১৮ অক্টোবর, ২০২২ ১৮:১৫

শেখ রাসেল : ঘাতকদের প্রতি ঘৃণা বর্ষিত হোক

ড. মতিউর রহমান

শেখ রাসেল : ঘাতকদের প্রতি ঘৃণা বর্ষিত হোক

ড. মতিউর রহমান

প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম একজন আইনজীবী হিসেবে ১৯৯৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা বিচারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে চলা মামলার প্রক্রিয়ায় জেলা জজ পর্যায়ে ৬১ দিন, হাইকোর্টে ৬৩ দিন, তৃতীয় বিচারকের বেঞ্চে ২৩ দিন এবং ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার গঠনের পর আরো ২৫ দিন শুনানি চলে। পরবর্তীকালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানান, মামলার দীর্ঘ শুনানিতে বাদী ও সাক্ষীদের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত চিত্র উঠে আসে। এর মধ্যে সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ছিল শিশু শেখ রাসেল হত্যার ঘটনাটি। সে কাহিনী শুনে মামলার শুনানির এক পর্যায়ে তিনি নিজেও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। 

সে ঘটনা প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকারে মাহবুবে আলম বলেছিলেন, “বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী মোহিতুল ইসলামের বক্তব্যে জানা যায় রাসেলকে যখন নিচে নামিয়ে এনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় তখন সে বার বার মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল। এক পর্যায়ে তাকে ভেতরে পাঠানো হয়। এর পরক্ষণেই শোনা যায় গুলির শব্দ। পরে ভেতরে গিয়ে দেখা যায় রাসেলের মরদেহ। একটি চোখ বের হয়ে এসেছে, মস্তিষ্ক ছিন্নভিন্ন। সেদিন এই বর্ণনা শুনে আমি আদালতে কেঁদে ফেলেছিলাম। একজন অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে কাঁদছেন এমন দৃশ্য হয়তো অনেককে অবাক করেছে। কিন্তু আমি আমার আবেগ ধরে রাখতে পারিনি।”

শুধুমাত্র প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে নয়, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের শিকার শেখ রাসেলের মৃত্যুর বর্ণনা যারা পড়েছেন বা শুনেছেন, তারাই ব্যথিত বা আবেগ-আপ্লুত না হয়ে পারেননি। কোনও বিবেকবান মানুষের পক্ষে শেখ রাসেলের মতো একজন নির্দোষ শিশুর এমন মর্মান্তিক মৃত্যুকে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আমরা জানি, শেখ রাসেল ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠতম সন্তান বা তৃতীয় পুত্র। মাত্র ১১ বছর বয়সে তাকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়। সে ছিল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। 

বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধাভোগী মহল, যারা এক সময় ইনডেমনিটি অ্যাক্ট জারি করে শেখ রাসেলের খুনিদের বিচারের ঊর্ধ্বে রাখতে কুণ্ঠিত হয়নি তারা বলে থাকে- বঙ্গবন্ধুকে রাজনৈতিক কারণে হত্যা করা হয়েছে। তাদের এই বক্তব্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, শেখ রাসেল তো রাজনীতি থেকে দূরে ছিল, তাকে কেন ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হলো? পৃথিবীতে যুগে যুগে অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মতো যেখানে শেখ রাসেলসহ নারী-শিশু পর্যন্ত রেহাই পায়নি এমন নির্মম, নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড কোথাও ঘটেছে বলে মনে হয় না।

মানবতাবাদী ব্রিটিশ দার্শনিক লেখক ব্রার্ট্রান্ড রাসেল ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রিয় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন। সম্ভবত বিগত শতকের ষাটের দশকের গোড়ায় কিউবাকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে মানবসভ্যতা বিধ্বংসী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশংকা দেখা দিয়েছিল। সেই সময় বিশ্ব মানবতার প্রতীক বার্ট্রান্ড রাসেলের প্রতিবাদী বিশেষ করে যুদ্ধ বিরোধী জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা দেখে সম্ভবত ব্রিটিশ দার্শনিকের প্রতি বঙ্গবন্ধু অভিভূত হয়েছিলেন। তাই তিনি দুবছর পর, অর্থাৎ ১৯৬৪ সালের ১৮ আক্টোবর জন্ম নেওয়া নিজের কনিষ্ঠপুত্রের নাম বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে রেখেছিলেন- রাসেল। জন্মের পর শিশু রাসেলকে পিতা হিসেবে যথেষ্ট সময় দিতে পারেননি বঙ্গবন্ধু। একে তো রাজনৈতিক ব্যস্ততা এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মিথ্যা অভিযোগ হয়রানি তো ছিলই, উপরন্তু বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে যেতে হয় কারাগারে। 

তখনকার কথা বলতে গিয়ে শেখ রাসেলের বড় বোন বর্তমান বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ শীর্ষক স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন, “আব্বা ওর জন্মের পর পরই জেলে চলে গেলেন। ছয় দফা দেবার কারণে আব্বাকে বন্দি করল রাসেলের বয়স তখন মাত্র দেড় বছরের কিছু বেশি। কাজেই তার তো সবকিছু ভালোভাবে চেনার বা জানারও সুযোগ হয়নি। রাসেল আমাদের সকলের বড় আদরের সবার ছোট বলে তার আদরের কোনো সীমা নেই। ও যদি কখনো একটু ব্যথা পায় সে ব্যথা যেন আমাদের সবারই লাগে। আমরা সব ভাইবোন সব সময় চোখে চোখে রাখি। ওর গায়ে এতটুকু আঁচড়ও যেন না লাগে। কী সুন্দর তুলতুলে একটা শিশু। দেখলেই মনে হয় গাল টিপে আদার করি।”

অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধুর কাছেও ছোটপুত্র ছিলেন অতি আদরের। বন্দি অবস্থায় তার সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা যখন দেখা করতে কারাগারে যেতেন তখন ছোট্ট রাসেলও থাকতো তাদের সঙ্গে।স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গবন্ধু যতটুকু সময় পেতেন তাকে অত্যন্ত আদর করতেন। বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘কারাগারে রোজনামচা’ বইটি পড়লে পিতা-পুত্রের মর্মস্পর্শী চিত্রের দেখা মেলে। ১৫ জুন ১৯৬৬, বুধবারে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “... সাড়ে ৪টায় জেলের লোক এসে বললো চলুন আপনার দেখা আসিয়াছে, আপনার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে বসে আছে জেল অফিসে। তাড়াতাড়ি রওয়ানা করলাম। দূর থেকে দেখি, রাসেল, রেহানা ও হাসিনা চেয়ে আছে আমার রাস্তার দিকে। ১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে একটুও হাসে না যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেলগেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বললো আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। ওর ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।”

“মাত্র এগারো বছরে পা রাখা শেখ রাসেলকে যারা কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন, তারাই বলেছেন- দারুণ প্রাণবন্ত এক বালক। বাইসাইকেল চালাতে পছন্দ করতো। এমন কী রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ছাড়াই সাইকেলে স্কুলে যাওয়া-আসা করতো। তাকে দেখে কেউ কোনো দিন ঘুণাক্ষরে টের পায়নি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী মহলের এক জঘন্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে হবে জাতির পিতার নিষ্পাপ এই শিশু সন্তানকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তার স্মৃতিচারণায় গভীর আক্ষেপ ব্যক্ত করে বলেছেন, “... আমি জার্মানিতে যাওয়ার সময় রেহানাকে আমার সাথে নিয়ে যাই। রাসেলকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ওর হঠাৎ জন্ডিস হয়, শরীর খারাপ হয়ে পড়ে। সে কারণে মা ওকে আমার সাথে যেতে দেননি। রাসেলকে যদি সেদিন আমাদের সাথে নিয়ে যেতে পারতাম তাহলে ওকে চিরতরে হারাতে হতো না।”

“১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেট কেড়ে নিল ছোট্ট রাসেলকে। মা, বাবা, দুই ভাই, দুই ভাবি, চাচা সকলের লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে ঘাতকেরা শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল রাসেলকে। ঐ ছোট্ট বুকটা কি তখন কষ্টে বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল? যাদের সান্নিধ্যে স্নেহ-আদরে হেসেখেলে বড় হয়েছে নিথর দেহগুলো পড়ে থাকতে দেখে ওর মনের কী অবস্থা হয়েছিল, কী কষ্টই না ও পেয়েছিল! কেন কেন কেন আমার রাসেলকে এতো কষ্ট দিয়ে কেড়ে নিল ঘাতকেরা? আমি কি কোনো দিন এই কেনোর উত্তর পাবো?”

স্বজন হারানো বঙ্গবন্ধু কন্যার এই প্রশ্নের সামনে সত্যিই বিবেকবান মানুষের মাথা হেট হয়ে আসে। তবে আমাদের ঘৃণা বর্ষিত হোক নিষ্পাপ শিশুর ঘাতকদের প্রতি। যেহেতু ওরা করেছে ক্ষমাহীন অপরাধ।

লেখক : সিনিয়র কমিশনার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং পরিচালনা পর্ষদ সদস্য সোনালী ব্যাংক লিমিটেড।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর