২২ জুলাই, ২০২২ ১৭:১৪

তুমি কি কেবলই ক্যামেরাম্যান?

জয়ন্ত ঘোষাল

তুমি কি কেবলই ক্যামেরাম্যান?

জয়ন্ত ঘোষাল

সংবাদ মাধ্যমে ক্যামেরাম্যানদের ভূমিকা দেশে-বিদেশে, সেকালে এবং একালে সবসময়ই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথম কথা হচ্ছে, খবরের কাগজ, ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং ডিজিটাল চ্যানেলে যারা ক্যামেরাম্যান তারা সাংবাদিক, নাকি সাংবাদিক নয়।

আমি মনে করি, ক্যামেরাম্যানরা সাংবাদিক। অনেক সময় দেশে এবং বিদেশে একজন রিপোর্টারের থেকেও একজন ক্যামেরাম্যান অনেক সময় বড় সাংবাদিকের ভূমিকা পালন করেছে। আমরা তাদের বলতাম ‘চিত্র সাংবাদিক’ বা ‘ফোটো জার্নালিস্ট’। ইলেকট্রনিক মিডিয়া আসার পরে তো শুধু স্টিল ছবি নয়, ভিডিওগ্রাফিও এলো। তখন আবার ভিডিও-ম্যানকে সাংবাদিক বলা অনুচিত বলে মনে হয়। একজন ভিডিওগ্রাফি করা ব্যক্তিও কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে উত্তীর্ণ করতে পারেন, যখন তিনি প্রযুক্তি থেকে সাংবাদিকতার ব্যাকরণটা আরব্ধ করেন।

আমার ছেলে মার্কিন সংবাদ সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)-তে কাজ করছে প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেলো। যখন সবে এখানে জয়েন করেছে তখন আমার ছেলে একবার কলম্বো গেছিলো। সেখান থেকে ফিরে এসে ও আমাকে বলেছিল, ‘জানো বাবা, মার্কিন সংবাদ-সংস্থায় রিপোর্টারদের থেকেও ক্যামেরাম্যানদের গুরুত্ব অনেক বেশি। আমি এমন একজন ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে কলম্বো গেছিলাম যিনি আমার থেকে সিনিয়র ছিলেন। আমি তো সেই সংস্থায় নবাগত। আর তিনি পদে, মর্যাদায় এবং বেতনে আমার চেয়ে ওপরে। সেই সিনিয়র মানুষটি কিন্তু হাতে ধরে কলম্বোর আনাচে-কানাচে আমাকে সাংবাদিকতার পাঠ দিয়েছিলেন।’

আসলে, ওই চিত্র সাংবাদিক এর আগে কলম্বোয় অন্তত ছয়-সাত বার গেছেন। তিনি এলটিটিই, মহাকরণ-এসব বিষয় অনেক দিন ধরে কভার করছেন। সেই সময় নবীন সাংবাদিক হিসেবে আমার পুত্র বারবার প্রশ্ন তুলেছিল, আমাদের দেশে ফটোগ্রাফার বা ক্যামেরাম্যানদের গুরুত্ব এত কম কেন? কেননা, ক্যামেরাম্যান বা ফটোগ্রাফার বললেই আমরা ধরে নিই, তারা কম শিক্ষিত, তারা রিপোর্টার নয় এবং বেশ-ভুষা, চাল-চলনে তার যেন পিছিয়ে পড়ছে।

আমি যখন ইন্ডিয়া টিভি-র পলিটিকাল এডিটর ছিলাম সেই সময় উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে রজত শর্মা দুটো পৃথক বৈঠক ডেকেছিলেন। এক হল, ভোটের ফল কী হতে পারে, তার ওপরে বিশ্লেষণ করতে যে সব সাংবাদিকরা ট্যুর করে ফিরে এসেছেন তাদের সঙ্গে বৈঠক আর যারা ক্যামেরাম্যান তাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক। পলিটিকাল এডিটর হিসেবে আমি সেই দুটো বৈঠকেই উপস্থিত ছিলাম। সেখানে বেশিরভাগ রিপোর্টাররা বললেন, রাহুল এবং অখিলেশের জুটি খুব সাংঘাতিক ভাবে কাজ করছে আর রোড শো-ও হিট করছে। বিজেপি-র পক্ষে আবার ফিরে আসা বেশ কঠিন। এবারে হিন্দুত্বও সেভাবে কাজ করছে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের বেশির ভাগ ক্যামেরাম্যানই বললেন, রাহুল এবং অখিলেশের রোড শো প্রভাব ফেলেছে। যাদব এবং মুসলিম ভোটকে ছাড়িয়ে যোগী আদিত্য নাথের হিন্দুত্ব এগিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং, বিজেপি-ই আবার ক্ষমতায় আসবে বলে মনে হচ্ছে।

ভোট হয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল, সংখ্যা গরিষ্ঠ ক্যামেরাম্যানের বক্তব্য সঠিক। বরং, সংখ্যা গরিষ্ঠ রিপোর্টারেরা ছিলেন কনফিউজড। পরে রজত শর্মা আমাকে বলেছিলেন, রিপোর্টারেরা তাদের নিজেদের উপস্থাপনা, তাদের কন্টাক্ট-কে মেনটেন করা, নিজেদের জামা-কাপড়, কনটেন্ট-এসব নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে মিলেমিশে কথা বলার যে পেনিট্রেশন বা জনসংযোগ, সেটাও অনেক সময় দুর্বল হয়ে যায়। অপরদিকে ক্যামেরাম্যানদের যেহেতু নিজেদেরকে উপস্থাপনার প্রয়োজন থাকে না এবং সবসময়ই তারা থাকে ক্যামেরার পিছনে, সেহেতু অনেক সময় কেউ ক্যামেরার সামনে চলে এলে তাদেরকে তাড়ানোর কাজটাও কিন্তু তারা করে। সেইসব মানুষদের সঙ্গেও কখনো চায়ের দোকানে, কখনো ধাবায় এবং কখনো গ্রামের বাড়িতে বসে তারা অনেক বেশি গল্প-গুজব করে। যখন রিপোর্টার হয়তো কোনও বাইট নিচ্ছে তখন ক্যামেরাম্যান তাদের নিজেদের ভেতরকার কথোপকথন মন দিয়ে শুনছে। এটা তো গেল একটা ব্যাখ্যা।

আসলে আমার যেটা মনে হচ্ছে, আমাদের দেশে ক্যামেরাম্যানদের যে বেতন দেওয়া হয় তা দিয়ে নিজেদের উন্নীত করার, উৎকর্ষ তৈরি করার সেই সুযোগটাও তারা সবসময় পায় না। তার ফলে তাদের গুণগত মানও হয়তো সবসময় উন্নত হয় না।

আমি আনন্দবাজার পত্রিকায় দীর্ঘদিন কাজ করে দেখেছি, রাজীব গান্ধী একবার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গেছিলেন। সেই সময় এমন কিছু ছবি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং চিত্রগ্রাহকের নামও সেখানে ছাপা হয়েছিল। রাজীব গান্ধী সেইসমস্ত ছবি অভীক সরকারের কাছ থেকে রীতিমতো চেয়ে পাঠিয়েছিলেন তার নিজস্ব ব্যক্তিগত অ্যালবামে রাখবেন বলে।

আমি কোনও ব্যক্তি আলোচনা করছি না। আমার মূল বিষয়বস্তুটা হচ্ছে, ক্যামেরাম্যান এবং ফটোগ্রাফারদের গুরুত্ব নিয়ে। আমি নিজে প্রিন্টে কাজ করতাম। এর পরে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অভিজ্ঞতা যখন হল তখন এবিপি নিউজে যারা ক্যামেরাম্যান ছিলেন, স্টুডিওতেও যারা ক্যামেরা সেট করতেন তাদের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। তারা প্রায়ই আমাকে বলতেন, দাদা, এইভাবে তাকাও। দাদা, ওইভাবে নয়, এইভাবে করতে হয়। এইভাবে কথা বলা দরকার। ওরা খুব মন দিয়ে আমার বক্তব্য শুনত। অনেক সময় তারা তাদের মতামতও জানাত। সেই সময় ইন্ডিয়া টিভিতে একজন খুব সিনিয়র ক্যামেরাম্যান ছিলেন। তার নাম অনিল সিং। সে তো আমাকে হাতে ধরে রজত শর্মার চ্যানেলে পিটিসি শিখিয়েছিল। তারপরে কীভাবে দাঁড়াতে হয়, কী রংয়ের জামা পড়া উচিত, স্টুডিওর ভেতরে কী রংয়ের জামা পড়লে ভালো লাগবে, স্টুডিওর বাইরে কীভাবে কাজ করলে ভাল, সে সব পরামর্শও সে আমাকে দিত। আমার মনে আছে, আমি যখন কলকাতা নির্বাচনের সময় নাখোদা মসজিদ থেকে শুরু করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিড়িং-বিড়িং করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম তখন সেই অনিল সিং-ই কিন্তু অনেক স্টোরি আইডিয়া পর্যন্ত দিয়েছিল আমাকে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ছোট লেক ছিল। সেইসময় সেখানে বিরাট বিরাট পদ্মফুল ফুটেছিল। সেখানে তখন বামপন্থীরাও বিজেপি’র সুরে কথা বলছিল। অনিল সিং ওই পদ্মের ছবি তুলে আমাকে দেখিয়ে বলেছিল, দাদা, তোমার ফুটেজের সঙ্গে এটা লাগিয়ে দিচ্ছি যে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মে কমল খিল রাহা হ্যায়? এইসব ছোট ছোট ইনপুট আমরা ক্যামেরাম্যানদের কাছ থেকে পাই। পার্সপেক্টিভ পাই। বিদেশের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। আমাদের দেশেও ক্যামেরাম্যানদের গুরুত্ব অনেক। সে তুলনায় তারা মর্যাদা খুব কম পায়।

এখন কলকাতা প্রেসক্লাবে ক্যামেরাম্যান এবং ফটোগ্রাফাররা অ্যাক্রিডিটেড জার্নালিস্ট। তারা প্রেস ক্লাবের মেম্বার হতে পারবে কি পারবে না, সে সব নিয়ে বিতর্ক চলছে। সেই বিতর্ক নিয়ে আমি কিছু বলছি না। টেকনিশিয়ান স্টুডিওর কলাকুশলীদের মতো ক্যামেরাম্যানদের কোনভাবে অমর্যাদার পথে ঠেলে দেওয়া বোধহয় উচিত নয়। যেমন, বাসের চালক থাকে এবং তার সঙ্গে থাকে হেল্পার। এখানে ক্যামেরাম্যানরা কিন্তু হেল্পার নন, তারাও সাংবাদিক।

আজ কলকাতা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠা দিবস। সেখানে আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভোটাভুটি হচ্ছে। ক্যামেরাম্যান এবং আলোকচিত্রীরা প্রেসক্লাবের সদস্য হবেন কি হবেন না, সে ব্যাপারে!

আমি যে আলোচনাটা করলাম, সেটা এই আলোচনাটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই বিষয়টি নিয়ে আরও বেশি আলাপ-আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এই ভোটের পক্ষে-বিপক্ষে সাংবাদিকদের যার যা মত, সে সেই পক্ষে ভোট দেবেন। 

এটি মুখ্যমন্ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায় বা বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বিষয় নয়। কাজেই, এ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কোনও মতামত নেই! এটা একান্তই সাংবাদিকদের নিজস্ব বিষয়।

লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর