২১ আগস্ট, ২০২২ ১৬:৫১

বঙ্গবন্ধুর কৃষি উন্নয়ন ভাবনা ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

প্রফেসর ড. মো. আবদুল বাসেত

বঙ্গবন্ধুর কৃষি উন্নয়ন ভাবনা ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

প্রফেসর ড. মো. আবদুল বাসেত

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যা রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনৈক পশ্চিম পাকিস্তানিকে বলেছিলেন, “পাকিস্তানের দুই অংশকে একত্রে রাখার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। কিন্তু ইয়াহিয়া খান সমস্যা সমাধানের জন্য সামরিক অ্যাকশনকে বেছে নিলেন এবং এখানেই পাকিস্তানের সমাপ্তি হলো। মুজিব আরো জানালেন যে, তাঁর মনে হচ্ছে তাকে হয়তো হত্যা করা হবে। কিন্তু তাঁর কবরের উপর দিয়েই সৃষ্টি হবে একটা স্বাধীন বাংলাদেশের (আমি বিজয় দেখেছি, পৃষ্ঠা-৩৪৩)।” ১৯৭১ সালে ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে কারাগারে বন্দি করে রেখেছিল কিন্তু হত্যা করতে পারেনি। কারণ ছিল আল্লাহর রহমত, দেশের ৭ কোটি মানুষের দোয়া আর ছিল সারা বিশ্বের শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি সমর্থন।

নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলো, বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেলেন, দেশে ফিরলেন, সরকার গঠন করলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে মন দিলেন। তিনি ভাবলেন এখন তাঁর কোনো শত্রু নেই, কেউ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে না। এখন শুধু কাজ আর কাজ, বাংলাকে কিভাবে সোনার বাংলায় পরিণত করবেন সেই কাজ। তিনি নিজের কথা ভাবতেন না, তিনি সরকারি বাসভবনে উঠলেন না, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের নিজ বাসভবন থেকেই সরকার পরিচালনা করলেন। কারণ তাঁর ছিল দেশবাসীর উপর অপার আস্থা-বিশ্বাস, মানুষের প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসা। ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রষ্ট ১৯৭১ সালে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আপনার শক্তি কোথায়? বঙ্গবন্ধুর উত্তর আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি। আর যখন জিজ্ঞেস করলেন আপনার দুর্বল দিকটা কি? বঙ্গবন্ধুর উত্তর আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি। সেই বঙ্গবন্ধুকেই তাঁর স্বাধীন দেশে হত্যা করল। ষড়যন্ত্রকারীরা সুযোগ নিল তাঁর ভালোবাসার। শুধু তাকে নয়, সপরিবারে হত্যা করা হলো। বিদেশে অবস্থানের কারণে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বেঁচে রইলেন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আর ছোট বোন শেখ রেহানা। আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছি, আমরা তাঁর জন্য শোকে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছি। দেশের ক্ষমতা চলে গিয়েছে শত্রুর দোসরদের হাতে, তারপরও আমরা ঘুড়ে দাঁড়িয়েছি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা দেশের হাল ধরেছেন। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত তার একটি বইয়ে লিখেছেন-ধরুন মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৭০ সালের কথা, একজন দরিদ্র নিম্নবিত্ত কৃষকের ১ বিঘা চাষের জমি আছে, হালের দুটি গরু আছে, চাষের জন্য লাঙল-মই-নিরানি আছে, আছে আগামী ফসলের জন্য সংরক্ষিত বীজ, আর সেই সাথে জরাজীর্ণ বসতভিটা। কিন্তু ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে শুধু চাষের জমি ছাড়া সবকিছু হারিয়ে তিনি সর্বশান্ত হয়ে গেলেন। জীবনে বংশপরম্পরা সৃষ্ট সম্পদ-সম্পত্তি ধ্বংস হয়ে গেল। আর সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে তার একজন তরতাজা যুব সন্তান শহিদ হলো অথবা চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেল। অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে ওই কৃষকটি কি জীবনে আর কোনোদিন আর কখনো পরিবার-পরিজনসহ উঠে দাঁড়াতে পারবেন? এমনকি দরিদ্র হলেও পারবেন কি আগের মতো ঠিক একই রকম দরিদ্র অবস্থাতেও ফিরতে? গ্রাম-শহর নির্বিশেষে বিশেষত গ্রামে ঠিক এরকমটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে বাংলাদেশের অবস্থা। হিমালয় পর্বতে আরোহণ করা যায়, সমুদ্রের তলদেশেও পৌঁছানো যায়, রকেটে করে চাঁদসহ বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহে যাওয়া সম্ভব কিন্তু সর্বশান্ত ওই কৃষকের মাজা সোজা করে উঠে দাঁড় করানোর পথ পদ্ধতি আছে কি? অন্তত প্রচলিত উন্নয়ন অর্থনীতি শাস্ত্রে নেই। আর প্রায় অসম্ভব, অতীত অভিজ্ঞতাহীন, দুরূহ এ প্রায়োগিক বাস্তব দায়িত্বটিই নিতে হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে।

এদেশের মাটি ও মানুষের বিশ্বস্ত সত্তার অবিনাশী নাম বঙ্গবন্ধু। খেয়ালী প্রকৃতির অনিবার্য অভিঘাতের সাথে কৃষকের কষ্টক্লান্ত অবয়ব বঙ্গবন্ধু খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। কৃষক আর মেহনতী মানুষের জন্য তার দরদি মনে প্রতিফলিত হয়েছে হৃদয়-নিংরানো নিখাদ ভালোবাসা। কৃষি ও কৃষকের অকৃত্রিম বন্ধু সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন এদেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে। তিনি কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে সোনার বাংলা নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন। তিনি সব সময় বলতেন “আমাদের চাষিরা হলেন সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণি এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে”।

সত্তরের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধু বলেন “আমার দল ক্ষমতায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দেবে। আর ১০ বছর পর বাংলাদেশের কাউকেই জমির খাজনা দিতে হবে না”। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কৃষি খাতে নানা যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ভূমি সংস্কার ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা রহিত করা হয়। খাস জমি বিতরণ করা হয় ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে। আশ্রয়হীনদের জন্য গড়ে তোলেন গুচ্ছ গ্রাম। গরিব কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের বাঁচানোর জন্য তাদের রেশনের আওতায় নিয়ে আসেন। পাকিস্তান আমলে নেয়া কৃষকদের সব ঋণ সুদসহ মাফ করে দেয়া হয়। প্রত্যাহার করা হয় ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা। এছাড়াও কৃষকদের মাঝে ১ লাখ হালের বলদ ও ৫০ হাজার গাভী সরবরাহ করেন ভর্তুকি মূল্যে। গরিব কৃষকদের মাঝে তিনি সহজ শর্তে ১০ কোটি টাকার ঋণ ও ৫ কোটি টাকার সমবায় ঋণ বিতরণ করেন।

বঙ্গবন্ধু প্রথম বাজেটে কৃষিখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। ২১ দফার প্রতিটা দফাই ছিল কোনো না কোনোভাবে কৃষি ও কৃষকের মঙ্গলকামি। বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়ন খাতের মধ্যে ১০১ কোটি টাকা রাখেন কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে। সেই বাজেট কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের মাইলফলক। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে তিনি প্রথম বাজেটে কৃষিখাতে ভর্তুকির ব্যবস্থা করেন। বাজেটে ভর্তুকি দিয়ে বিনামূল্যে কীটনাশক ও সার সরবরাহ করেন। ফলে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালে কৃষি উৎপাদন অতীতের যেকোনো সময় থেকে অনেক বেশি উৎপাদিত হয়েছিল। ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষিকর্মী নিয়োগ করেছিলেন। কৃষির উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। বন্যা ও খরার হাত থেকে কৃষককে রক্ষার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সরকারি ইজারাদারি প্রথা বিলুপ্ত করেন।

স্বাধীনতার পরপরই কৃষির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং নির্দেশনায় বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। ১৯৭২ সালে দেশে তুলার চাষ সম্প্রসারণ করার জন্য তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়। পুনর্গঠন করা হয় হর্টিকালচার বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি ও রাবার উন্নয়ন কার্যক্রম। বঙ্গবন্ধু কৃষি সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বীজ ও সার সরবরাহের প্রতিষ্ঠান বিএজিমিকে পুনর্গঠন সারাদেশে বীজকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। কৃষিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্য ১৯৭৩ সালে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৩ সালে কৃষিতে গবেষণা সমন্বয়ের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এবং নতুন নামে পুনর্গঠন করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। এগ্রিকালচার রিসার্চ ল্যাবরেটরিকে উন্নীত করেন বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট হিসেবে। এছাড়া তিনি ঈশ্বরদীতে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রতিষ্ঠা করেন আনবিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। মৎস্য ও পশু সম্পদের উন্নতির জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

কৃষি শিক্ষাকে মেধা-মননের চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ভাষণে তিনি কৃষি বিপ্লবের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন গ্রামের দিকে নজর দিতে হবে। কেননা গ্রামই সব উন্নয়নের মূল কেন্দ্র। গ্রামের উন্নয়ন আর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যখন বেগবান হবে তখন গোটা বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে সম্মুখপানে। মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের কৃষি শিক্ষায় আকৃষ্ট করে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার মানসে জাতির পিতা এসময় কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদা প্রদান করেন-যা প্রতিবছর কৃষিবিদ দিবস হিসেবে পালিত হয়। টেকনিক্যাল গ্র্যাজুয়েট হিসেবে ভাতা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের তিনি কৃষি বিপ্লব সফল করার আহ্বান জানান।

বঙ্গবন্ধুর এসব বাস্তবধর্মী ও কৃষক দরদি নীতির ফলে কৃষি ক্ষেত্রে অগ্রগতির যে ধারা সূচিত হয়েছিল, তারই ফলে আজ কৃষি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে দেশের মানুষ তিনবেলা পেট ভরে খেতে পারছে। মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য দেশ আজ শাকসবজি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ সারাবিশ্বে কৃষি উন্নয়নের এক অনুকরণীয় মডেলে পরিণত হয়েছে। ২০০০ সালে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করায় এফএও (FAO) বাংলাদেশকে সেরেস পুরস্কার প্রদান করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে এসেছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের মধ্যে শাকসবজি উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে। চাহিদা মিটিয়ে শাকসবজি রপ্তানি হচ্ছে এবং বিপুল সবজি রপ্তানির সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

অর্থনৈতিক উন্নতির অন্যতম উপায় সম্পদের সুষম বণ্টন। বঙ্গবন্ধু সম্পদের সুষম বণ্টনে উৎসাহিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু এক ব্যক্তির নামে ১০০ বিঘার উপরে জমি থাকাতে নিরুৎসাহিত করেছেন। অতিরিক্ত জমি ভূমিহীনদের মাঝে বণ্টন করে ভূমিহীনদের চাষাবাদ করার সুযোগ তৈরি করে দেন। এভাবে কৃষি উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছেন। পুঁজিবাদী সাম্যব্যবস্থা নিরুৎসাহিত করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্নের সোনার বাংলায় দেখতে চেয়েছিলেন দেশের কৃষি ও কৃষকের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন এবং স্বনির্ভরতা।

শত বাধা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে মডেল। খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে বাংলাদেশ এখন রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। মা ও শিশু মৃত্যু হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, মানসম্পন্ন খাদ্য গ্রহণসহ সকল মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ বিশ্বে একটি উদাহরণ। এসবই সম্ভব হয়েছে কৃষিতে সাফল্যের কারণে। আমরা স্বাধীন বলেই এগুলো অর্জন করেছি এবং এদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কৃষির অর্জন কমে যায়। তার যুগোপযোগী পদক্ষেপের মাধ্যমে তার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। আজ বাংলাদেশ ২০৩১ সালে উচ্চ-মধ্যম অর্থনীতিতে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এর জন্য আমাদের যে কোনো মূল্যে কৃষি উন্নয়নের মূল উপাদানের অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে হবে।

আজ স্বাধীনতার ৫১ বছরে বাংলাদেশে কৃষির অগ্রযাত্রা সারা বিশ্বের বিস্ময়। এই সাফল্যের পরিকল্পনা তৈরি করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, কৃষিপ্রধান দেশে কৃষির সম্পূর্ণ বিকাশ ও উৎকর্ষ ব্যতিরেকে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনে তিনি কৃষি বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমার মাটি আছে, আমার সোনার বাংলা আছে, আমার পাট আছে, আমার গ্যাস আছে, আমার চা আছে, আমার ফরেস্ট আছে, আমার লাইভস্টক আছে, যদি ডেভেলপ করতে পারি এই দিন আমাদের থাকবে না”।

সেই ডেভেলপমেন্টের সুফল পাচ্ছে দেশের মানুষ। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ার কারণে উৎপাদন বেড়েছে এবং বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। বর্তমান বিশ্ব চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে প্রবেশ করেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখতে হলে কৃষি ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ ঘটাতে হবে। এজন্য প্রয়োজন হবে দক্ষ জনশক্তি। কৃষিক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনশক্তি তৈরির ক্ষেত্রে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কৃষি গবেষণা ও কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন সব বিষয়েই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে রয়েছে। কৃষির উপর গুরুত্ব দিয়ে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় তেমনি একটি নতুন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

হবিগঞ্জের প্রাকৃতিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে এর চা বাগান, টিলা/পাহাড় এবং হাওর অঞ্চলকে কিভাবে কৃষি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কাজে লাগানো যায় সে বিষয়গুলো এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাধান্য পাবে। এই লক্ষ্যেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ বিভিন্ন অনুষদ ও ইনস্টিটিউট। হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটের প্রথম সভাতেই Precision Agriculture and Blue Economy, Cellular Agriculture, Haor and Hill Agriculture, Dairy and Poultry Science, Agricultural Business Intelligence and Data Science এবং Sustainable, Rsilient and Smart Farming নামে ইনস্টিটিউটের অনুমোদন দিয়েছেন-যেখানে কৃষিতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব করার উপযোগী টেকসই প্রযুক্তি উন্নয়ন ও দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব যা রবোটিক প্রযুক্তির সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তার নির্ভুল প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষিকে বহুমাত্রিক ক্ষেত্রে প্রসারিত করবে এবং স্মার্ট পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ফসলের নিখুঁত উৎপাদন কৌশলকে অনেক সহজ করে তুলবে। এ প্রযুক্তিটি সামান্য মানবিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে ডেটা থেকে রিয়েল টাইম পুনরুদ্ধার করে ফসল ব্যবস্থাকে অনেক সহজ করে দেবে, যা মানুষের পক্ষে করা অনেক জটিল ও সময় সাপেক্ষ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এপ্লিকেশনগুলোকে গ্রহণ করার জন্য সেন্সর IOT নেটওয়ার্ক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং তথ্যভান্ডার (Big Data) একত্র করে বিশ্লেষণপূর্বক নির্ভুলভাবে তা কৃষিতে প্রয়োগ করা হবে। ফলে উৎপাদন বাড়বে এবং উৎপাদন খরচ কমবে ফলে কৃষিতে আসবে নব জাগরণ। আজ বঙ্গবন্ধু নেই। তার সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। তার সঙ্গে আছি আমরা সাড়ে ষোল কোটি মানুষ।
জয় বাংলা।

লেখক : উপাচার্য, হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

বিডিপ্রতিদিন/এমআই

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর