২১ নভেম্বর, ২০২৩ ১১:০২

যে আমাকে দুঃখ দিল সে যেন আজ সুখেই থাকে

মাকিদ হায়দার

যে আমাকে দুঃখ দিল সে যেন আজ সুখেই থাকে

মাকিদ হায়দার

মানুষের বিকাশ নদীতীর ঘিরেই। সেহেতু জীবনযাপনে নদীর ভূমিকা অপরিসীম থাকে মানুষের পাশে চিরকাল। অন্যদিকে নদীর মান-অভিমানে ভেঙেছে মানববসতি। বাংলার ছয় ঋতুতে গ্রীষ্ম-বর্ষা যেমন আছে তেমনি আছে শীত-বসন্ত। সঙ্গে আছে মানবপ্রেম। সমুদয় নিয়ে।

আজ বেকারত্বের অভিশাপ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য অনেকের মতো আমিও এক দিন চলে এসেছিলাম পাবনা থেকে ঢাকা নগরীতে। ছিলাম গন্ডগ্রামে, সেই গ্রামেই ছিল আমার পছন্দের একজন।

ঢাকায় এসে যার বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম তিনি ছিলেন প্রেমিক ভ্রমর, দুর্ভাগ্যবশত পাননি প্রেমিকাকে। মাস দুয়েকের ভিতর আমি অবশ্য ভেবেছিলাম প্রেমিকাকে নিয়ে আসব দোহারপাড়া থেকে। তিনি এখনো জানাননি তার অভিমত। ভাগ্যচক্র নিয়ে মানুষের উৎসাহ যেমন আছে, যেমন থাকে আমারও তেমনি ছিল, তাই এক দিন দুরুদুরু বুকে এক হস্তরেখাবিদের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন, তোমার জন্ম যেহেতু আজকে, তাই প্রেমের দেবতা শুক্রাচার্যের আশ্রয়ে নেই তুমি, তাই তিনি তোমার প্রতি কৃপাণ। যদিও কার্তিক মাসের ২ তারিখে যেহেতু তোমার জন্মগ্রহণ সেহেতু তোমাকে ফেরাতে হবে দোহারপাড়ার সেই মেয়েটির প্রতি দুর্বলতা। যেতে হবে অন্য প্রেমিকার সন্ধানে। হঠাৎ বোশেখের তান্ডবে নতুন প্রেমিকা বোশেখের দুই হাত ধরে এক দিন চলে গেল চোখের আড়ালে। তারপরও আমার প্রায়শই মনে হয় এক দিন দুজনের দেখা হবে আমাদের রৌদ্র ছায়ায়। জীবনে পথ চলার পথে অনেক কিছুই চলমান থাকে। যাকে এক দিন ভালো লেগেছিল প্রথম জীবনে তাকেই অনেকেই আরাধ্য মনে করেন অনেক প্রেমিক-প্রেমিকা। হোক সে শত জননীর জননী, অথবা শত জনক। প্রথম ভালোবাসা, ভালোবাসা প্রেম কেউ ভুলতে পারে না বলেই আমার বিশ্বাস। কবি উপন্যাসিক নাট্যকার এমনকি গল্পে কীভাবে দুজনের জীবনের প্রেম, সুসম্পর্কের প্রাণ পেয়েছে গল্পকারের গল্পে। বলা যেতে পারে ওই না পাওয়ার মাঝখানে দুটি হৃদয় দোদুল্যমান এমনকি প্রেম হাহাকারপূর্ণ ওই হৃদয় মাজারে সর্বক্ষণই থাকে। দেখা যদি একবার হয় ওইসবের মধ্যেই বেঁচে থাকার বিশ্বাস এবং নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় সব প্রেমিক-প্রেমিকাকে। যে কোনো কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রেম প্রেম শব্দটি পৃথিবীতে এসেছে লক্ষ-কোটি বছর আগে। বিবিধমাত্রায় প্রকাশ পায় নারী-পুরুষের মধ্যে। এমনকি মানুষের বিভিন্ন চর্চার ভিতরে সম্পর্ক ও সম্পর্কহীনতা। শুধু প্রেমিক-প্রেমিকাকে সঙ্গ দেয় দিবারাত অনুভবে। অনুরূপভাবে প্রেমিকা প্রেমিক আবার নিঃসঙ্গ করে থাকে উভয় উভয়কে। প্রেম বহুমাত্রিকতায় প্রকাশিত। নির্মাণ, ভাঙন এবং সংস্কৃতির একাংশ চিরকালের এবং চিরদিনের।

আদম ছিলেন প্রথম পুরুষ। বিবি হাওয়া ছিলেন প্রথম নারী। তাঁদের কবে কোথায় দেখা হয়েছিল সেটি সঠিক কেউ বলতে পারেনি। তবে অনেকের ধারণা। প্রথম দেখা হয়েছিল আরাফাতে। আবার কারও কারও অভিমত অন্য কোথাও। তবে লাইলি-মজনু অথবা শিরি-ফরহাদ তাঁদের চারজনকে নিয়ে অনেক গল্প কবিতা উপন্যাস রচিত হয়েছে। প্রাধান্য বা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রেমকেই। এমনকি আরবি কবিদের ভিতরে ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া ছিলেন সেই সময়ের একজন প্রখ্যাত কবি। আরব কবিদের নিয়ে যে আরবি কবিতা বেরিয়েছিল তার অনুবাদক ছিলেন কবি আবদুস সাত্তার। এ ছাড়াও ইউরোপ আমেরিকা এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার কবিদের নিয়ে গত শতকে বেরিয়েছিল একাধিক পাওয়া না পাওয়ার প্রেমের কবিতা।

আমাদের আরিপপুরের মগবের আলী সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির ছাত্র অবস্থায় তার পিতা ছিলেন পাবনা জজ কোর্টের পিয়ন, জজ সাহেবের পাখি শিকারের অভ্যাস ছিল। তিনি একবার যমুনায় পাখি শিকারে গিয়েছিলেন মগবের আলীর পিতাকে নিয়ে। সেবার যমুনায় ঝড়ে মগবের আলীর পিতা এবং জজ সাহেব মাঝিমাল্লাসহ জনা চার-পাঁচেক যমুনায় ডুবে মারা গিয়েছিলেন। জজ সাহেব সাঁতরে কূলে উঠলেও অন্যরা উঠতে পারেননি। পরবর্তীতে জজ সাহেব দয়াপরবশত মগবের আলীকে পিয়নের চাকরি দিয়েছিলেন ৫০ দশকের গোড়ার দিকে। সবই আমার মায়ের থেকে শোনা। সেই মগবের আলী দোহারপাড়ার এক মুদিদোকানের মালিকের মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন এবং পরবর্তীতে দুই পক্ষের সম্মতিতে বিয়ে হয়েছিল। মেয়েটি ছিল অপরূপ কালো।

আমার পড়ালেখার জীবনে তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক উপন্যাস পড়লাম, ‘কালোই যদি মন্দ তবে চুল পাকিলে কান্দে ক্যান’। মগবের আলীকে আমাদের এক আত্মীয় জিজ্ঞাসা করেছিল সরকারি চাকরি যেহেতু কর, অনেক সুন্দরী মেয়ে পেতে- তার কথার উত্তরে আলী নাকি বলেছিল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী আমার হবু স্ত্রী। আমার দুই চোখ দিয়ে যদি আপনি তাকে দেখতেন, এই কথা শোনার পরে আমাদের আত্মীয়টি দ্বিতীয়বার আর কথা বাড়াননি। মগবের আলী ইচ্ছা করলে মেয়েটিকে ফাঁকি দিতে পারতেন। আলী সেটি করেননি যেহেতু তাদের দুজনেরই প্রেম ছিল গভীর থেকে গভীরতর।

প্রেমপ্রীতি, ভালোবাসা, ভালোলাগা, প্রতিটি মানুষের ভিতরে একসময় জাগ্রত হয়। প্রকৃতির নিয়মে প্রেমিক যদি কবি হন তাহলে তার কাছে সবকিছুই সুন্দর। কালো, ফরসা যাই হোক না কেন, নিজের অনুভূতি সবচেয়ে ভালো। ৫০ দশকের শেষ দিকে আমরা যারা পাবনা জিলা স্কুলের ছাত্র ছিলাম পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন পাবনা জিলা স্কুলের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন মৌলানা কসিমউদ্দিন আহমদ। তিনি পাজামা আসকান এবং মাথায় জিন্নাক্যাপ দিয়ে তার প্রিয় সাইকেল নিয়ে গোপালপুর জিলাপাড়া দিলালপুর এবং লাহিড়াপাড়া থেকে ক্লাস থ্রিতে এনে ভর্তি করতেন। কাচারিপাড়া বাদশা, জিয়াপাড়ার আমাকে অশোককে জিলা স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন ১৯৫৬ সালে তৃতীয় শ্রেণিতে। তখন আমরা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র, হেড মৌলানা কসিমউদ্দিন স্যার এক দিন আমাদের এসে গুনে দেখালেন সব ছাত্র আছে কি না, যে শিক্ষক আমাদের ক্লাস নিচ্ছিলেন, তাকে বললেন আপনি পেছনের বেঞ্চে গিয়ে বসুন। আমি ছাত্রদের কাছে একটি প্রশ্ন করব। ক্লাস শিক্ষক পেছনের বেঞ্চে গিয়ে বসতেই আমাদের ক্লাসের ফার্স্টবয় তাকে মৌলানা স্যার জিজ্ঞেস করলেন, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দেশ কোনটি? ফার্স্টবয় বলল পাকিস্তান। উত্তরে স্যার খুশি না হয়ে ছাত্রটিকে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন বেঞ্চের ওপরে। দ্বিতীয় ছাত্রটিকে ওই একই প্রশ্ন করায় সে বলল  ঢাকা। তার কপালে জুটল নেইল ডাউন। তৃতীয় ছাত্রটির বাবা ছিলেন পাবনা জেনারেল হাসপাতালের বড় ডাক্তার। তৃতীয় ছাত্রটি জানাল পৃথিবীর সবচেয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ দেশ লন্ডন।

আমার মামা থাকেন লন্ডনে। ডাক্তারি পড়েন। তৃতীয় ছাত্রটির কপালে জুটল দুই কান ধরে ৩ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ। আগের দুই ছাত্রকে যথারীতি পূর্বের শাস্তির মেয়াদ শেষে ওদের দুজনকে বসতে বললেন তৃতীয় জনকে মিনিট তিনেক পরে বসার অনুমতি দিয়ে স্যার বললেন, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জায়গা হচ্ছে জন্মভূমি, এই যেমন আমি উল্লাপাড়ার এক অজপাড়াগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেছি। সেই গ্রামই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জায়গা। জন্মভূমি এবং দেশ কখনোই তার সন্তানদের অবহেলা করে না। তোরা মনে রাখবি কথাগুলো। সেই কবে স্কুল জীবন ছেড়ে এসেছি, কথাগুলো এখনো মনে আছে।

আজকাল অনেক প্রবাসী তারা বাংলাদেশকে নিয়ে নাক সিটকায়, তাদের কাছে ইউরোপ-আমেরিকা, কানাডা অনেক ভালো, ছি-ছি। এমনকি বাংলাদেশের অনেক ছেলে প্রবাসী থেকে টেলিফোনের মাধ্যমে বিয়ে করেন, কিন্তু সেই স্ত্রীকে অনেক সময় আর বিদেশে নিয়ে যেতে পারেন না। আমার জানা আছে, কয়েকটি পরিবারের মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। যাদের স্বদেশের প্রতি কোনো মায়া মমতা নেই। তারা আমার অভিধায় অমানুষ। এবার অন্য প্রসঙ্গ। পৃথিবীর আদিতেই প্রেম ভালোবাসা ছিল, আছে এবং থাকবে।

ফরাসি কবি শার্লে বোদলেয়ার একজন তরুণীকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে ছিলেন, তরুণীর নাম মাদাম সারাতিয়ে। সেই মাদাম শার্লে বোদলেয়ারকে না জানিয়ে অন্য একটি ছেলের গৃহিণী হয়েছিলেন। দুঃখের বিষয় বোদলেয়ারের বন্ধু ছিলেন সেই তরুণটি। অনুরূপভাবে টিএস ওলিয়টের বন্ধু ছিলেন বারট্রার্ন্ড রাসেল, ওই একই ঘটনা না ঘটলেও প্রায় ঘটতে থাকার আগে রাসেল নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন, আমাদের রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রায় বউদি কাদম্বরী দেবী সম্পর্কে অনেকের ভুল ধারণা আছে। বিষয়টি হলো কাদম্বরীর স্বামী জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলেন কাদম্বরী। চিঠিটি লিখেছিলেন নটী বিনোদনী। জ্যোতিকে সেই চিঠিতে লিখছিলেন ‘তোমার একটি সন্তান আমার গর্ভে’ কাদম্বরী চিঠি পেয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আত্মহত্যার। তবে আমরা যারা সাধারণ পাঠক তাদের অনেকেরই ধারণা, দেবর রবিঠাকুরের প্রতি তার বিশেষ ভালোলাগা ছিল।

অনুরূপভাবে বলা যেতে পারে কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা। তিনি প্রেমিক ছিলেন এ কথা আমরা সবাই জেনেছি। বিশেষত তাঁর গানে। ঢাকার পুরানা পল্টনে একটি হিন্দু মেয়েকে তাঁর ভালো লেগেছিল। অনুরূপভাবে মেয়েটির। তবে সে যাত্রায় নজরুল প্রহৃত হয়েছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু এবং কবি অজিদ দত্তর কাছে। পরবর্তীতে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয়েছিল কুমিল্লায়। বিয়ের রাতেই কবি জেনে গিয়েছিলেন হবু স্ত্রীর অন্য একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম আছে।

ফলশ্রুতিতে বিয়ের আসর থেকে সারারাত মাঠে একা একা পায়চারি করেছিলেন। মেয়েপক্ষ তখন জানিয়েছিল নজরুল মানসিক ভারসাম্যহীন। পরে কবি বিয়ে করেছিলেন কুমিল্লার মেয়ে প্রমীলা দেবীকে। এবার একটু অন্য প্রসঙ্গ, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত ১৯৭৩/৭৪ সালে ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকায় আমার একটি পদ্য ছাপা হয়েছিল- পদ্যটির নাম ছিল ‘যে আমাকে’ সেই দীর্ঘ কবিতায় একটি দীর্ঘ চরণ ছিল যে আমাকে দুঃখ দিল সে যেন আজ সুখেই থাকে।

মুমু জেসমিন, শামীমা, মিলু এরা সবাই বলেছিলেন কবি হলো ছন্নছাড়া, ঘর করা যায় না কবির সঙ্গে। অতএব ওইদিন। এখন ভাবি ভালোই হয়েছে, আমি প্রায় উচ্চতায় ৬ ফুট। আর উনারা ছিলেন উচ্চতায় বেশ ছোট। তবে সবাই এখন প্রবাসী। তিনজন স্বামীহারা তবু বলি- সুখে থাকুন।

লেখক : কবি

 


বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর