জার্মান রাইটার গ্যাটে কবিতায় ছড়িয়েছেন ভালোবাসার মাদকতা। প্রিয়তমার একপলক চাহনী আর তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দবর্ণকে তুলনা করেছেন পুরো পৃথিবীর জ্ঞান ভাণ্ডারের সঙ্গে। গ্যাটে লিখেছেন-
‘One glance - one word from you
gives more pleasure
than all the wisdom of this world.
সত্যিই ভালোবাসা বা love নিছক একটি শব্দ কিংবা ইংরেজি-বাংলা হরফের চারটি বর্ণ নয়। love হচ্ছে বিশুদ্ধ ও সংবেদনশীল চিন্তার দৃশ্যমান ভিত্তি। এটি ‘noun’ এর পাশাপাশি একটি ‘verb’।
আমরা সবাই ভালোবাসা পেতে চাই, ভালোবাসতে চাই। আমরা চাই deep love, genuine love এবং honest love. আমরা প্রত্যেকেই নিজের মত করে ভালোবাসতে চাই, নিজের মত করে ভালোবাসা পেতে চাই। platonic love (প্লেটোনিক লাভ) বা বায়বীয় ভালোবাসার কথা। যে ভালোবাসায় কোনো যৌনতার স্থান নেই। এটাই হচ্ছে ভালোবাসার সর্বোচ্চ স্তর। তখনি হ্দয়ে অনুভূত হয়- ভালোবাসা বুঝি এক স্বর্গসুখ। ভালোবাসার আবহ সৃষ্টি হয় প্রাথমিক ভাববিনিময়েই। রোমিও-জুলিয়েট /রাধা- কৃষ্ণ চণ্ডিদাস -রজকিনী / ইউসুফ-জুলেখা /লাইলী-মজনু /শিরি-ফরহাদকে এজন্যই ভালোবাসা অমরত্ব দিয়েছে। ভালোবাসার প্রথম স্তরেই আবিস্কৃত হয় স্বপ্ন সঙ্কল্প। সেকালের বাদাম- চকলেট/চটপটি -ঝালমুড়ি আর লালচে গোলাপ বা বেলীফুলের কদর আর নেই। আধুনিক জমানায় নামীদামী চাইনিজ- রেস্তোরাঁয় হরেকরকম সুস্বাদু খাবার। একটিদুটি গোলাপ হাতে কিংবা প্রিয়তমার খোপার বা গলার শোভা নয় শতপ্রকারের ফুলের রাজস্বী তোড়ার উপঢৌকনের ঠাঁই হয় বিলাসবহুল গাড়ির পেছনতাকে। যে কবিতা জীবনের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়; যে গানকে মতো হয় নিজের জীবনের সুর,মনোরম প্রকৃতির অপরূপ জোছনা তা সেকালের সংস্কৃতির হয়ে গেছে অপসংস্কৃতির ভিড়ে। ভালোবাসায় পহেলা বোশেখ-ফাগুন আর বসন্তদিনের সঙ্গে নতুনমাত্রা দিয়েছে, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস - বন্ধু দিবস- নারী দিবস - মা দিবস - বাবা দিবস ইংরেজি নববর্ষ। বাঙালির ভালোবাসায় যুক্ত বাংলা নববর্ষ -একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস - বিজয় দিবস-স্বাধীনতা দিবসসহ নানা দিবস। দিবসের তাৎপর্যের আভা ফুটে ওঠে কপোত-কপোতীর পরিহিত পাঞ্জাবি-শাড়িতে- রুপেরঙে খচিত হয় মানচিত্র কিংবা লালসবুজের রক্তে আঁকা পতাকা। জীবন এরকম সৌন্দর্যে উপলব্ধি করে ভালোবাসা জীবনের অপূর্ব আশীর্বাদ। এ ব্যতীত বুঝি জীবনই মরুভূমি।
নাগরিক ব্যস্ততা পরিবার পরিজন জীবিকা অর্থপ্রতিপত্তির কথা ভাবতে ভাবতে আমরা সরে যাচ্ছি সেই স্নিগ্ধসুন্দর মনমুগ্ধকর ভালোবাসা থেকে। শিক্ষিত মুর্খ নির্বোধ - জ্ঞানী-গুণী সবাই অশুভ পথের অভিযাত্রী। নিরাপদ আশ্রয় এখন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। আমরা কোথায় যেতে চাই কেনো যেতে চাই সেখানে কী আছে কিছুই জানি না। সবই ভাসাভাসা। শুধু ছুটে চলছে জীবন। ভালোবাসাহীন নিরাপদ জীবনে সাথী হয়েছে সামাজিক অবক্ষয় - অপসংস্কৃতি আর অসংবেদনশীলতা। সন্ত্রাস ধর্ষণ মাদক দুর্নীতি আর অপশক্তির নীল থাবায় মুড়িয়ে আছো আমাদের জীবন। বর্তমানের ভালোবাসার পালে উড়ছে আধুনিকতার নামে নানা প্রযুক্তি। মোবাইল কল কেনো ফ্রী হয়না ম্যাসেঞ্জার - হোয়াটসঅ্যাপ- ইমোতে কেনো কল ঢুকে না -কেন জ্বলে না সবুজ বাতি এ আকুতি প্রাণে সঞ্চারিত হয় ঠিকই কিন্তু প্রকৃত আমরা ভালোবাসার মানুষ কজন?
প্লেটনিক লাভ কিংবা বায়বীয় ভালোবাসা হলো বিশুদ্ধ ভালোবাসা। যে ভালোবাসায় কামনা বাসনার স্থান নেই। বিভিন্ন রকম ভালোবাসা হতে পারে। যেমন কুপোতকুপোতি ভালোবাসার সর্বোচ্চ স্তর অতিক্রম করবে কিন্তু শরীর নামক বস্তুটি থাকবে অনুপস্থিত। যে ভালোবাসা বা প্রেমে শরীর অনুপস্থিত থাকে অথচ ভালোবাসার স্বাদ রস আস্বাদন করা যায় ষোলআনা। এমন ভালোবাসাকেই প্লেটোনিক লাভ বা বায়বীয় ভালোবাসা বলে। এ ভালোবাসায় কাম গন্ধহীন। কেবল নিজেকে বিলিয়ে দেয় বিনিময়ে নেয়না কিছুই। দীর্ঘ প্রতীক্ষা দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্যশক্তি থাকতে হয় এজন্য। এহেন ভালোবাসায় ভাগ্যে বা কপালে জোটে " ব্যর্থ প্রেমিক বা ব্যর্থ প্রেমিকার অপবাদ। তারপরও এরকম ভালোবাসার মানুষেরা নিজের জীবনকে স্বপ্রনোদিত হয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে। ভালোবাসার এমন তীব্র রূপের নামই প্লেটনিক লাভ। এ এক অনন্ত অবিরাম ভালোবাসা। প্লেটোনিক লাভে যে সৌন্দর্য রয়েছে তাকে বলা হয় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। উচ্চ মানসিক ভালোবাসা সৌন্দর্যকে অনুভব করতে হলে মানুষকে প্রথমে মানুষ হতে হয়। লৌকিক ভালোবাসার সরোবরে অবগাহন করতে হবে। তাহলেই ইন্দ্রিয় অতিক্রম করে জীবনে সঞ্চারিত হবে নতুন দিশা বা নতুন দিগন্ত।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন