১৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:১৮

‘মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে’ শুনে নিয়াজি আত্মসমর্পণে রাজি

সোহেল সানি

‘মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে’ শুনে নিয়াজি আত্মসমর্পণে রাজি

সোহেল সানি

‘ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কমান্ড শব্দের ব্যবহার এবং আত্মসমর্পণের স্থান নিয়ে আমাদের আপত্তি ছিল, কিন্তু ভারতীয় বাহিনী হুমকি দিল প্রস্তাবে রাজি না হলে আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে এবং তারা আমাদের হত্যা করবে। এ হুমকিতে আমরা তাদের শর্তে আত্মসমর্পণে রাজি হই।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। আমি কাঁপা হাতে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করি। তখন আমার অন্তরে উত্থিত ঢেউ দুই চোখ বেয়ে অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ে। অনুষ্ঠানের একটু আগে একজন ফরাসি সাংবাদিক এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এখন আপনার অনুভূতি কী, টাইগার?” জবাবে বললাম, আমি অবসন্ন। যার কাছে আমার আত্মসমর্পণ, সেই জেনারেল অরোরা আমার পাশেই ছিলেন। তিনি মন্তব্য করলেন, “এক চরম বৈরী পরিবেশে তাকে এক অসম্ভব দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। কোনো জেনারেলই এ পরিস্থিতিতে এর চেয়ে ভালো করতে পারত না”।’

উপর্যুক্ত কথাগুলো লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজির। তিনি সেই ব্যক্তি যাকে এমন এক অপারেশনের নেতৃত্ব দিতে হয়েছিল, যেখানে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তার আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বুকে স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’ নামে রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। নিয়াজির মৃত্যু ২০০৪ সালে। নিয়াজি ‘দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ শীর্ষক যে বই লিখেছেন তাতে একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের জন্য দায়ী ঘটনাবলি সম্পর্কে নিজস্ব অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। পরাজিত খলনায়ক নিয়াজি আত্মপক্ষ সমর্থন করে অবশ্য বলেছেন, ‘আমাকে যে দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে তাতে আমার কোনো হাত অথবা ইচ্ছা ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আমাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে আমি বিচলিত হয়ে পড়ি। তখন আমার সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। এক. পশ্চিম পাকিস্তানকে হারানোর ঝুঁকি নেওয়া অথবা দুই. আমার সুনাম ও ভবিষ্যৎ এবং পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর মহান ঐতিহ্য বিসর্জন দেওয়া। পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষায় প্রেসিডেন্টের নির্দেশে আমি শেষোক্ত পথই বেছে নেই।ণআমি চরম বিশৃঙ্খল ও সমস্যাসংকুল একটি দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম। দুজন সিনিয়র জেনারেল বিভিন্ন অজুহাতে দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। বিদ্রোহের আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠামাত্র একজন পদত্যাগ করেন এবং আরেকজন পরিস্থিতি জটিল করে তোলেন। সেনাবাহিনীর এই তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ গ্রহণ করার সময় সিনিয়রিটিতে আমি ছিলাম দ্বাদশ। তবু আমাকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়। এতে আমি আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি। কিন্তু আমি আমার সম্মান ছুড়ে ফেলে দিয়ে জাতীয় স্বার্থে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করি। আমরা আমাদের নেতাদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছি। নেতারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রক্তপাতের পথ বেছে নিয়েছেন। রোমান সম্রাটরা যেভাবে মল্লযোদ্ধাদের লড়াই দেখতেন, আমাদের নেতারা ঠিক সেভাবেই যুদ্ধ ক্ষেত্রের বাইরে দাঁড়িয়ে এ রক্তপাত দেখে তৃপ্ত হয়েছেন। আমি বাঙালির সাফল্য কামনা করি এবং আশা প্রকাশ করি, আমাদের কালে না হলেও আমাদের নাতিপুতিদের কালে হলেও এ ক্ষত নিরাময় হবে এবং বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে দুটি দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে।’

জেনারেল নিয়াজি জেনারেল রাও ফরমান আলি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘জেনারেলদের মধ্যে একমাত্র ফরমানের আচরণ নাটকীয়ভাবে বদলে যায়... তার চোখমুখ থেকে ভীতি ও হতাশা দূর হয়ে যায়। ২৫ মার্চের সামরিক অভিযানে জড়িত থাকায় তার প্রতি বাঙালিদের ক্রোধ ও ঘৃণা জন্ম নেয়। তাকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়। একটি প্রচন্ড ভীতি গ্রাস করায় ফরমান চেয়েছিলেন পালাতে।
জেনারেল মানেকশ আমাদের জানান, একটি ভারতীয় প্রতিনিধি দল আত্মসমর্পণের দলিলপত্র চুড়ান্ত করার জন্য ঢাকা আসছে। বিশাল পাখা ঝাপটে একটি ভারতীয় হেলিকপ্টার ঢাকা বিমানবন্দরে চক্কর দিতে থাকে। ইন্ডিয়ান ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব তাঁর প্রতিনিধি দল নিয়ে হেলিকপ্টার থেকে বেরিয়ে আসেন। পাকিস্তানি সিওএস ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকি তাদের ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দফতরে নিয়ে আসেন। জ্যাকবের কাছে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের একটি খসড়া দলিল। জেনারেল জামশেদ, জেনারেল ফরমান ও অ্যাডমিরাল শরিফের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য বাকিরকে নির্দেশ দিই। ১৪ ডিসেম্বর গভর্নর (ডা. এ এম মালিক) পদত্যাগ করায় বেসামরিক কর্মকর্তারা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিরাপদ আশ্রয় নেন। জেনারেল জ্যাকবের কাছে দুটি শর্ত আরোপ করা হয়। এক. ভারতীয় সেনা এসে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা নিজেদের আত্মরক্ষায় ব্যক্তিগত অস্ত্র বহন করবে এবং দুই. সেনাদের যেখানে রাখা হবে, পাকিস্তানি বেসামরিক কর্মকর্তাদেরও সেখানে রাখতে হবে। জ্যাকব প্রথম শর্ত মানলেও দ্বিতীয় শর্ত নাকচ করে দিয়ে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালিদের সঙ্গে বিনিময় না হওয়া পর্যন্ত বেসামরিক লোকজনকে বাংলাদেশেই অবস্থান করতে হবে। এরপর জ্যাকবের সঙ্গে আলোচনা করে বাকির সিদ্দিকি পূর্বনির্ধারিত এলাকায় বেসামরিক লোকজনকে একত্র করেন। ভারতীয় যুদ্ধবিমানের ব্যাপক বোমাবর্ষণে ৬ ডিসেম্বর থেকে আমাদের এফ-৮৬ স্যাবর জেটের বহর অকেজো হয়ে পড়ে। বিধ্বস্ত হয়ে যায় রানওয়ে। এয়ার কমোডর ইনাম জঙ্গি বিমানগুলো ব্যবহারোপযোগী নয় বলে ঘোষণা করেন এবং পাইলটদের জীবন বাঁচানোর জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বন্দিত্ববরণের জন্য রয়ে যান কেবল এয়ার কমোডর ইনাম। আর্মি এভিয়েশনের হেলিকপ্টারগুলো শিশু, নারী ও আহতদের নিয়ে বার্মা হয়ে পাকিস্তানে চলে যায়।’

২০ ডিসেম্বর নিয়াজি রাও ফরমান আলি, অ্যাডমিরাল শরিফ, এয়ার কমোডর ইনামুল হক, ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকি, এস এম কাসিম, মেজর সিদ্দিক সালিকসহ কলকাতা দমদম বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। হেলিপ্যাড থেকে দুটি স্টাফ গাড়ি তাদের ফোর্ট উইলিয়াম আবাসিক কোয়ার্টারে নিয়ে যায়। এখানে ছিলেন জেনারেল নজর, জেনারেল এম এইচ আনসারি, জেনারেল কাজি মজিদ, জেনারেল জামশেদও।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ।


বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর