শিরোনাম
৬ জুলাই, ২০২২ ১৬:৩৩

বোনের মৃত্যু ও আমার শিক্ষক

হোসেন আবদুল মান্নান

বোনের মৃত্যু ও আমার শিক্ষক

প্রতীকী ছবি

একবুক বেদনা নিয়ে মানিকখালি রেলস্টেশনের ফ্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন আমার বাবা। আগের দিন শিশু কন্যাকে দাফন করে মানসিকভাবে তিনি বেশ মুষড়ে পড়েছেন। তাঁর চেহারায় আগাগোড়া বিষন্নতার ছাপ পড়ে আছে। তিনি লক্ষ করছেন, আপন বা পরিচিতজনের মধ্যে আজ ঢাকাগামী কোনো যাত্রী আছেন কিনা। মনে মনে তাকেই খুঁজছেন তিনি। আজকের ভেতর পুত্রের কাছে কন্যার মৃত্যু সংবাদ পৌঁছাতে হবে। চিঠিপত্র লেখা অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আজকের চিঠি কবে গিয়ে পৌঁছাবে বলা যায় না। তাঁর ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মহসীন হলে বসবাস করে। দুঃসংবাদ হলেও এটা তাকে জানাতেই হবে। দেরি হলে সে খুব কষ্ট পাবে। কী আশ্চর্য, ট্রেন আসার একটু আগেই তিনি পেয়ে যান তাঁর একজন সুহৃদ ও পুত্রের শুভাকাঙ্ক্ষী শিক্ষককে। কেবল শিক্ষক বললে ভুল হবে, এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও বিপুলভাবে পরিচিত স্বয়ং প্রধানশিক্ষককে। তিনি ঢাকার যাত্রী। স্কুলের প্রয়োজনে ঢাকায় বোর্ড অফিসে যাচ্ছেন। বাবা তাঁকে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গিয়ে কন্যার মৃত্যুর সংবাদ পৌঁছানোর জন্য অনুরোধ করেন। আমাদের স্কুল জীবনের খ্যাতিমান সেই  প্রধানশিক্ষক সেদিন এ দায়িত্ব সযত্নে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।

২) ১৯৮৩ সালের অক্টোবর বা নভেম্বর মাস হবে। ক্যাম্পাসের এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি শেষে সন্ধ্যার পর মহসীন হলের সামনে এসে হাজির হই। দেশব্যাপী স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে। প্রতিটা হলের গেটের ওপর ছাত্রদের জটলা বাঁধা ভিড় লেগে আছে। কিছুদিন আগে ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বিভিন্ন হল ও পুরান ঢাকার নানা স্থান থেকে ছাত্র নেতাদের আনাগোনায় পুরো এলাকা মুখরিত। হলের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছি। হঠাৎ পেছন থেকে আমার ডাকনাম ধরে ভারিক্কি কণ্ঠের এক আদুরে সম্বোধন শুনি।
এই---এদিকে আয়, 
আমি মাথা ঘুরিয়ে বিস্মিত হই। আরে শান্তু স্যার যে।
স্যার আপনি কেমন আছেন? কোথায় আসছেন?
আমি কদমবুসি করতে আভূমি নত হই।
স্যার বললেন,
তোর কাছেই-এসেছি।

স্যারের হাতে একখানা ছোট ব্যাগ। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। শান্তু স্যার (শাহ্ শামসুদ্দীন) নিজেই এসেছেন! আমাদের এলাকায় শান্তু স্যার নামেই তিনি প্রায় কিংবদন্তি। স্কুলে যাকে দেখলে আমরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দৌড়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করতাম। সে-ই প্রবল ব্যক্তিত্ববান স্যার হলের সামনে বেঞ্চের ওপর বসে আছেন! স্যার আবার বললেন, আমি অনেকক্ষণ যাবৎ এখানে বসে আছি। সবার দিকে তাকাচ্ছিলাম। তোকে খুঁজে হয়রান হয়ে গেছি। ছয় তলায় গিয়ে দেখি তোর রুমে তালা।

শোন, একটা দুঃসংবাদ আছে। মন খারাপ করিস না কিন্তু। গতকাল তোর সবচে ছোট বোন আনোয়ারা মারা গেছে। কটিয়াদি উপজেলা হাসপাতালেই তার মৃত্যু হয়েছে। আমি অপ্রস্তুত ছিলাম। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন অবস্থা হলো। আমার মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। হতভম্ব হয়ে আমি শুধু একটা প্রশ্ন করি, কি হয়েছিল স্যার? আমি তো পনের দিন আগে তাকে ভালো দেখে এসেছি।

তোর বাবা আমাকে বলেছেন, ধনুষ্টংকার হয়েছিল। কিছুদিন আগে পায়ে কাঁটা বিধেঁছিল। কেউ নাকি কিছু বুঝতে পারেনি। শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কি করা যাবে, মহান আল্লাহর ওপর ভরসা। যা, তুই বাড়ি থেকে একবার ঘুরে আস। 

সঙ্গে সঙ্গে আমার দু’চোখ ভরে অশ্রু নেমে আসে। হতবিহ্বল হয়ে যাই। আমার বয়স তখন ২১ বছর হবে। তবু শরীরটা অবশ হয়ে আসছিল। তবে তাৎক্ষণিক সম্বিৎ ফিরে পাই। স্যারকে বিদায় জানিয়ে আমি দৌড়িয়ে নিজের কক্ষে যাই। মনে পড়ে, সেদিন স্যারকে বলতেও পারিনি তিনি কোথায় উঠবেন, কার সঙ্গে থাকবেন ইত্যাদি কুশলাদি। কালবিলম্ব না করে ছোট্ট একটি ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমে আসি। তখনো রুমে না ফেরায় রুমমেটকেও বলা হয়নি। হল থেকে একটু হেঁটে এসে ইউনিভার্সিটি ক্লাবের বিপরীত দিক থেকে রিকশা নিই। রিকশায় বসে ভাবছিলাম, শান্তু স্যার আমাকে সত্যিই সন্তানতুল্য স্নেহ করেন, এটা কেবল একটু ভালো ছাত্র ছিলাম তা বলেই নয়। মনে পড়ছিল, সেই কবে এসএসসি পরীক্ষাকালীন একজন হল পরিদর্শক শিক্ষকের সঙ্গে আমার বেশ ঝামেলা হলে স্যার কী অস্থির ও বিচলিত হয়েছিলেন।

তিনি সেই বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকের কাছে আমার হয়ে এবং আমার প্রশংসা করে খাতাটা ফেরৎ দেয়ার জন্য কতটা মিনতি করেছিলেন। পরবর্তীতে জেনেছিলাম, সেই শিক্ষক স্কুলে আমার স্যারেরও সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। যাক রাতেই সোজা কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছি এবং স্টেশন মাস্টারের মাধ্যমে জানতে পারি, আজকের মতো চট্টগ্রামগামী মাত্র দুটো ট্রেন আছে। তবে একটি ভৈরববাজার ধরবে। অন্যটি ননস্টপ ও দ্রুতগামী। আমি ভৈরববাজার পর্যন্তই যেতে চাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন প্রস্তুত হলো এবং আমি একটা সিটে বসি।

৩) ট্রেনে বসে আমার খুব কান্না পাচ্ছিল। চোখ ভিজে আসছিল বারবার। আমার দু'চোখের আয়নায় ছোট বোনটার অনিন্দ্য সুন্দর মুখখানা নিরন্তর নেচে যাচ্ছিল। আহা! কী চটপটে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ ছিল তার। আমি কিছুতেই তাকে একটা মৃত মুখের সাথে মেলাতে পারছিলাম না। ট্রেনটা সেদিন কী অদ্ভুত এবং এক ধরনের বিকট শব্দ করে চলেছিল, তা ভাবা যায় না। আমার কাছে অস্বাভাবিক ঠেকেছিল। গাছগাছালি, ঝোপঝাড়, বাঁশবাগান সবকিছু পেছনে ফেলে দানবের মতন ধাবমান ছিল এ মেইল ট্রেন। আমি অন্ধকারে জানলার শার্শিতে চোখ মেলে ধরি-ছোট বোনটার মৃত্যুর কথা ভোলার শত চেষ্টা করেও পারিনি। ঘুরে ফিরে চোখে ভাসছিল, কানে বাজছিল তার শেষ বাক্যটি “ভাইজান যাইও না মা তোমাকে খুঁজতেছে”।

এই তো মাত্র ক'দিন আগের কথা। বাড়ি থেকে ঢাকা আসার সময় মাকে সালাম করে আমি বাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে বের হই। মা বুঝতে পারেনি। তিনি ভেবেছেন সামনের বড় রাস্তা দিয়ে স্টেশনে যাচ্ছি। সেদিন আনোয়ারা দৌড়ে এসে কী মায়াবী কণ্ঠে বললো, "ভাইজান, মা তোমাকে ওদিকে খুঁজতে গেছে"। তখন আমাদের বাড়ি থেকে স্টেশনে যাওয়ার দু'দিকেই পথ ছিল। আমি ফিরে এসে মা'র সঙ্গে পুনর্বার কথা বলে এসেছিলাম। মাকে বলেছিলাম, মা আমার জন্য চিন্তা করো না, কয়েক দিন বাদেই চলে আসব। এই যে ট্রেনের শব্দ শোনা যায়। মা বললেন, 'সাবধানে যাইয়ো বাবা'। এ সমস্ত কথোপকথন আর দৃশ্যপট আমাকে অনবরত  মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছিল। আমি শিশুদের মত অবুঝ হয়ে পড়েছিলাম। 

৪) ভৈরববাজার স্টেশনে ট্রেনটা খুব অল্প সময়ের জন্য থেমেছিল। রাত তখন ১১-৪০ মিনিট হবে। আমাকে কিশোরগঞ্জের দিকে আরও পাঁচটি স্টেশন পেরিয়ে যেতে হবে। কিশোরগঞ্জ তখনো মহকুমা শহর। বছরখানেক বাদে এটি জেলায় উন্নীত হয়। ভৈরব স্টেশন অফিসে খোঁজ নিয়ে জানলাম, আজ বিলম্বের কারণে বাহাদুরাবাদ মেইল ট্রেন একটু পরেই পৌঁছে যাবে। এটা নাকি আমার ভাগ্য। অন্যথায় সারাটি রাত ফ্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে কাটাতে হত। চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনটা আসলেই আমি এতে উঠে বসি। আমাকে পঞ্চম নম্বর পার হয়ে ষষ্ঠ নম্বর স্টেশন মানিকখালিতে নামতে হবে। বসার আসন নেই। কাজেই হ্যান্ডেলে হাত রেখে সটান দাঁড়িয়ে। প্রায় ঘণ্টাখানিক পরে আমার গন্তব্য ও নির্ধারিত স্টেশনে গিয়ে নেমে যাই। মানিকখালি স্টেশনের অদূরেই আমাদের বাড়ি। পায়ে হেঁটে যখন বাড়ি পৌঁছি, ঘড়ির কাঁটায় রাত ১টার কাছাকাছি। উঠোনে দাঁড়িয়ে 'মা' বলে একবার শব্দ করতেই নিমিষে দরজাটা খুলে গেল। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে সজোরে কেঁদে উঠলেন। বাবা বিছানার ওপর নির্বাক পাথর হয়ে বসে আছেন। বাড়ি থেকে আমার শেষবার বিদায় নেওয়ার করুণ দৃশ্যের বর্ণনা করে মা বিলাপ করছিলেন।

সে রাতটাও পোহালো। ভোরের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো মানুষের প্রতিদিনের পৃথিবী। সবাই যে যার মতন মিলিয়ে যাচ্ছে দিক-দিগন্তের ঠিকানায়। আমি নিভৃতে আনোয়ারার কবরের কাছে গিয়ে মনে মনে প্রার্থনা করি--হে আল্লাহ, আমার নিষ্পাপ ছোট বোনটাকে বেহেশত নসিব করুন। 

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর