১৭ অক্টোবর, ২০২১ ১৪:০২

’৭১-এর পরাজিতরাই কুমিল্লা কান্ড ঘটিয়েছে

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

’৭১-এর পরাজিতরাই কুমিল্লা কান্ড ঘটিয়েছে

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননার ঘটনা থেকে দেশব্যাপী যে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস সৃষ্টি হয়েছে তা সবাই জানেন। কিন্তু এই ঘৃণ্য ঘটনাটি কে বা কারা ঘটাল তা নিয়ে সবার প্রশ্ন। এটি যে কোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী করেননি সেই দাবির পক্ষে প্রচুর যুক্তি রয়েছে। কোনো সুস্থ চিন্তার মানুষই বিশ্বাস করে না এটি হিন্দুদের কাজ। প্রথমত কেন তারা এটি করবে? এর দ্বারা তাদের লাভের নিশ্চয়ই কিছু নেই, অন্যদিকে ক্ষতির সম্ভাবনা অনেক, তাদের মোটেও অজানা নেই যে এমনি কোনো ঘটনা দাঙ্গার সৃষ্টি করবে, নষ্ট হবে পূজা। দ্বিতীয় কথা হলো ভোরে কাক ডাকার আগেই কিছু উগ্র ধর্ম ব্যবসায়ী মুসলমান নামধারী মানুষ, বিশেষ করে সৌদিফেরত ফয়েজ কালবিলম্ব না করে ইউটিউব এবং ফেসবুকে ছড়িয়ে দিল নানান অপপ্রচার এবং ঘৃণার বাণী যাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। এমন তড়িৎ গতিতে এসব পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হতো না যদি তাদের পূর্বপ্রস্তুতি না থাকত। তৃতীয় কুমিল্লা কান্ড নতুন নয়, পূর্বে রামু, নাসিরনগর, ভোলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জেও এসব ধর্ম ব্যবসায়ী প্রমাণিতভাবে হিন্দুদের ফেসবুক হ্যাক করে তাতে ইসলামবিরোধী তথ্য ঢেলে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে। পবিত্র কোরআন চিহ্নিত হওয়ার পর সেখানকার হিন্দুরা সেটি সরিয়ে ফেলার জন্য অনুরোধ করলেও ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তা না সরিয়ে বরং সেটি ভিডিও করে ছড়িয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। একদিকে এই জঘন্য কান্ড থেকে কিছু ফায়দা লুটার না থাকলেও ’৭১-এর পরাজিতদের এতে বিরাট লাভ ছিল, কেননা দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে পারলে তারা এ সরকারকে সরিয়ে দেশকে পাকিস্তান বা তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারবে। ’৭১-এর পরাজিত কুচক্রী মহল এ ধরনের একটি জঘন্য ঘটনা ঘটিয়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ঘটানোর ষড়যন্ত্রে বহুদিন থেকেই লিপ্ত ছিল আর কুমিল্লায় মূর্তির পায়ে পবিত্র কোরআন রেখে তারা সেই সুযোগটিই নিয়েছে। বৃহত্তর কুমিল্লা কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের এলাকা। গোলাম আযম মরে গেলেও তার দুই পুত্র ধর্মীয় উসকানির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তার দ্বিতীয় পুত্র  বিদেশ থেকে প্রচার করছে কয়েকটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ইউটিউবের মাধ্যমে। তাদের ভাষা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, বঙ্গবন্ধুবিরোধী,  হিন্দুবিরোধী, ভারতবিরোধী। মুফতি এহসান, হেলিকপ্টার হুজুর নামে পরিচিত হাফিজুর রহমান সিদ্দিকীসহ যেসব ওয়াজ ব্যবসায়ী ওয়াজকালে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে, তারাসহ অন্যান্য লুটেরা ওয়াজ ব্যবসায়ীরাও নির্লজ্জের মতো নেমে পড়েছে দাঙ্গাকারীদের পক্ষে। এটি যে ’৭১-এর পরাজিতদের একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফসল সে সম্পর্কে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এই অপশক্তি অবিরাম দেশকে আবার পাকিস্তানে পরিণত করার চেষ্টা করছে, আর কুমিল্লা কান্ড তারই সর্বশেষ অপপ্রয়াস। শোনা যাচ্ছে পলাতক কনক সারওয়ারের আসামি বোনকে গ্রেফতারের পর সে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে দুর্গাপূজায় অঘটন ঘটাবে। এই অভিযোগও অবিশ্বাস করার সুযোগ নেই, কেননা এসব ’৭১-এর পরাজিত অথবা তাদের বংশধররা অর্থবলে এতই বলীয়ান যে এরা বহু কিছু দেশের বাইরে থেকেই করতে পারে। এদের অর্থ দিচ্ছে তারেক জিয়া এবং পাকিস্তান। এই লোক তো ইউটিউবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, বঙ্গবন্ধুবিরোধী, হিন্দুবিরোধী, ভারতবিরোধী কথা প্রতিদিনই প্রচার করছে।

এ ব্যাপারে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, তথ্য প্রতিমন্ত্রী ড. মুরাদ হাসান, আওয়ামী লীগ নেতা বাহাউদ্দিন নাছিমসহ যারা কড়া ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন তাদের সবারই কথা এটি ’৭১-এর পরাজিত গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র। দেশে সাম্প্রদায়িক স¤প্রীতি নষ্ট করে দেশকে পাকিস্তানে পরিণত করার অপচেষ্টার অংশ হিসেবেই তাদের এই পরিকল্পিত ঘৃণ্য, ইসলামবিরোধী পাপাচার। এ ছাড়াও ইসলামিক ইউনাইটেড ফ্রন্টসহ বেশ কয়েকটি ইসলামিক সংগঠনও বলেছে এটি একটি গভীর ষড়যন্ত্রের ফসল, যাতে জামায়াত-বিএনপির হাত রয়েছে। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনি মোশতাক-জিয়া দেশকে পাকিস্তানে পরিণত করার চেষ্টা ব্যর্থ হলেও এসব কুলাঙ্গার তাদের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পাকিস্তানের সেবাদাস খুনি জিয়াউর রহমান দেশে ধর্মীয় রাজনীতি ফিরিয়ে এনেছিল, যা বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ করেছিলেন। বিএনপি-জামায়াত সরকার ধর্ম ব্যবসায়ীদের শুধু পালনই করেনি, এদের সুযোগ করে দিয়েছে সম্পদের পর্বত গড়ার। এই অশুভ ধর্ম ব্যবসায়ীদের অন্যতম উদ্দেশ্য দেশকে হিন্দুশূন্য করা, যা তারা ২০০১-এর নির্বাচনে জয়ী হয়ে করেছিল হাজার হাজার হিন্দুর ওপর নির্যাতন চালিয়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য করে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় বলে দিয়েছেন এ বিষয়ে গভীর তদন্ত হচ্ছে, জড়িতদের এমন সাজা দেওয়া হবে যেন তারা এ ধরনের ঘটনা আর করার সাহস না পায়। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও একই কথা বলেছেন। এটা সবার দাবি দোষীদের যেন সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়। এরই মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতারের খবরটি আশা জাগানিয়া, যাদের অনেকেই ইউটিউব চালক। এদের কঠোর রিমান্ডে নিলে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে। অনেক ক্ষেত্রে আমি রিমান্ডের বিরোধী হলেও এ ক্ষেত্রে কঠিন রিমান্ডের বিকল্প নেই। একই সঙ্গে সরকারি কৌঁসুলিদের চেষ্টা করতে হবে এসব দুষ্কৃতকারী যেন জামিন না পায়। এসব ধর্ম ব্যবসায়ীকে সমূলে উৎখাত না করতে পারলে বাংলাদেশ পাকিস্তানে বা তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত হবে যেটিই এদের উদ্দেশ্য। আজ সম্মুখ সমরের দিন এসেছে যেমনটি ছিল ১৯৭১ সালে। কবিগুরুর ভাষায় “তোমার মরণ না হয় আমার মরণ”।  এদের সংখ্যা মোটেও বেশি নয়। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধে নেমে যাওয়া প্রতিজ্ঞাবদ্ধদের সংখ্যা অনেক বেশি। এ শক্তি পথে নামলে ধর্মান্ধ তালেবানরা পালানোর পথ খুঁজে পাবে না যেমন পায়নি পাপী, অপরাধী মামুনুল এবং বাবুনগরী। যে মুসলমান মন্দিরে মূর্তির পায়ে পবিত্র কোরআন রাখতে পারে তাকে মুসলমান বলা যায় না। সন্দেহ করা হচ্ছে কয়েকজন মাদরাসা ছাত্র এ কাজটি করেছে। এতে যে পাকিস্তান দূতাবাসের হাত রয়েছে তাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অতীতে এ ধরনের ঘটনার জন্য অর্থ ঢেলে পাকিস্তানি কূটনীতিকরা হাতেনাতে ধরা পড়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের তেমন কোনো বাণিজ্যিক বা অন্যান্য সম্পর্ক নেই বিধায় ঢাকায় একটি ক্ষুদ্রাকৃতি কনসুলেট রেখে দূতাবাসটি বন্ধ করে দেওয়াই শ্রেয়। সে দেশে বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর ডালিম, কর্নেল খোন্দকার রাশেদ, জোবেদা রশিদ বসবাস করে ফ্রীডম পার্টিকে পরিচালিত করছে অথচ পাকিস্তান এদের ফেরত দিচ্ছে না। বেশির ভাগ ওয়াজেই ছড়ানো হচ্ছে ঘৃণার বাণী, যদিও ইসলাম তা সমর্থন করে না। এসব ওয়াজ ব্যবসায়ীকে বিচারের আওতায় এনে এদের মুখ বন্ধ করতে হবে। এরা প্রতিনিয়ত বলাৎকার করে প্রমাণ করছে এরা কত বড় পাপী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যাঘ্র গর্জন থেকে আশা করতে পারি এসব ধর্ম ব্যবসায়ীকে সমূলে উৎখাত করা যাবে। বাংলাদেশের পবিত্র মাটি এদের আবাসস্থল হতে পারে না, তারা চাইলে পাকিস্তানে চলে যেতে পারে। এ দেশটি হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবার, সবারই রয়েছে সমান অধিকার। কোনো শক্তি নেই এই অধিকার ভঙ্গ করার। ২০০১ আর হবে না। হিন্দুরা এ দেশে সংখ্যালঘু নয়, সংখ্যালঘু হচ্ছে এসব ধর্ম ব্যবসায়ী। সেদিন যারা মাঠে নেমেছিল তাদের মধ্যে কিছু মাদরাসা ছাত্র ছিল, তবে বেশির ভাগই ছিল ভাড়া করা বস্তিবাসী। মাদরাসাগুলোকে কঠিন সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে যেন তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বন্ধ করা যায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রসারিত করা যায়।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি


বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর