৩১ জানুয়ারি, ২০২২ ১৪:৪১

কর্নেল অলি ভুল তথ্যকে আর কতদিন রাজনীতি বলবেন?

আব্দুল্লাহ আল নোমান শামীম

কর্নেল অলি ভুল তথ্যকে আর কতদিন রাজনীতি বলবেন?

আব্দুল্লাহ আল নোমান শামীম

গত ২৮শে জানুয়ারী ২০২২ তারিখে বাংলাদেশ প্রতিদিনের বরাতে জানা গেলো, কর্নেল অলি বলেছেন গত দুই বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩ লক্ষাধিক মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছে। গত শুক্রবার নিউ ইয়র্কের  মেমোস হোটেলে এবং বিকেলে উড্স-সাইডস এলাকার হলিডে ইন কুইন্স হোটেলে এলডিপির বিভিন্ন অঙ্গ-রাজ্য শাখার নেতাকর্মীদের সঙ্গে দু’টি মতবিনিময় অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠান শেষে তিনি নিউইয়র্ক থেকে টেলিফোনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এই তথ্য জানান। 

সবার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, কর্নেল অলির দেয়া এই তথ্যটি জেনেশুনে মিথ্যাচার। প্রবাসী বাংলাদেশী ও বাংলাদেশের মানুষকে মিথ্যা তথ্যটি কর্লেন অলি কিভাবে সজ্ঞানে দিলেন তা আমার বোধগম্য নয়। ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর এই সেনানী তার সেনা জীবনের শেষ পর্যায় থেকে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে কিভাবে এতো ভুল তথ্যের উপর রাজনীতি চর্চার চেষ্টা করেন, সেটাও বোধগম্য নয়। মাঝখান থেকে বিএনপির কাছে প্রতারিত হয়ে কিছুদিন সত্য বলেছেন, কিন্তু আওয়ামী লীগের ফাইল ও র‍্যাঙ্ক রাজনীতির কাছে সুবিধা না করতে পেরে আবারো ফিরে গেছেন আওয়ামী বিরোধীতার নামে বাংলাদেশ বিরোধীতায়। তার কাছ থেকে আমরা আরো সঠিক তথ্য সমৃদ্ধ রাজনীতির পরিশীলিত চর্চা আশা করতে পারি, এটুকু আশা করাটা আমাদের ভুল হতে পারে না। 

তিনি এখানে আরেকটি কথা বলেছেন, আশ্রয়প্রার্থীরা বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতন ও মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন। তাদের সকলকে বৈধ করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকে পরিণত করতে সকল পদক্ষেপের উদ্যোগ নিয়েছে এলডিপি।

১) একেতো উনার দেয়া সংখ্যাটা ভুল, তার উপর এই ধরনের আশ্রয় প্রার্থনাকারীরা বাধ্য হয়েই বর্তমান সরকারের নামে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তাদের আশ্রয় প্রার্থনাটা ঐ দেশের সরকারের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে, অনেকেতো ৭ বছর বয়সে ছাত্রদল বা ছাত্রলীগের সদস্যপদ দেখায়! আর এই আশ্রয় প্রার্থনার ব্যবসাটা বাংলাদেশের সবাই জানতে পারে বা মূলত শুরু হয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর হত্যাকারীরা যখন বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়। 

২) এলডিপি যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় প্রার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার খাতে কোনো ধরনের সহায়তা করতে পারবে না, নিয়ম নেই। কিছু সার্টিফিকেট ইস্যু করে হয়ত লোকাল নেতারা কিছু ডলার কামাবে। যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিক সংকট থাকাতে যারা আশ্রয় প্রার্থনা করছে তারা প্রায় সবাই এমনিতেও থাকতে পারবে। 

যাই হোক, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনাকারীদের নিয়ে তথ্যটা আসলে কি, সেটা এখন জানাই। সেই সংখ্যাটা কর্নেল অলি'র দেয়া সংখ্যার ধারে কাছেও নেই। পৃথিবীব্যাপী এই রাজনৈতিক আশ্রয়, রিফিউজি ক্রাইসিস আছে অনাদিকাল থেকেই, মানুষ এক সীমানা ছাড়িয়ে অন্য সীমানায় যায়, এক ভূমি থেকে আরেক ভূমিতে বসতি স্থাপন করে বা করতে বাধ্য হয়, আর এই স্রোতটা মূলত হিসেব করে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান UNHCR. এই সংস্থাটির রিফিউজি সংক্রান্ত প্রমাণিত তথ্যকে একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য বলে মানা হয় দুনিয়ার সব দেশে।

আসুন দেখি UNHCR কি বলছে! তাদের ওয়েবসাইটে বিভিন্ন দেশ থেকে আমেরিকায় আশা মানুষের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীদের ডাটা'র দিকে তাকান। প্রথমেই যাই, 'জোর করে দেশ ত্যাগ করানো'তে, এখানে বাংলাদেশ থেকে জোর করে আমেরিকায় পাঠানোর লিস্টে একজন বাংলাদেশীও নাই। যুক্তরাজ্য থেকে তবু এই লিস্টে ১৭৩ জন, এমনকি কানাডা থেকে ১১৬০ জনকে যুক্তরাষ্টে জোর করে পাঠানো বা বলা যায় দেশ ছাড়া করা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে একজনও না। 

এখন আসুন, রাজনৈতিক আশ্রয় ও রিফিউজি স্ট্যাটাসের সংখ্যার দিকে। UNHCR-এর ২০২১ সালের ডাটা অনুসারে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন ১২,২৮৯ জন ও রিফিউজি স্ট্যাটাস পেয়েছেন মাত্র ২,১৫১ জন।

২০২০ সালের ডাটা অনুযায়ী, রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনাকারীর সংখ্যাটি মাত্র ১০,১১৪ জন ও রিফিউজি স্ট্যাটাস পেয়েছেন মাত্র ২,১৬২ জন। 

এই দুই বছর মিলিয়ে আশ্রয় প্রার্থীর সংখ্যা মাত্র ২২,৪০৩ জন, কোনো ভাবেই কর্নেল অলি আহমেদের দেয়া তথ্যমতে ৩ লক্ষাধিক নয়। এই ভুল তথ্যটি জেনেশুনে ঘটা করে বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করাটা রাজনৈতিক চতুরতা মাত্র, রাজনৈতিক কৌশল একে বলা যাবে না, কারণ তার দেয়া তথ্যটি মিথ্যে। 

আপনাদের হয়ত জানতে ইচ্ছে হবে, ২০১৯ সালে কতজন রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন, আসুন জেনে নেই। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন ৯,৩৪১ জন ও রিফিউজি স্ট্যাটাস পেয়েছেন মাত্র ২,০৩৮ জন।

যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করা দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সেরা ২০-এর মধ্যেই পড়ে না, বাংলাদেশের চেয়েও যে সমস্ত দেশ থেকে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীর সংখ্যা বেশী, সেগুলো হলো, চীন, ভেনেজুয়েলা, গুয়েতেমালা, হন্ডুরাস, মেক্সিকো, কলম্বিয়া, রাশিয়া, মিশর, ব্রাজিল, নেপাল, পাকিস্তান, ভারতের মতো দেশগুলো।

বাংলাদেশ থেকে এখন এই আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ার একটি অন্যতম কারণ হলো, ২০ বছর আগে অর্থনীতির ভিত্তি দুর্বল থাকাতে টুরিস্ট ভিসা ও স্টুডেন্ট ভিসা খুব কম দেয়া হতো, এই অবস্থার এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে, শুধু আমেরিকায় নয়, সারা বিশ্বেই আমাদের টুরিস্ট ও পড়তে যাওয়া ছাত্রদের এই সংখ্যাটা অন্তত ৫০ গুন বেড়েছে এখন। বাৎসরিক ভিসা ইস্যুর এই প্রদত্ত সংখ্যাটাও আমেরিকার ভিসা ইস্যু করা তথ্য ভান্ডার থেকে অনায়েসেই নেয়া যেতে পারে।  

আর, মনে রাখতে হবে এই আশ্রয়প্রার্থীদের একটি বড় সংখ্যাই আমেরিকায় উন্নত জীবনের আশায় দেশ ত্যাগ করা অর্থনৈতিক রিফিউজি, শুধু রাজনীতির কারণ দেখিয়ে এপ্লিকেশন করা হলেও এর ৯০% এর পেছনের মূল উদ্দেশ্য, অর্থনৈতিক মাইগ্রেশন। 

পরিশেষে একটা কথাই বলতে চাই, আমাদের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে আমরা আরো পরিচ্ছন রাজনীতি আশা করি, এই চাওয়াটা আমাদের অন্যায় না। তারুণ্য এখন তথ্য যাচাই করার সক্ষমতা অর্জন করেছে, কেউ বললেই সে সেটা আর অন্ধভাবে গ্রহণ করছে না। ক্ষমতা ও ক্ষমতার রাজনীতির সাথে আপনারা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, এখনও যদি শুধুই ক্ষমতার স্বার্থে রাজনীতির আবহ থেকে আপনারা বের হতে না পারেন, তাহলে লিজেন্ড হবেন কবে? রাজনীতিতে সত্য কহন বাড়ুক, আমাদের এটাই প্রত্যাশা।


বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর