১ এপ্রিল, ২০২২ ১৩:৪২

জননেত্রী শেখ হাসিনার কর্মী দিয়ে কমিটি করুন

বাণী ইয়াসমিন হাসি

জননেত্রী শেখ হাসিনার কর্মী দিয়ে কমিটি করুন

বাণী ইয়াসমিন হাসি

এখনো নিজের জায়গা জমি বিক্রি করে মানুষ আওয়ামী লীগ করে; মায়ের কানের দুল বন্ধক রেখে ছাত্রলীগ করে। এই পাগল কর্মীরাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ‘প্রাণ’। কোন শঠ নেতার উপর ভর করে আওয়ামী লীগ টিকে নেই। আওয়ামী লীগের শেকড় অনেক গভীরে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই প্রেম বহমান।

প্রেম একপাক্ষিক হয় আবার দ্বিপাক্ষিক ও হয়ে থাকে। কর্মীরা শুধু ভালোবাসা দিয়েই যাবে কিন্তু দিনশেষে কিছুই পাবে না এটাও কিন্তু একধরণের অন্যায় এবং প্রবঞ্চনা। দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ‘৭৫ এর পর সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। কেন্দ্রের সাথে তৃণমূলের আকাশসমন দূরত্ব। সর্বত্রই নিজস্ব বলয় এবং মাইম্যান তৈরির চেষ্টা। যারা ভালোবেসে রাজনীতিটা করতে চেয়েছে তাদেরকেই সবসময় বঞ্চিত করা হয়েছে। রাজপথের ঘাম শ্রম লাগে না, ডেডিকেশন লাগে না, আদর্শ লাগে না। নেতা বের হয় পকেট থেকে।

তৃণমূলের কর্মীরাই আওয়ামী লীগের প্রাণশক্তি। সব কেন্দ্রীয় নেতাই গলায় আবেগ ঢেলে এটি জনসভায় বলেন। প্রচুর হাততালিও পান। কিন্তু কমিটি করার সময়, মনোনয়ন নেওয়ার সময় সেই তৃণমূলই সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত হয় !

এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচন আওয়ামী লীগের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। একটা সময় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন মানেই ছিল একটা উৎসবের আমেজ। সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোর সর্বনিম্ন এই স্তরটি ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষপাতের বাইরে। এখানে এক প্রার্থী অন্য প্রার্থীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করতেন, একই সঙ্গে প্রচারে অংশ নিতেন। পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে যেত গ্রামের পর গ্রাম। রীতিমতো হই চই পড়ে নির্বাচনী এলাকায়। নির্বাচনের পর আবার যে যার মতো, বিজয়ী প্রার্থীকে সহযোগিতা, সম্মান করতেন। কিন্তু এখন সেসব কথা অতীত। 
স্থানীয় পর্যায়ে দলমত নির্বিশেষে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিটিই নির্বাচনে অংশ নিতেন। এখানে নিজস্ব ফেসভ্যালু এবং গৌষ্ঠীগত একটা ব্যাপার কাজ করতো। সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল এবং একটা দীর্ঘসময় ধরে সুখেদু:খে জনগণের পাশে থেকে ইতিমধ্যেই যিনি তাদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন এমন কেউই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করতেন। 

২০১৬ সালের ২২ মার্চ দেশে দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন শুরু হয়। মাঠ পর্যায়ে ব্যক্তিগত রেষারেষি ও দ্বন্দ্ব-কোন্দল সবসময়ই কমবেশি ছিল। কিন্তু সমস্যাটা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন প্রক্রিয়ায় দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার নিয়ম শুরু হওয়ার পর থেকেই। নির্বাচনের যে ধারা বর্তমানে চলমান, তাতে অনেকের মধ্যে এমন একটা প্রত্যয় জন্ম নিয়েছে যে, প্রতীক হিসাবে নৌকা পাওয়ার অর্থই হচ্ছে বিজয় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে ইউনিয়ন বা উপজেলা জেলা পর্যায়ের নেতারাই দলীয় মনোনয়নেই ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকছেন। তবে অধিকাংশ জায়গায়ই তাদের সেই অর্থে জনপ্রিয়তা বা জনসম্পৃক্ততা নেই। স্থানীয় নেতাকর্মীরা অনেক সময় বাধ্য হয়েই দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিচ্ছেন, কোথাও বা আবার বিদ্রোহও করছেন।

তৃণমূলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। দেশে প্রায় ৬ হাজার ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। এই ভোট প্রতীক বাদ দিয়ে করলে বিদ্রোহী প্রার্থীমুক্ত থাকতে পারবে আওয়ামী লীগ। কোন চেয়ারম্যান প্রার্থী যোগ্য-অযোগ্য, সেটি স্থানীয় জনগণই নির্বাচন করবে। এতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্যরা নির্ভার থাকতে পারবেন। এখন জেলা-উপজেলা ও সংসদ সদস্যদের প্রার্থী বাছাইকে কেন্দ্রে করে যে বেগ পেতে হয়, সেটি আর থাকবে না।

সরকারের সমস্ত সেবা, সুযোগ সুবিধা এবং অনুদান স্থানীয় জনপ্রতিনিধির হাত দিয়ে জনগণের কাছে পৌঁছায়। এই সেবা বা অনুদান পেতে জনগণকে যখন টাকা খরচ করতে হয় তখন তার মধ্যে সরকারের প্রতি যে কৃতজ্ঞতাবোধটা থাকার কথা সেটা কিন্তু আর থাকছে না। সে মনে করছে আমি তো টাকার বিনিময়ে সেবাটা কিনে নিলাম। এই জনপ্রতিনিধিরা অনেক সময় অপকর্মে জড়িত পড়েন। সেই দায়ও এসে পড়ে দলের উপর। সামনের জাতীয় নির্বাচনে এটার একটা বাজে প্রভাব পড়বে। 

মনোনয়ন বাণিজ্যের মতন একটা গুরুতর ‌অভিযোগও উঠছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে ঘিরে। বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে উপজেলা জেলা থেকে কেন্দ্রে নাম পাঠানোর অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। প্রতিটা জায়গায় ৫/৬ জন করে প্রার্থী। প্রত্যেকেই মনোনয়ন পাওয়ার জন্য কেন্দ্রে দৌড়াদৌড়ি করে। দিনশেষে একজন মনোনয়ন পান। বাকিরা এলাকায় ফিরে গিয়ে তার কর্মীদের বলেন টাকার কাছে হেরে গেলাম। এতে করে তৃণমূল পর্যায়ে একটা ধারণা পোক্ত হচ্ছে যে টাকার বিনিময়ে দলীয় মনোনয়ন মেলে।

টিসিবির লাইন প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে। সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধির আধিক্য। মানুষের হয়ে কথা বলার মত জনপ্রতিনিধি বা নেতা কই? আমাদের সৌভাগ্য আমাদের একজন শেখ হাসিনা আছেন। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য শেখ হাসিনার পালসকে বোঝার বা ধারণ করার মত কেউ নেই। না সরকারে, না দলে। সবাই জননেত্রী শেখ হাসিনার সামনে বলেন- সব ঠিক আছে, আমরা দেখছি। আর জনগণকে বলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব দেখছেন !

কমিটির প্রেসরিলিজের পর, নমিনেশন ঘোষণার পর, প্রমোশন বা ভালো পোস্টিং এর পর, বিভিন্ন সেক্টরে পুরস্কার প্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশের পর চরম বিতর্ক শুরু হয়। ইউনিয়নের কমিটি করতেও নাকি আগে থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়। আমার প্রশ্ন হলো অনেক গুলো ধাপ পেরিয়ে কি করে বিতর্কিতরা চূড়ান্ত মনোনয়ন পায়? কারা এদের জন্য সুপারিশ করে? তারা কি সারাজীবন পর্দার আড়ালেই থেকে যাবে? 

সব ঠিক থাকলে এ বছরের ডিসেম্বরেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২ তম কাউন্সিল। কিন্তু কে হবেন জননেত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য রানিংমেট এই আলোচনা সর্বত্র। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের এবারের কাউন্সিলটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া মোটেও সহজ হবে না। টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে নেতাদের মধ্যে আত্মঅহমিকা ভর করেছে, সংগঠন হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। একজন সত্যিকারের নেতা দরকার, যিনি দলকে সংগঠিত করবেন। নিজস্ব বলয় তৈরি করবেন না। যেকোন সংকটে জননেত্রী শেখ হাসিনার পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়াবেন। এক্ষেত্রে সৈয়দ আশরাফের একজন যোগ্য উত্তরসূরিই বেটার চয়েজ হতে পারে। যিনি কমিটি বাণিজ্য করবেন না, সংগঠনকে বিক্রি করবেন না।

সাজসাজ রবে অনেক জেলা এবং উপজেলায় কাউন্সিল হচ্ছে। প্রথম অধিবেশনের পর মন্ত্রী এমপির বাসায় বসে কমিটি সাইন হয়। এরপর সম্মেলনস্থলের মঞ্চে দাঁড়িয়ে যখন কমিটি ঘোষণা হচ্ছে তখন কোন কোন কেন্দ্রীয় নেতা ধাওয়ার শিকার হচ্ছেন, কোথাওবা আবার চেয়ার ছুঁড়ে মারা হচ্ছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করে যে মহান দায়িত্বটা দিয়েছেন, সেটা ঠিকমতন পালন করুন। কমিটি বাণিজ্য বন্ধ করুন। মন্ত্রী এমপির পকেট থেকে বের হন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জননেত্রী শেখ হাসিনার কর্মী দিয়ে কমিটি করুন।

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট, পরিচালক, জাগরণ টিভি।

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর