শিরোনাম
২৫ মার্চ, ২০২৪ ১৭:৫০

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, অপারেশন সার্চলাইট-বিগবার্ড ও তরুণ প্রজন্মের দায়

সাইফুল ইসলাম (স্বপ্নীল)

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, অপারেশন সার্চলাইট-বিগবার্ড ও তরুণ প্রজন্মের দায়

সাইফুল ইসলাম (স্বপ্নীল)

আমি এ দেশের মানুষ চাই না, মাটি চাই। হ্যাঁ, এটা ইয়াহিয়া খানের নৃশংস ও নির্মম দম্ভোক্তি। ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের এক মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানের অন্য মুসলিম ভাইদের প্রতি এ ধরনের উক্তি প্রমাণ করে কতটা হাস্যকর ও অবাস্তব ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্র। একটি রাষ্ট্রের মূল্যবোধ ও মূলনীতি যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তা-চেতনাকে প্রতিফলিত করে না, বরং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বদলে নানা অজুহাতে একনায়কতান্ত্রিক, সেনাশাসন ও স্বৈরশাসনকে বছরের পর বছর উৎসাহিত করা হয়, সে রাষ্ট্রব্যবস্থা জনকল্যাণের পরিবর্তে গলার কাঁটা হিসেবে আবির্ভূত হবে সেটাই স্বাভাবিক।

শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দী সাহেব তো ষাটের দশকে গত হয়েছিলেন। ভাসানী সাহেব আইয়ুব খানের শাসনকে No Disturb নীতি গ্রহণ করে প্রকারান্তরে বাংলার মানুষের দীর্ঘদিনের আকাঙক্ষার সাথে উপহাস করেছিলেন। পক্ষান্তরে উদীয়মান, প্রাণচঞ্চল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকল আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ৫৮'র সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬'র দফা উত্থাপন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ এবং সর্বশেষ একাত্তরের মহান স্বাধীনতার ঘোষণা ও সার্বিক দিকনির্দেশনা প্রদান সবই বঙ্গবন্ধুকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছিল।

ইয়াহিয়া খানের সাথে আলোচনা কার্যত ব্যর্থ হবার পরে ২৫ শে মার্চ সারাদিন বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির বাসায় কাটিয়েছেন। রাজনৈতিক অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর কাছে আসন্ন লড়াই ও সংগ্রামের দিক-নির্দেশনা গ্রহণ করেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ধারণা করছিলেন আজকেই কিছু একটা হতে পারে। সেদিন সে বাসার লাইব্রেরিতে বসে বঙ্গবন্ধু ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান, কাজী গোলাম মোস্তফা ও ড. কামাল হোসেন।

চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা, আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও সামগ্রিক পদক্ষেপ সম্পর্কিত আলোচনা করছিলেন তারা। বঙ্গবন্ধু তার আলোচনায় সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছিলেন। বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ডক্টর এম এ ওয়াজেদ মিয়া তার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ বইতে লিখেছেন , ‘২৫ শে মার্চ সন্ধ্যা ৭টার মধ্যেই আওয়ামী লীগ অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ জাতির পিতার সাথে দেখা করে তার নির্দেশ নিয়ে চলে যান’। তিনি আরো বলেন, ২৫ মার্চ রাত ১১টায় ধানমন্ডির বাসার সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা হয়েছিল তৎকালীন ছাত্রনেতা আ.স. ম আব্দুর রব, সিরাজুল আলম খান ও শাহজাহান সিরাজের। তারাও আশঙ্কা করছিলেন আজকে রাতেই কিছু একটা হতে পারে। তার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু তাদের দিকনির্দেশনা দেন।

২৫ মার্চ দিবাগত রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করতে থাকে। এমতাবস্থায় ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র তৃতীয় খণ্ডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ঘোষণা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে এ ঘোষণা দেন তিনি, যা তৎকালীন ইপিআর এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।

বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার মূল্যবান দলিলটি সেখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে এভাবে ‘ইহাই হয়তো আমাদের শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছে, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। শেখ মুজিবুর রহমান। ২৬ মার্চ, ১৯৭১।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখক মঈদুল হাসানের ভাষ্যমতে, ‘২৫ শে মার্চ সন্ধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সাথেই বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দিনকে ঢাকার শহরতলীতে আত্মগোপনের নির্দেশ দেন, যাতে অতি শিগগিরই তারা একত্রিত হতে পারেন’।

২৫ মার্চ বেলা ১১টায় পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার সাথে পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খান টেলিফোনে  আলাপচারিতায় বলেন, ‘খাদিম এটা আজই হবে’। পাশে বসা সিদ্দিক সালিক তার উইটনেস টু সারেন্ডার বইতে লিখেন, ‘টিক্কা খানের টেলিফোন খাদিম হোসেন রাজার মধ্যে কোনো উত্তেজনা তৈরি করেনি, তিনি যেন হাতুড়িপেটা করার জন্যই তৈরি ছিলেন’।

বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার জন্য সব প্রস্তুতিই পাক হানাদাররা গ্রহণ করেছিল। রাত একটার দিকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের সময় নির্দিষ্ট করা হয়। কারণ, সে সময়ের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নিরাপদে করাচি পৌঁছাতে পারবেন। জাতির পিতাকে গ্রেফতারের পাশাপাশি যুগপৎভাবে অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে নিরস্ত্র, নিরীহ, বেসামরিক বাঙালিদের ওপর পাক হানাদারদের নির্মম, নৃশংস গণহত্যা পরিচালনা করার পরিকল্পনা করা হয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে রাজারবাগ পুলিশলাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা শহরসহ সমগ্র দেশব্যাপী ইতিহাসের বর্বরোচিত গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি আবালবৃদ্ধবনিতা।

বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের জন্য ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে পাক সৈন্যদল ট্যাংক, কামান, গোলাবারুদ নিয়ে ধানমন্ডি ৩২ এর অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। পথিমধ্যে ফার্মগেট এলাকায় সৈন্যদল ব্যারিকেডের সম্মুখীন হয়। সেখানে জয় বাংলা স্লোগান দেওয়া নিরস্ত্র বাঙালির ওপর তাদের স্টেনগান কেঁপে ওঠে। হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তারা ধানমন্ডি ৩২ এর বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে অবস্থান নেয়।

বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের জন্য গিয়েছিলেন লে. কর্নেল জেড এ খান ও মেজর বিল্লাল। সিদ্দিক সালিকের ভাষায়, ‘বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কম্পাউন্ডে গুলি চালিয়ে সৈন্যরা তাদের উপস্থিতি জানান দেয়; বঙ্গবন্ধুকে বাইরে বেরিয়ে আসতে বলে। কিন্তু বাড়ির ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি। তখন সৈন্যরা বাড়ির দরজা লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তখন বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে আসেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি এটার জন্য তৈরি ছিলেন’।

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই মেজর জাফর ওয়ারলেসে বলেন,‘বড় পাখিটা এখন খাঁচায় বন্দি, বাকিদের খুঁজে পাওয়া যায়নি’। সে রাতেই বঙ্গবন্ধুকে আর্মির গাড়িতে করে গণপরিষদ ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন রাতে বঙ্গবন্ধুকে আদমজী স্কুলে রাখা হয়। তারপর ক্যান্টনমেন্ট ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসে ৬ দিন রাখার পর তাকে রাওয়ালপিন্ডি মিয়ানওয়ালি কারাগারে বন্দী করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর পরিবার জানতেন না তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এপ্রিলের প্রথমদিকে করাচি বিমানবন্দরের লাউঞ্জে প্রহরারত অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী, ‘২৭ শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরেই শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়।’

একাত্তরের আগস্টে পাকিস্তান সরকারের মুখপাত্র জানায়, পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক আইনে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হয়েছে। ৪ ডিসেম্বর বিচার শেষ হয়। ঘটনাচক্রে ৩ ডিসেম্বর ভারত মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের চাপ সত্ত্বেও সে বিচারের রায় প্রকাশিত হয়নি।

জেনারেল নিয়াজীর জেলা মিয়ানওয়ালি কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। যেহেতু কারাগারের বন্দী বেশিরভাগই জেনারেল নিয়াজীর জেলার, তাই জেনারেল নিয়াজির মৃত্যু সংবাদের গুজব কারাগারের বন্দীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়লে তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবে। কিন্তু জেল সুপার ভোর চারটায় বঙ্গবন্ধুকে তার বাসায় নিয়ে যান। পরে পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় বঙ্গবন্ধুকে নিরাপদে রাখা হয়।

আমাদের একবিংশ শতকের তরুণপ্রজন্ম তথ্য প্রযুক্তি জ্ঞান-বিজ্ঞান, অত্যাধুনিক জীবনযাপন সবকিছুই চর্চা করে। দুঃখের বিষয় আজকে এই প্রজন্মের অনেকেই মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনেক কিছুই জানে না। জানতে চায়ও না। বরং একটা বিকৃত প্রজন্ম লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের নামে টিটকারি, হাস্যরস, ব্যঙ্গ ও হেয়প্রতিপন্ন করে অনেক মজা পায়। যে জাতি নিজের গৌরবের ইতিহাস চর্চা করে না, নিজের সোনালি অর্জন নিয়ে গর্ব করে না; সে জাতির আত্মা মরে যায়, তৈরি হয় আত্মমর্যাদাহীন পরগাছা প্রজন্ম।

বর্তমান সরকারের ১৫ বছরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনেক চর্চা হলেও বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসা ও অন্যান্য মাদ্রাসার ছাত্ররা এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। কওমি মাদ্রাসায় পড়ুয়া লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে হবে। ইসলামের নামে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের নিরীহ, নিরস্র বাঙালির ওপর যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও অত্যাচার হয়েছিল সেগুলো সম্পর্কে এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে। দেশপ্রেম, মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাহলেই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানবিক ও আগামীর বাংলাদেশ একটি স্মার্ট, সর্বজনীন ও কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
[email protected]

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর