিন্সলি স্টেটগুলো ইচ্ছা করলে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে থাকতে পারবে অথবা ইচ্ছামতো ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে পারবে। প্রিন্সলি স্টেট হিসেবে কাশ্মীর স্বাধীন থাকার প্রস্তাব বেছে নেয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে প্রথমে মুজাহিদ ও পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সরাসরি কাশ্মীর আক্রমণ করে। দ্রুতগতিতে বিরাট এলাকা দখল হয়ে যাওয়ায় এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন রাজধানী শ্রীনগরের সন্নিকটে তখন কাশ্মীরের রাজা হরি সিংহ ভারতের সাহায্য চান। প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরু স্পষ্ট বলে দেন, কাশ্মীর ও পাকিস্তানের যুদ্ধে ভারত জড়িত হবে না। কাশ্মীরের রাজা হরি সিংহ তখন ভারতবর্ষ স্বাধীনতা আইনের ধারা অনুযায়ী ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার দলিলে ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর স্বাক্ষর করেন, যেটি ভারতের সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের সংযুক্তি দলিল নামে ইতিহাসে পরিচিত। তারপর ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীর রক্ষার্থে সামরিক অভিযানে নামে। উপরোক্ত দলিলে মোট নয়টি অনুচ্ছেদ এবং চারটি শিডিউল রয়েছে, যাতে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ আছে কী প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতিতে কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে সংযুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করেছে। একপর্যায়ে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয়। সে সময়ে কাশ্মীরের এক বড় অংশ পাকিস্তানের দখলে রয়ে যায় যা আজও পাকিস্তানের দখলে আছে। ১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব নম্বর ৪৭ পাস হয়। তাতে কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণে সুনির্দিষ্ট তিনটি ধাপে কার্যক্রম গ্রহণের উল্লেখ করা হয়। প্রথম ধাপ, পাকিস্তানের সব সেনাবাহিনী এবং বেসামরিক লোকজন সম্পূর্ণভাবে কাশ্মীর থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। দ্বিতীয় ধাপ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যত সংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনী রাখার প্রয়োজন হয় সেটি রেখে পর্যায়ক্রমে ভারত তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করবে। তৃতীয় ধাপ, সুষ্ঠু গণভোটের জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ভারত একজন দক্ষ গণভোট প্রাধ্যক্ষ নিয়োগ দেবে। ব্রিটিশের ভারতবর্ষ স্বাধীনতা আইন অনুসারে পাকিস্তান আগ্রাসী পক্ষ ও দখলদার বাহিনী। এ জন্যই জাতিসংঘের ৪৭ নম্বর প্রস্তাবে পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক সবাইকে প্রত্যাহারের জন্য গণভোটের পূর্বশর্ত হিসেবে নিরাপত্তা পরিষদ নির্ধারণ করে। কিন্তু পাকিস্তান দখলদারিত্ব বজায় রাখার কারণেই গণভোট হতে পারেনি। ভারতবর্ষ স্বাধীনতা আইন এবং কাশ্মীরের পক্ষ থেকে স্বাক্ষরিত সংযুক্তি দলিল অনুসারে পুরো কাশ্মীরই ভারতের অংশ। হিন্দুস্থান টাইমসের সাবেক সম্পাদক অজিত ভট্টাচার্য কর্তৃক ইংরেজিতে লিখিত শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ট্র্যাজিক হিরো অব কাশ্মীর গ্রন্থের ২৫১ পৃষ্ঠায় শেখ আবদুল্লাহর একটি উক্তি লিপিবদ্ধ আছে। তাতে শেখ আবদুল্লাহ যা বলেছেন তার বাংলা করলে দাঁড়ায়- আগ্রাসী পক্ষ তার সেনাবাহিনী প্রথম প্রত্যাহার করবে এবং জাতিসংঘকে নিশ্চিত করতে হবে কাশ্মীর থেকে পাকিস্তান পরিপূর্ণভাবে বাইরে চলে গেছে। সুতরাং দালিলিকভাবে প্রমাণিত যে, পাকিস্তান দখলদারিত্ব বজায় রাখার কারণে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। অন্যদিকে ১৯৪৭ সাল থেকে সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে কাশ্মীরের অভ্যন্তরে অনবরত রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে পাকিস্তান। তাতে সমস্যার সমাধান কিছু হয়নি বরং সেটি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। এই গেল কাশ্মীরের কাহিনি। ইমরান খানের বক্তব্যে ফিরে আসি। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছে এ সময়ে ইমরান খান জাতিসংঘে ভারতবিরোধী এমন আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিলেন কেন। প্রথমত, পাকিস্তানের মোল্লা ও মিলিটারি অক্ষের কৃপার ওপর ইমরান খানের গদি সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। কাশ্মীর নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে উত্তেজক বক্তব্য দিলে মোল্লা ও মিলিটারি সব সময় খুশি থাকে। মনে করা হচ্ছে জাতিসংঘে আলোচ্য বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে ক্ষমতার চলতি মেয়াদের বাকি সময়ের জন্য ইমরান খান তাঁর গদি নিশ্চিত করলেন। দ্বিতীয়ত, ইমরান খানের দলীয় শীর্ষ নেতারা উল্লাস প্রকাশ করছেন এই মর্মে যে, পাকিস্তানের সহায়তায় আফগানিস্তানকে বিদেশি দখলমুক্ত করেছে তালেবান বাহিনী। এবার সবাই মিলে তারা কাশ্মীরকে বিদেশি দখলমুক্ত করবেন। এ ধরনের দুরভিসন্ধি যদি পাকিস্তানের থেকে থাকে তাহলে হতে পারে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইমরান খান একটা বড় অজুহাত অভিযোগ আকারে উত্থাপন করে রাখবেন।  তবে সেরকম পদক্ষেপ পাকিস্তানের জন্যই আত্মঘাতী হবে। আর পুরো অঞ্চলের জন্য সেটা বিপজ্জনক হবে।  সুতরাং জাতিসংঘে ভারত-পাকিস্তানের বাহাস মোটেই কোনো ভালো লক্ষণ নয়।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

 

বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

সর্বশেষ খবর