২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১২:৪৫

কানাডার গণতন্ত্র ও ট্রাক চালকদের আন্দোলনের বিচিত্র রূপ

ড. মঞ্জুরে খোদা

কানাডার গণতন্ত্র ও ট্রাক চালকদের আন্দোলনের বিচিত্র রূপ

ড. মঞ্জুরে খোদা

অটোয়া অবরোধের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে- কানাডার মূলধারার প্রধান সংবাদ মাধ্যম সিবিসি সংবাদ দেখছিলাম। সেখানে অনেক দৃশ্য দেখে খুব চমকিত হয়েছি। কারণ আমাদের দেশের আন্দোলন-সংগ্রামের সাথে এর পার্থক্য অনেক। এগুলো দেখার সময় আমাদের আন্দোলনের দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভাসছিল। কানাডার মত একটি দেশের গণতন্ত্র ও নাগরিক ও মানবাধিকার অধিকার কিভাবে সংরক্ষিত হয়, এবং একটি তীব্র উগ্রবাদী আক্রমনাত্মক আন্দোলনকে (?) কিভাবে দমন করা হয়, সেটা দেখার সুযোগ হলো। 

কানাডা পুলিশ এরমধ্যে ‘ফিডম কনভয়’ আন্দোলনের মূল নেতৃত্বসহ ১৯১ জনকে গ্রেফতার করেছে। ৭৩টি গাড়ী তুলে নিয়ে গিয়েছে। পুলিশবাহিনী আন্দোলনকারীদের বারবার অবস্থান ত্যাগ করার অনুরোধ করে না ফল না পেয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে- টিয়ারগ্যাস-পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করেন। একপ্রকার শক্তিপ্রয়োগ করে তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। টানা ২৪দিন অবরুদ্ধ থাকার পর গতকাল পার্লামেন্ট হিল এলাকাকে মুক্ত করা হয়। 
   
পুলিশের বক্তব্য, যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদেরকে তাদের আন্দোলন-বক্তব্য-দাবীর জন্য গ্রেফতার করা হয়নি। বরং তাদের বিরুদ্ধে আইনভঙ্গের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য-প্রমানের ভিত্তিতেই গ্রেফতার করা করেছে। আন্দোলনে শিশুদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, সে জন্যও তাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানের জন্য ড্রোন ভিডিও ব্যবহার করে তাদের কর্মকান্ড-তৎপরতার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।  
 
অটোয়ায় ট্রাক চালকদের অবরোধে নাগরিক জীবন সংকটাপন্ন হলে প্রথমে অটোয়া পৌরসভা জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন। তারপর অন্টারিও প্রাদেশিক সরকার জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন এবং সর্বশেষ কেন্দ্রীয় সরকার জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন। তারমানে অটোয়ায় তিনস্তর বা তিনটি জরুরী অবস্থা চলছে। কানাডায় জরুরী অবস্থা বজায় থাকলেও শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিষিদ্ধ নয়।  

জরুরী অবস্থা ঘোষণার পরও কেন ট্রাকচালকদের অবস্থান ও অবরোধ অব্যাহত ছিল?  কারণ এখানে স্থানীয়-প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের পুলিশ ও প্রশাসন প্রতিমূহুর্তে নাগরিকের আইনগত ও সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে ভাবতে হয়। কোন কারণেই তাদের সে স্বাধীনতা-অধিকার হরণ করা যায় না। পুলিশের শক্তিপ্রয়োগের পদ্ধতি-কৌশল নিয়ে ভাবতে হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়-স্তরের সরকার ও প্রশাসনের সমন্বয় ও সংযোগ করেই তা করেই তা করতে হয়েছে। 

সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমান আগ্নেয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাওয়া গেছে। যে কারণে পুলিশবাহিনীর সদস্যরা দ্রুত ও তাৎক্ষনিক সব গাড়িতে তল্লাসি চালাতে দ্বিধান্বিত ছিল ও সময় নিচ্ছিল।   

পুলিশ বলছে, যারা এই অবরোধ করছে তারা অত্যন্ত সংগঠিত ও বেপরোয়া। সব কিছু তারা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে করছে। যে কারণে তাদের শুধু ঘোষণা দিয়ে সরানো যাচ্ছে না। পুলিশের অনুরোধ-হুমকি, মামলা-জরিমানা, গাড়ী তুলে নিয়ে- তাদেরকে নিবৃত করা যাচ্ছে না। তাদের বক্তব্য আমরা পথেই থাকবো যতদিন না দাবী আদায় হবে। হয় রাজপথ নয় কারাগার তবু আমরা অনড়। কোন কিছু আমাদের টলাতে পারবে না। এই হচ্ছে আন্দোলনকারীদের মনোবল ও দৃঢ়তার দিক।

কিভাবে তারা হিমাংকের নীচের তাপমাত্রায় বরফের উপর অবস্থান করছে? 
তারা সেখানে তাবু টানিয়েছেন, অস্থায়ী কাঠের ঘরবাড়ী বানিয়েছেন। গোসলখানা বানিয়েছেন, সারি সারি অস্থায়ী প্রাস্টিকের টয়লেট বসিয়েছেন, এমন কি গরমপানি দিয়ে গোসল করার ব্যবস্থাও করেছেন, সোলার এনার্জি লাগিয়ে বিদ্যুতে ব্যবস্থা করেছে। খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করার দোকান/কেন্দ্রও স্থাপন করেছেন। আগুন লাগাতে কাঠের মজুত রেখেছে।

পুলিশ এসে তাদের গাড়ীতে হাজার হাজার ডলারের টিকিট বসিয়ে দিচ্ছেন আর তারা পুশিলের সামনেই তা তুলে ছিড়ে কুচিকুচি করে রাস্তায় ছুড়ে ফেলছেন, পায়খানার মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন। কিন্তু পুলিশ তাদের কিছুই বলছেন না। কারণ তারা সবাই জানে কথা যা হবার কোর্টেই হবে। 

কেউ কেউ তাদের পরিবার বউ, ছেলে-মেয়ে নিয়ে রাস্তাতেই থাকছেন। ট্রাকের সামনে বাচ্চাদের রাখছেন পুলিশ সে কারণে গাড়ীও নিয়ে যেতে পারছেন না। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ট্রাকের মধ্যেই থাকছেন। 

গীর্জা-চার্চসহ বিভিন্ন সংস্থা-সংগঠন-ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের জন্য খাবার, তেল ও অন্যান্য সহায়তা আসছে। সেখানে তারা ক্যাম্প ফায়ার করছে। মদ বিয়ার খাচ্ছে। ঢাকঢোল নিয়ে নাচ-গান করছে। গোটা শুকর রাস্তার পাশে তারা গ্রীল করে খাচ্ছে। ক্যাম্প ফায়ার করছে। 

স্বাধীনতার আন্দোলনে অংশগ্রহনকারী বিভিন্ন-বিচিত্র মতাদর্শে বিশ্বাসীরা প্রকাশ্যে মুক্তভাবে উগ্রতা, ঘৃণার প্রতীক, স্বেতাঙ্গ জাতীয়তা, কনফেডারেশনসহ বিভিন্ন ধরণের পতাকা, প্রতীক-চিহ্ন বহন করছেন। কিন্তু পুলিশ তাদের সাথে গা লাগিয়ে অবস্থান করলেও কোন বাধা দিচ্ছে না, তাদের নিবৃত্ত করছে না। এ জন্য তাদের কারো বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ-রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হচ্ছে না, গ্রেফতার করা হচ্ছে না। 
          
একটি সভ্য ও উন্নত দেশে নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার কতটা কার্যকর থাকলে- নাগরিকরা তাদের অধিকার আদায়ে এতটা জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে তা দেখার সুযোগ হলো। যেখানে পুলিশদের দেখছি আন্দোলনকারীদের সাথে কতটা সংযত আচরণ করছে। বরং পুলিশের সাথেই তারা দূর্ব্যবহার করছে, তাদের গায়ে পোস্টার সেটে দিচ্ছে, হাত তুলছে। 

ব্যক্তিগতভাবে আমি তাদের এই তথাকথিত স্বাধীনতার ফ্রিডম কনভয় আন্দোলনকে সমর্থন করি না। এ দেশের অধিকাংশ মানুষও তাদের সমর্থন করছে না। শিশুরা বাদে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ইতোমধ্যে লাইন ধরে স্বতস্ফুতভাবেই টিকা নিয়েছেন। সেখানে গুটি কয় মানুষ স্বাধীনতার কথা বলে টিকা না নেয়ার দাবী করছেন- সেটা অন্যায় ও কান্ডজ্ঞানহীন। 

তারা টিকা না নিতেই পারেন, তাদের সে স্বাধীনতা থাকতে পারে। কিন্তু তারা টিকা না নিয়ে কি ঘরে বসে থাকবেন? মানুষের সাথে মিশবেন না? সমাজে চলবেন না? কারণ টিকা না নিয়ে তারা হোটেল-রেস্ট্রুরেন্ট, দোকান-বাজার, বাস-ট্রেন-বিমান, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, জনপদ-সমাজে চলাফেরা করে আমাকে-আমাদের যে সংক্রমিত করবে, সে দায়িত্ব কে নেবে? আমার তো নিজেকে-পরিবারকে সুরক্ষিত রাখার অধিকার আছে। কিন্তু এই তথাকথিত স্বাধীনতার আবদারকারীদের জন্য রক্ষা হবে না, তা হয় না, হতে পারে না। এমন অদ্ভুদ স্বাধীনতার দাবী আদায় হলে, তারা রাষ্ট্রের কাছে আরো অনেক উদ্ভট স্বাধীনতার দাবী করতে পারে, সেটা ভাবতেই আমি শিউরে উঠছি। সে জন্যই বলি, স্বাধীনতার অর্থ সবসময় যার যা ইচ্ছে তাই করতে পারা নয়, বরং যার যা ইচ্ছে তা’ করতে না পারাই স্বাধীনতা। 

তাদের আন্দোলনের ধরণ, নিবেদিতবোধ দেখে চমকিত হচ্ছিলাম। এতে অংশ নেয়া অনেকে তাদের পুরো পরিবার নিয়েই রাস্তায় পরে আছে। একটা উৎসবের আমেজে ও ভিষন দৃঢ়তা নিয়ে লেগে আছে। পুলিশ ও সরকার গণস্বার্থ বিরোধী এ আন্দোলনকে বন্ধ করতে সব দিক ঠিক রেখে- নাগরিক অধিকার ও আইন-সংবিধান নিদেশিত পথেই অগ্রসর হয়েছে। সেটা ভাল লেগেছে। এখান থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর শেখার আছে অনেক কিছু। আমি এ আন্দোলনকে সমর্থন না করলেও তাদের কথা বলার ও দাবীর জানানোর অধিকারকে সমর্থন করি। কিন্তু সেটা কোনভাবেই জনদূর্ভোগ বাড়িয়ে নয়।  

লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর