৩ আগস্ট, ২০২২ ১৯:০৭

ন্যান্সির তাইওয়ান সফর গৃহযুদ্ধের উস্কানি ও প্রহসনের শান্তির বাণী

ড. মঞ্জুরে খোদা

ন্যান্সির তাইওয়ান সফর গৃহযুদ্ধের উস্কানি ও প্রহসনের শান্তির বাণী

ড. মঞ্জুরে খোদা

তাইওয়ান হচ্ছে দক্ষিণ চীন সাগরের একটি দ্বীপ। এক সময় চীনের রাজারাই তাইওয়ান শাসন করতেন।  ১৮৮৫ সালে জাপানীরা তাইওয়ান দখল করে নেয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাইওয়ান জাপানের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হয়ে ফের চীনের অধীনে চলে আসে। 

মাও সেতুং এর নেতৃত্বে চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লব শুরু হলে- কমিউনিস্ট বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে চীনের তৎকালীন শাসক চিয়াং কাইশেক দেশটির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চীনের মূলখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন তাইওয়ান দ্বীপে পালিয়ে যান। চিয়াং কাইশেক সেখানে অবস্থান করে রিপাবলিক অব চায়না নামে এক নতুন সরকার গঠন করেন। 

এ ঘটনার পর অনেক দিন জাতিসংঘসহ বিশ্বের অনেক দেশ তাইওয়ানের চিয়াং কাইশেকের সরকারকে চীনের সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমন কি ১৯৭১ সালেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তাইওয়ান সরকারই চীনের প্রতিনিধিত্ব করেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ অক্টোবর জাতিসংঘ বেইজিং এর সরকারকেই চীনের প্রকৃত সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং তাইওয়ানকে জাতিসংঘ থেকে বহিষ্কার করে। তখন থেকে বিশ্বের সকল দেশ বেইজিং এর সরকারকেই প্রকৃত চীন সরকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। এবং তাইওয়ান আর জাতিসংঘ ষোষিত স্বাধীন রাষ্ট্রের তালিকায় থাকলো না। 

১৯৮০’র দশকে চীন-তাইওয়ান ব্যাপক উত্তেজনা ও বাকবিতাণ্ডার পর- গণচীন সে সময় “এক দেশ, দুই পদ্ধতি” নামে তাইওয়ানের সামানে এক প্রস্তাবনা হাজির করে। সে প্রস্তাবনায় তাইওয়ান চীনে বিলুপ্ত হবে এবং তাদের স্বায়ত্বশাসন দেয়া হবে। তাইওয়ান সে প্রস্তাব না মানলেও দশকের পর দশক সেই ভাবেই সব কিছু চলে আসছে। তাদের মধ্যে যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য অব্যাহত থাকে। তাইওয়ানের অর্থনীতি সর্বতভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল পরে। 

তাইওয়ান সময় সময় স্বাধীনতা কথা বললে- ২০০৫ সালে চীনে এক আইন পাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, তাইওয়ান যদি চীন থেকে আলাদা হতে চেষ্টা করে, তা ঠেকাতে চীন শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে। তাইওয়ানের জণগণের মধ্যেও এগুলো নিয়ে বিভেদ আছে। তাইওয়ানের প্রধান দু’টি দল হচ্ছে, ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি ও কুওমিনটাং পার্টি (কেএমটি)। এদের একটি স্বাধীনতার পক্ষে অন্যটি চীনের সঙ্গে একত্রীকরণের পক্ষে। 

তবে চীনের অর্থনীতি-অগ্রগতি ও তাইওয়ানের উপর চীনের প্রভাব ও ঐতিহাসিক সম্পর্কের কারণে তাইওয়ানের বৃহৎ জনগোষ্ঠী চীনের বাইরে ভাবতে চায় না। এটা নিয়ে কোন কোন সংঘাত-রক্তপাত হোক সেটা তারা চায় না। যে কারণে মার্কিন কংগ্রেসের (নিম্নকক্ষের) স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফরে গেলে সেখানকার জনগণ তার হোটেল কক্ষের সামনে বিক্ষোভ করছে। আরটি’র সাক্ষাৎকারে বেশ কয়েকজন নাগরিক বলেছেন, ন্যান্সির সফরে তাইওয়ানের কোন লাভ নেই। আমাদের নিজেদের মধ্যে অশান্তি-বিভেদ বাড়বে, এতে ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ হবে না।  

আমেরিকাও এক চীন নীতি স্বীকার করে। চীনও দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে সে কথা। চীনের সেই ভূখণ্ডে যখন মার্কিন কংগ্রসের স্পিকার মার্কিন রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের তৃতীয় ব্যক্তি চীনের বিরোধীতা সত্ত্বেও সফর করে তখন তাকে উস্কানি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এটা হচ্ছে মার্কিনের- উপরে পানি ঢালা ও নিচে গাছ কাটা নীতি। এভাবেই আমেরিকা দেশে দেশে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে সংকট ও সংঘাত তৈরি করে। চীনের অগ্রগতি মার্কিনীদের মাথা খারাপ করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়ার প্রতি চীনের সমর্থন তাদের আরো বিগড়ে দিয়েছে। এখন তারা চীনকে এক হাত দেখাচ্ছেন। গত জি-৭ বৈঠকও ছিল চীনের বিরুদ্ধেই।  

আমেরিকা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে যেমন ইউক্রেনের ক্ষতি-ধ্বংস করে রাশিয়ার অগ্রগতি-প্রভাব-ক্ষমতার ক্ষতি করতে চায়, তেমনি চীন-তাইওয়ান গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে চীনের অর্থনীতি ও বিশ্বজুড়ে তাদের প্রভাবকে ধ্বংস করতে চায়। তারচেয়ে বড় প্রশ্ন চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে বিশ্বে নতুন শক্তির মেরুকরণ ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা।
  
ন্যান্সি’র সফরকে ব্যবহার করে তারা কি সেখানে একটি গৃহযুদ্ধের পায়তারা করছে? কিন্তু চীনকে যে কোন মূল্যে গৃহযুদ্ধ এড়াতে হবে। তাদের এর বিকল্প নীতি-কৌশলে এগিয়ে যেতে হবে। বাণিজ্য, পর্যটন, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি ব্যবহার করে তাইওয়ানকে পুনরায় একত্রিত করার ৭ দশকের শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। মার্কিনের ফাঁদে পা দেয়া কোনভাবে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তবে তাইওয়ান যদি স্বাধীনতার দাবি জোড়ালো ভাবে উত্থাপন করে- সে হিসেব হবে ভিন্ন।      

চীনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হলে অবশ্যই তার জবাব দিতে হবে। তবে তার আগে চীনকে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা তাদের ট্রিলিয়ন ডলার সুরক্ষিত করতে হবে। তহবিল ফিরিয়ে আনতে হবে। বিকল্প সরবরাহ লাইন বিনির্মাণে বিনিয়োগ করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা অনেক পণ্য চীন, ব্রিকস বা বিআরআই দেশে তৈরি করার কথা ভাবতে হবে। চীনকে নিষেধাজ্ঞার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের চলমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য মার্কিনীরা ক্রমাগত রাশিয়াকে দোষারোপ করে যাচ্ছে কিন্তু নতুন করে সংকট তৈরী হলে সে জন্য কে বা কারা দায়ী থাকবে? ইউক্রেন সংকটের জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো দায়ী, তাদের সম্প্রসারণ রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণকে অনিবার্য করেছে। যার মূল্য শুধু এই দু’টি দেশকেই নয় গোটা বিশ্বকে দিতে হচ্ছে। এবং এ সংকটের শেষ কোথায় তা আজো অজানা। 

মার্কিন স্পিকার ন্যান্সি আজ তাইওয়ানের সংসদ সদস্যদের সাথে এক বৈঠকে বলেছেন, আমরা তাইওয়ানের সাথে বন্ধুত্বের কারণে এসেছি, আমরা এই অঞ্চলে শান্তি রক্ষা করতে এসেছি। 

তাইওয়ানের সাথে বন্ধুত্বের কথা বললে তো চীনের সাথে শত্রুতার সম্পর্ক হয়। সেটাই কি তাদের প্রয়োজন, এটাই তার সফরের এজেন্ডা? তারা এমনই বন্ধুত্ব ও শান্তি রক্ষায় বিশ্বের দেশে দেশে যান এবং বিশ্বে কেমন শান্তি ও সম্প্রীতির সুবাতাস বইছে তা আমরা দেখছি! শান্তির এমন ললিত বাণী- বিশ্বের সর্বত্রই পরিহাস হয়েছে।

ড. মঞ্জুরে খোদা, লেখক-গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর