৭ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১০:২১

লেবাস পরা ওরা কারা?

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

লেবাস পরা ওরা কারা?

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

গতকাল ছিল ৬ ডিসেম্বর। এ দিনটি আমাদের ইতিহাসে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১৯৭১ সালের সেই দিনটিতেই ভারত এবং ভুটান স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেছিল। সেই স্বীকৃতি ’৭১ সালে যে কত প্রয়োজনীয় ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সেই স্বীকৃতির কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে। পাকিস্তান কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিতেও সেই স্বীকৃতি বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

আমাদের স্বাধীনতায় ভারতের অবদানের জন্য সেই দেশটির প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা কখনো ম্লান হবে না। সেদিন ভারত এগিয়ে না এলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কোথায় গিয়ে ঠেকত, আন্দাজ করা সহজ নয়। সে কথা স্বয়ং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশের পথে দিল্লিতে সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতি করে সেখানে জনসমুদ্রের কাছে কৃতজ্ঞতা ভরে উল্লেখ করেছিলেন। পরবর্তীতেও বহুবার তিনি ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতার কথা বলেছেন। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যে রক্ত দিয়ে লেখা, সে কথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা সব সময়ই বলে থাকেন। কিন্তু যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি তাদের মনে ভারত বিদ্বেষ প্লেগ রোগের মতোই বিরাজমান। মুক্তিযুদ্ধকালেও বেশ কিছু লোক স্বাধীনতাবিরোধী ছিল। তাদের মধ্যে যারা এখনো জীবিত আছে এবং তাদের বংশধররা এখনো এ জন্য ভারতকে সহ্য করতে পারছে না। শুধু একটি কারণেই যে, ভারত আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুখ্য সহায়ক হিসেবে অবদান রেখেছিল। পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় তারা আজও মেনে নিতে পারছে না। তাই ভারত বিরোধিতা। তাদের বুকে তখন রক্তক্ষরণ হয়েছিল।

কদিন আগে অস্ট্রেলিয়ার কাছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলায় ভারত পরাজিত হলে, আমার মন যেমন খারাপ হয়েছিল, আশা করেছিলাম তেমনি অনুভূতি হবে সব বাংলাদেশির। কিছু লোক, যারা স্বাধীন বাংলাদেশকেই মানে না, ভারতের পরাজয়ে তারাই উল্লসিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এসব পাকিস্তানপ্রেমী এমনকি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তান বিজয়ী হলেও আনন্দিত হয়, কারণ তাদের আনুগত্য পাকিস্তানের দিকে। ভারত অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে যাওয়ায় সংখ্যাধিক্য বাংলাদেশি ব্যথিত হলেও মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ ভারতের পরাজয়ে উৎফুল্ল হয়েছিল। এই জনসংখ্যাকে মজ্জাগত ভারতবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করতে ভুল হয় না। এরা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে বা গণহত্যায় সমর্থন দিয়েছে। এরা যে শুধু জামায়াতে ইসলামেরই লোক তা নয়, এদের সঙ্গে মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, কট্টর চীনপন্থিও ছিল। শুধু শাহ আজিজই নয়, যাদু মিঞা, সলেমান, ডা. মালেক, সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, তার ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মোহন মিয়া, কর্নেল মোস্তাফিজ, বিচারপতি সাত্তার, আবদুর রহমান বিশ্বাস, হামিদুল হক চৌধুরী, মার্শাল তোয়াবসহ অনেকেই স্বাধীনতাযুদ্ধ রুখে দেওয়ার জন্য সবই করেছিলেন। তালিকা খুব ছোট নয়। পর্দার আড়ালে থেকে যারা পাকিস্তান রক্ষা করতে সচেষ্ট ছিল, তাদের সংখ্যাও কম ছিল না। অনেকে ছদ্মবেশে আওয়ামী লীগ নেতা সেজে গোপনে পাকিস্তান রক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন। খোন্দকার মোশতাক, জহুরুল কাইউম গং যে কলকাতায় বসেই পাকিস্তান রক্ষার জন্য কলকাতার মার্কিন কনস্যুলেট অফিসের প্রধান জোসেফ ফারল্যান্ডের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল, সে কথা খোদ হেনরি কিসিঞ্জারই তার পুস্তকে উল্লেখ করেছেন।

সেই ’৭১-এর পরাজিত অপশক্তি দল বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াকে ত্রাণকর্তা হিসেবে পেয়ে তার ছত্রছায়ায় একত্রিত হয়েছিল পাকিস্তানের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার মিশন নিয়ে। যার প্রমাণ বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক মিনিটের মধ্যেই পাওয়া যায় খুনি ডালিমের বেতার ঘোষণা থেকে যখন সে বলেছিল বাংলাদেশ এখন ইসলামিক প্রজাতন্ত্র। পাকিস্তানও একই সুরে একই কথা প্রচার করেছিল।

জিয়া, এরশাদ এবং পরবর্তীতে খালেদার নেতৃত্বে সেই পাকিস্তান জিন্দাবাদের অপশক্তি একটানা ২১ বছর বন্দুকের জোরে দেশের কর্তৃত্বে থেকে সেই স্বাধীনতা বিরোধীদের লালন করে আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করায় এদের উত্তরসূরিরা এমনি শক্তি পেতে থাকে যে, পাকিস্তান প্রীতির কথা তারা রাখঢাক না রেখেই বলতে থাকে। ঢাকার পাকিস্তান দূতাবাস তাদের অর্থ প্রদানসহ সব সহায়তা প্রদান করতে থাকে, যা করতে গিয়ে তাদের দুজন কূটনীতিক হাতেনাতে ধরা পড়লে তাদের বহিষ্কার করা হয়। শুধু যে ধর্মান্ধ দলগুলোই পাকিস্তান ফিরে যাওয়ার পক্ষে কাজ করছে তা নয়, মূলত বিএনপির শীর্ষ নেতারাও একই ধারণার লোক। এদের বড় অংশ রাজাকারদের বংশধর, যে কথা প্রমাণিত।

২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সদস্যরা আমাদের আইন ভঙ্গ করে মিরপুর স্টেডিয়ামে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করলে তার প্রতিবাদে ভেঙে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধপন্থি বিশাল জনতা। কিন্তু তখন পবিত্র সংসদে দাঁড়িয়ে এক বিএনপি সদস্য নির্লজ্জের মতো পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের সমর্থন করে তার এবং তার দলের পাকিস্তানের প্রতি প্রকাশ্য আনুগত্য প্রমাণ করেছে। অস্ট্রেলিয়ার কাছে ভারত হেরে যাওয়ার পর যারা মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আনন্দ করেছে, তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। তাই তাদের উদাহরণ হিসেবে সামনে রেখে এটা বলার কোনো সুযোগ নেই যে, বাংলাদেশের মানুষ ভারতের পরাজয়ে খুশি হয়েছে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ভাষায় বাংলাদেশে বেশ কিছু বাংলাভাষী পাকিস্তানি বসবাস করে। এসব বাংলাভাষী পাকিস্তানিই ভারত হেরে যাওয়ায় আনন্দিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রকৃত বাঙালিরা খুশি হয়নি। কয়েকটি চিহ্নিত ইউটিউবার আছে ভারত বিদ্বেষ ছড়ানোই যাদের একমাত্র কাজ। এদের মধ্যে পাকিস্তানি কয়েকটি ইউটিউব চ্যানেলও রয়েছে। এরা যে পাকিস্তানের আইএসআইর অর্থপ্রাপ্ত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এদের সঙ্গে রয়েছে কিছু ওয়াজ ব্যবসায়ী যারা আজও বাংলাদেশকে মানতে পারছে না। অনুপাতে এরা গোটা জনসংখ্যার ১০-১৫%-এর বেশি নয়। ১৯৭১ সালেও স্বাধীনতার বিপক্ষে লোকের আনুপাতিক হার একই ছিল। বিভিন্ন অপরাধ করে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে বিদেশে বসেও ইউটিউবের মাধ্যমে ভারতবিদ্বেষ এবং সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছে কয়েকজন ফেরারি আসামি। এদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য গৌরী সেনদের অভাব নেই। তারা পাকিস্তানি প্রভুদের নির্দেশ পালন করছে। উদ্দেশ্য একটাই, বাংলাদেশের মানুষের মন থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাৎ করে পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার পথ তৈরি করা, যেটি ’৭৫ সালে জিয়া-মোশতাক করতে চেয়েছিলেন। তাদের প্রকাশ্য উসকানিতে পূজার সময় কিছু দুর্বৃত্ত পূজামণ্ডপ আক্রমণ করে মূর্তি ভাঙচুর করছে, নির্বাচনকালে হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মের লোকদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। তবে তারা আপামর জনসাধারণের মধ্যে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। নিশ্চিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকের অনুপাত অনেক বেশি। পশ্চিম বাংলায়ও কিছু সামাজিক মাধ্যম ভুল করে বলে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশের লোক ভারত হেরে যাওয়ায় খুশি হয়েছে। তারা বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা থেকেই এ ধরনের কথা বলছেন। বিষয়টি গভীরভাবে দেখলে তাদের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, বাংলাদেশিরা ভারতবিদ্বেষী নয়, ভারতের পরাজয়ে তারা উৎফুল্ল হয়নি, হয়েছে সে সব বাঙালি যাদের আনুগত্য পাকিস্তানের প্রতি, যারা সংখ্যায় নগণ্য।

অনেক ভারতবিদ্বেষী ঘাপটি মেরে আওয়ামী লীগের মুখোশ ধারণ করে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল’ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের এক আলোচনাসভায় মাসুম বিল্লা নামক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের এক অধ্যাপক ’৭১-এ ভারতীয় সৈন্যদের দখলদার বাহিনী বলার মতো ধৃষ্টতা দেখিয়েছিলেন। কড়া প্রতিবাদের মুখে মাসুম বিল্লার সেই উক্তি এক্সপাঞ্জ করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে কর্মরত এক কর্মকর্তা, যাকে পরবর্তীকালে খালেদা জিয়া জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সদস্য পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন, তার পুত্র, যিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন অধ্যাপক, তিনি সুযোগ পেলেই টকশোতে ভারতবিদ্বেষী কথা বলতে থাকেন। তাছাড়া একটি বিদেশি পত্রিকায় তিনি এই মর্মে লিখেছিলেন যে, বর্তমান সরকার ভারতকে খুশি করার জন্য আলেমদের গ্রেফতার করছে। এ অধ্যাপককে প্রায়ই আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুষ্ঠানসমূহে দেখা যায়। যতটুকু জানতে পেরেছি তা হলো, এই যে ভারতে তার প্রবেশের ওপর সে দেশের সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর মৃত্যুর পর এক বিরাটসংখ্যক ছাত্রলীগ সদস্য কর্তৃক সাঈদীর প্রশংসার ঘটনা প্রমাণ করে যে, গোপনে কত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী লোক আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়েছে। যারা ধর্মান্ধ দলগুলো বা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাদের চিনতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু যারা আওয়ামী লীগের লেবাস পরে তাদের গোপন এজেন্ডা কার্যকর করতে এগিয়ে যাচ্ছে, তাদের চেনা কঠিন। এসব ঘাপটি মেরে থাকা লোকদের মুখোশ উন্মোচন করার জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা। যারা মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করে তাদের অন্যতম গুরু দায়িত্ব হচ্ছে গণসচেতনতা প্রসারের জন্য অক্লান্তভাবে কাজ করে যাওয়া যাতে পাকিস্তানপ্রেমীদের স্বপ্ন কখনো সফল না হয়।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

 

বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর