শিরোনাম
২৭ জুন, ২০২৪ ২১:৫১

বঙ্গবন্ধুর চোখে শামসুল হক

সোহেল সানি

বঙ্গবন্ধুর চোখে শামসুল হক

সোহেল সানি

১৯৪৩ সাল থেকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানকে জমিদার, নবাবদের দালানের কোঠা থেকে বের করে জনগণের পর্ণকুটিরে যাঁরা নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শামসুল হক সাহেব ছিলেন অন্যতম। একেই বলে কপাল, কারণ সেই পাকিস্তানের জেলেই শামসুল হক সাহেবকে পাগল হতে হলো। পাকিস্তান আন্দোলনে তাঁর অবদান যারা এখন ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের চেয়ে অনেক বেশি।

উপর্যুক্ত কথাগুলো, শেখ মুজিবুর রহমানের, যিনি শামসুল হকের কারাবন্দী থাকা অবস্থায় পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে ভারপ্রাপ্ত হিসাবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। যদিও উদার শেখ মুজিব- শামসুল হক কারামুক্ত হলে তাঁকেই সাধারণ সম্পাদকের পদে দায়িত্বপালনে অনুরোধ করেছিলেন। 

শেখ মুজিব তাঁর আত্মজীবনীতে শামসুল হক সম্পর্কে লিখেছেন, "একজন নিঃস্বার্থ দেশকর্মী, ত্যাগী নেতা আজ দেশের কাজ করতে যেয়ে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে থেকে পাগল হয়ে বের হলেন। এ দুঃখের কথা কোথায় বলা যাবে?  আমি অনেকের সাথে পরামর্শ করে তাঁর চিকিৎসার বন্দোবস্তো করতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। উল্টা আমার উপর ক্ষেপে গেলেন। আমি তাঁকে প্রতিষ্ঠানের জেনারেল সেক্রেটারির (সাধারণ সম্পাদক) ভার নিতে অনুরোধ করলাম। কার্যকরী কমিটির সভা ডেকে তাঁকে অনুরোধ করলাম, কারণ এতদিন আমি এ্যাকটিং জেনারেল সেক্রেটারি হিসাবে কাজ করছিলাম। ভাবলাম,  কাজের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লে তিনি ভালো হয়ে যেতে পারেন। তিনি সভায় উপস্থিত হলেন এবং বললেন, 'আমি প্রতিষ্ঠানের জেনারেল সেক্রেটারির ভার নিতে পারবো না, মুজিব কাজ চালিয়ে যাক।' আজেবাজে কথাও বললেন, যাতে সকলেই বুঝতে পারলেন যে, তাঁর মাথায় কিছুটা গোলমাল হয়েছে।"

এরপরই ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান এ বিষয়ে লিখেছেন,.. "হক সাহেবকে সভাপতিত্ব করার জন্য জোর করেই উপস্থিত করলাম। তিনি এমন এক বক্তৃতা করলেন যাতে সকলেই দুঃখ পেলাম। কারণ তিনি নিজেকে সমস্ত দুনিয়ার খলিফা বলে ঘোষণা করলেন। আমরা হতাশ হয়ে পড়লাম, কি করে তাঁর চিকিৎসা করানো যাবে? আরও অসুবিধার পড়লাম, হক সাহেবের স্ত্রী প্রফেসর আফিয়া খাতুন বিদেশে লেখাপড়া করতে যাওয়ায়। তিনি থাকলে হয়ত কিছুটা ব্যবস্থা করা যেতো।"

শামসুল হক ১৯১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার মাইঠান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি হঠাৎ করেই নিখোঁজ হন এবং ১৯৬৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (শনিবার) ইন্তেকাল করেন। শামসুল হক গবেষণা পরিষদ অনেক খুঁজে মৃত্যুর ৪২ বছর পর ২০০৭ সালে টাঙ্গাইলে কালিহাতী উপজেলার কদিম হামজানিতে মরহুমের কবর আবিষ্কার করে।

শামসুল হক বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম পন্থী রূপে পরিচিত ছিলেন। ১৯৪৫ সালে নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের নির্বাচনে পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগ মনোনীত প্রার্থীরা প্রায় সকলেই জয়লাভ করেন। ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে মুসলিম লীগ শতকরা ৯৭ ভাগ আসনেই জয়লাভ করে। ওই সময় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কর্মীশিবিরের নেতৃত্বে ছিলেন শামসুল হক। এ সব বিবেচনায় পাকিস্তান সৃষ্টিতে শামসুল হকের গুরুত্বপূর্ণ অবদান অনস্বীকার্য। এছাড়া সিলেটকে পাকিস্তানভুক্ত করার গণভোটে তার অবদান ছিলো অপরিসীম।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্ররা সারা প্রদেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেয়। সেদিন সচিবালয়, নীলক্ষেত ও হাইকোর্টের সামনে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ ঘটে। বহু ছাত্র আহত এবং গ্রেফতার হন। যে সব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সেদিন গ্রেফতার হন তাদের মাঝে শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম। শেখ মুজিব পরিচিত ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য রূপে। 

যাহোক ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে টাঙ্গাইলের দক্ষিণ মুসলিম কেন্দ্রে দেশবিভাগ পূর্ব আসাম মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হন।এরপর উপনির্বাচনে শামসুল হক প্রার্থী হন। তিনি ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের প্রার্থী করটিয়ার বিখ্যাত জমিদার খুররম খান পন্নীকে হারিয়ে এমএলএ নির্বাচিত হন। কিন্তু তাঁর বিজয় কেড়ে নেয়া হয় নির্বাচনী মামলা দিয়ে। এর আগে যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দিল্লি কনভেনশনে 'পাকিস্তান প্রস্তাব' করেন, সেই তাঁর গণপরিষদের সদস্য পদও কেড়ে নেওয়া হয়।

খোদ গণপরিষদ নেতা প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে সোহরাওয়ার্দীকে বলেন, 'ভারতের লেলিয়ে দেয়া কুকুর।' মুসলিম লীগের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে সোহরাওয়ার্দী ভাসানীসহ সকলের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত দেন গণমানুষের জন্য একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের। 

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজগার্ডেনে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগের কর্মী সম্মেলন। যে সম্মেলনে গঠিত হয় পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। মওলানা ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। 

১৯৪৯ সালের ১১ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকায় আসছেন- এমন খবরে আওয়ামী মুসলিম লীগ একটা শোভাযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা করে। ওই সময় দলের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক একটু ব্যস্ত ছিলেন, তাঁর বিবাহের দিন ঘনিয়ে আসছিলো। যে কারণে দলের সমস্ত কাজ যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকেই করতে হতো। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, তিনি (শামসুল হক) আমাকে বললেন- প্রতিষ্ঠানের কাজ তুমি চালিয়ে যাও। আমাদের মধ্যে এতো মিল ছিলো যে কোন ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনাই ছিলো না। আমি বুঝতে পারতাম মওলানা (সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী) সাহেব, হক সাহেবকে অপছন্দ করতে শুরু করেছেন। সুযোগ পেলেই তাঁর বিরুদ্ধে বলতেন। আমি চেষ্টা করতাম, যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয়।"

১১ অক্টোবর আরমানীটোলায় বিরাট সমাবেশ হয়। এরপর শোভাযাত্রা বের হয়। উদ্দেশ্য ছিলো নাজিরাবাজার রেললাইন পার হয়ে নিমতলিতে ঢাকা মিউজিয়ামের পাশ দিয়ে নাজিমুদ্দিন রোড হয়ে আবার আরমানীটোলায় ফিরে আসা। নাজিরাবাজার আসতেই পুলিশি বাধার মুখে পড়ে শোভা যাত্রাটি। মওলানা ভাসানী রাস্তার উপরই নামাজে দাঁড়িয়ে পড়েন। শামসুল হকও একইভাবে তাঁকে অনুসরণ করেন। পুলিশ টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। লাঠিচার্জে আহত হন অনেকেই। শামসুল হকসহ অনেককেই গ্রেফতার করা হয়। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আগেই ঘোষণা করেন "যো আওয়ামী লীগ করেগা উসকো শের কুচাল দে গা।" 

শামসুল হক গ্রেফতারের মাত্র দেড় মাস আগে বিবাহ করেন। তিনি এবং তাঁর সহধর্মিণী আফিয়া খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনাকালে প্রেমবন্দী হন। এ সম্পর্কে শেখ মুজিব লিখেছেন, "একে অন্যকে পছন্দ করেই বিবাহ করেছিলেন। আমাকে বেশি কিছু বললে আমি তাঁকে 'বউ পাগলা' বলতাম। তিনি ক্ষেপে আমাকে অনেক কিছু বলতেন। মওলানা সাহেব হাসতেন, তাতে তিনি আরও রাগ করতেন এবং মওলানা সাহেবকে কড়া কথা বলে ফেলতেন। মওলানা সাহেবের সাথে আমরা নামাজ পড়তাম। মাগরিবের নামাজের পরে কোরআন মজিদের অর্থ করে আমাদের বোঝাতেন। রোজই এটা আমাদের জন্য বাঁধা নিয়ম ছিলো। শামসুল হক সাহেবকে নিয়ে বিপদ হতো। এক ঘণ্টার কমে কোনো নামাজই শেষ করতে পারতেন না। এক একটা সেজদায় আট-দশ মিনিট লাগিয়ে দিতেন। মাঝেমাঝে চক্ষু বুজে বসে থাকতেন। যেদিন হক সাহেবের সাথে তাঁর বেগম দেখা করতে আসতেন, সেদিন হক সাহেবের সাথে কথা বলা কষ্টকর হতো। সত্যই আমার দুঃখ হতো। দেড় মাসও একসাথে থাকতে পারলেন না বেচারি! একে অন্যকে যথেষ্ট ভালোবাসতো বলে মনে হয়। আমি বেগম হককে ভাবি বলতাম, ভাবি আমাকেও দু'একখানা বই পাঠাতেন। হক সাহেবকে বলে দিতেন, আমার কিছু দরকার হলে যেন খবর দেই। আমি ফুলের বাগান করতাম। তাদের দেখা হবার দিনে ফুল তুলে হয় ফুলের মালা, না হয় তোড়া বানিয়ে দিতাম। হক সাহেব জেলের আবদ্ধ অবস্থা আর সহ্য করতে পারছিলেন না। তিনি এক নতুন উৎপাত শুরু করলেন। রাতে বারোটার পরে জিকির করতেন। আল্লাহু, আল্লাহু করে জোরে জিকির করতে থাকতেন। এক ঘণ্টা থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত। অনেক সময় মধ্যরাতেও শুরু করতেন। আমরা দশ-পনেরোজন কেউই ঘুমাতে পারতাম না। প্রথম কয়েকদিন কেউ কিছু বলে নাই। কয়েদিরা দিনভর কাজ করে। তারা না ঘুমিয়ে পারে না। মওলানা সাহেবের কাছে গোপনে নালিশ করলো এবং বললো এবাদত মনে মনে করলেও তো চলে, আমরা ঘুমাতে পারছি না। মওলানা সাহেব হক সাহেবকে বললেন, মনে মনে এবাদত করতে। হক সাহেব শুনলেন না। আমার খাট আর হক সাহেবের খাট পাশাপাশি। আমার পাশে জায়নামাজ বিছিয়ে তিনি শুরু করতেন। আধ ঘণ্টা মাত্র ঘুমিয়েছি, হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। আর শুনতে পাই, কানের কাছে হক সাহেব জোরে জোরে জিকির করছেন। কি করব? আমার তো চুপ করে অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া উপায় নাই। যখন আরম্ভ করেন একটানা দশ-পনেরো দিন পর্যন্ত চলে। একদিন দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পরে হক সাহেবকে বললাম, 'এভাবে চলবে কেমন করে?  রাতে ঘুমাতে না পারলে শরীরটা তো নষ্ট হয়ে যাবে।' তিনি রাগ করে বললেন , 'আমার জিকির করতে হবে, যা ইচ্ছা কর। এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাও। আমি তখন কিছুই বললাম না, কিছু সময় পরে বললাম, রাতে যখন জিকির করবেন আমি উঠে আপনার মাথায় পানি ঢেলে দেবো, যা হবার হবে। তিনি রাগ করলেন না, আস্তে আস্তে আমাকে বললেন, 'বুঝতে পারছি না কিছুই, আমি সাধনা করছি। একদিন ফল দেখবা।' কি আর করা যাবে নীরবে সহ্য করা ছাড়া!"

শেখ মুজিব আরেকটি প্রসঙ্গে লিখেছেন , "শামসুল হক সাহেব অনেক পরিশ্রম করে একটা ড্রাফট ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্রের তৈরি করেছেন। আমরা একমত হয়ে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম। দুই একবার শামসুল হক সাহেবের সাথে ভাসানী সাহেবের একটু গরম আলোচনা হয়েছিলো। একদিন শামসুল হক সাহেব ক্ষেপে গিয়ে মওলানা সাহেবকে বলে বসলেন , "এ সমস্ত আপনি বুঝবেন না। কারণ, এ সমস্ত জানতে হলে অনেক শিক্ষার প্রয়োজন, তা আপনার নাই।"

মওলানা সাহেব ক্ষেপে গিয়ে মিটিং স্থান ত্যাগ করলেন। আমি শামসুল হক সাহেবকে বুঝিয়ে বললে তিনি বুঝতে পারলেন, কথাটা সত্য হলেও বলা উচিত হয় নাই। ফলে হক সাহেব নিজে গিয়ে মওলানা সাহেবকে অনুরোধ করে নিয়ে আসলেন। শামসুল হক সাহেবের রাগ বেশি সময় থাকতো না। শামসুল হকই ১৫০ নম্বর মোগলটুলী থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগের অফিস ৯০ নবাবপুর নিয়ে আসেন। তিনি এবং মওলানা ভাসানী তখন কারাগারে। মুক্তি পেয়ে যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিব ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকেন। সিনিয়র সহসভাপতি আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেই সভার সিদ্ধান্তক্রমে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৫৩ সালের প্রথম কাউন্সিল হয়। ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে  অনুষ্ঠিত সেই কাউন্সিলে প্রধান অতিথি ছিলেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। 

শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, কাউন্সিল সভার দিন যতই ঘনিয়ে আসছিলো আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রবীণ নেতা এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন, যাতে আমাকে জেনারেল সেক্রেটারি না করা হয়। আমি এ সম্বন্ধে খোঁজখবর রাখতাম না, কারণ প্রতিষ্ঠানের কাজ, টাকা জোগাড়, কাউন্সিলারদের থাকার বন্দোবস্তোসহ নানাকাজে ব্যস্ত থাকতে হতো। আব্দুস সালাম খান, ময়মনসিংহের হাশিমুদ্দিন, রংপুরের খয়রাত হোসেন, নারায়ণগঞ্জের আলমাস আলী ও আব্দুল আউয়াল ও আরও কয়েকজন এই ষড়যন্ত্রের নায়ক ছিলেন। প্রতিষ্ঠানের জন্য টাকা পয়সা এরা দিতেন না, জোগাড়ও করতেন না। প্রতিষ্ঠানের কাজও ভালোভাবে করতেন না। তবে আমি যাতে জেনারেল সেক্রেটারি না হতে পারি তার জন্য অর্থ ব্যয়ও করতেন। সালাম সাহেবের অসন্তুষ্ট হবার কারণ ছিলো আমি নাকি তাঁকে ইমপর্টেন্স না দিয়ে আতাউর রহমান খান সাহেবকে দেই। আমি এ সমস্ত পছন্দ করতাম না, তাই আতাউর রহমান সাহেবকে কাউন্সিল সভার প্রায় পনের দিন পূর্বে একাকী বললাম, "আপনি জেনারেল সেক্রেটারি হতে রাজি হন; আমার পদের দরকার নাই। কাজ তো আমি করছি এবং করবো, আপনার কোনো অসুবিধা হবে না।' আতাউর রহমান সাহেব বললেন, "আমি এতো সময় কোথায় পাবো? সকল কিছু ছেড়ে দিয়ে কাজ করার উপায় আমার নাই। এখন যে জেনারেল সেক্রেটারি হবে তার সর্বক্ষণের জন্য পার্টির কাজ করতে হবে। আপনি ছাড়া কেউ এ কাজ পারবে না, আপনাকেই হতে হবে।" আমি বললাম, "কয়েকজন নেতা তলে তলে ষড়যন্ত্র করছে। তারা বলে বেড়ান একজন বয়সী লোকের জেনারেল সেক্রেটারি হওয়া দরকার। দুঃখের বিষয় এই ভদ্রলোকদের এতটুকু কৃতজ্ঞতা বোধ নাই যে, আমি জেল থেকে বের হয়ে রাতদিন পরিশ্রম করে প্রতিষ্ঠানের একটা রূপ দিয়েছি।"

আতাউর রহমান সাহেব বললেন , "ছেড়ে দেন ওদের কথা, কাজ করবে না শুধু বড় বড় কথা বলতে পারে সভায় এসে।" আমি বললাম, "চিন্তা করে দেখেন; একবার যদি আমি ঘোষণা করে দেই যে, আমি প্রার্থী তখন কিন্তু আর কারও কথা শুনবো না।" তিনি বললেন- "আপনাকেই হতে হবে।" আতাউর রহমান সাহেব জানতেন তাঁর জন্যই সালাম সাহেব আমার উপর ক্ষেপে গেছেন। মওলানা সাহেব (ভাসানী) আমাকে জেনারেল সেক্রেটারি করার পক্ষপাতী। তাঁকেও আমি বলেছিলাম, আমি ছাড়া অন্য কাউকে ঠিক করতে, তিনি রাজি হলেন না। বললেন, "তোমাকেই হতে হবে।" 

শেখ মুজিবুর রহমান আরও লিখেছেন, আমার বিরোধী গ্রুপ অনেক চেষ্টা করেও কোনো প্রার্থী দাঁড় করাতে পারছিলেন না। কেউই সাহস পাচ্ছিলো না, আমার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে। কারণ তাঁরা জানেন, কাউন্সিলাররা আমাকেই ভোট দিবে। ভদ্রলোকেরা তাই নতুন পন্থা অবলম্বন করলেন। তাঁরা আবুল হাশিম সাহেবের কাছে ধরনা দিলেন এবং তাঁকে আওয়ামী লীগে যোগদান করতে ও সাধারণ সম্পাদক হতে অনুরোধ করলেন। হাশিম সাহেব রাজি হলেন এবং বললেন, তাঁর কোনো আপত্তি নাই, তবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হতে হবে। তিনি মওলানা ভাসানী সাহেবকে খাবার দাওয়াত করলেন। তাঁকে যে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা এ ব্যাপারে অনুরোধ করেছেন তাও বললেন এবং মওলানা সাহেবের মতামত জানতে চাইলেন। মওলানা সাহেব তাঁকে বললেন , "সাধারণ সম্পাদক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় করা যাবে কিনা সন্দেহ, কারণ মুজিবের আপনার সম্মন্ধে খুব খারাপ ধারণা। তবে যদি সভাপতি হতে চান, আমি ছেড়ে দিতে রাজি আছি। "

কাউন্সিল সভার একদিন পূর্বে আমার বিরোধী গ্রুপ আতাউর রহমান সাহেবকে অনুরোধ করলেন সাধারণ সম্পাদক হতে। আতাউর রহমান সাহেব একটু নিমরাজি হয়ে পড়লেন এবং আমার সাথে পরামর্শ করবেন বলে দিলেন। আতাউর রহমান সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, তাঁদের অনুরোধের কথা। আমি তাঁকে বলে দিলাম এখন আর সময় নাই, পূর্বে হলে রাজি হতাম। তাঁদের কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বলেন। আমি কাউন্সিল সভায় উপস্থিত হয়ে ভাসানী সাহেবকে জানিয়ে দিলাম নির্বাচন হবে। আতাউর রহমান সাহেব আমাকে সমর্থন করলেন। নির্বাচনও সর্বসম্মতিক্রমে হয়ে গেলো। মওলানা ভাসানী সভাপতি, আতাউর রহমান খান সহসভাপতি, আমি সাধারণ সম্পাদক। এখন আওয়ামী লীগ একটা সত্যিকারের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনগণের সামনে দাঁড়ালো। ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র গ্রহণ করা হলো।"

ফিরে আসছি শামসুল হক প্রসঙ্গে। যদিও শোনা কথা, ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত মানসিক ভারসাম্যহীন শামসুল হককে পথে পথে ঘুরতে দেখেছেন অনেকেই। তারপর হঠাৎ তিনি নিখোঁজ হন। ২০০৭ সালে তার নিখোঁজ রহস্য উন্মোচিত হয়। বলা হয়ে থাকে, ১৯৬৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার জোকারচর গ্রামের মহিউদ্দিন আনসারী (তৎকালীন নামকরা কংগ্রেস নেতা) কলকাতা থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে বাড়ি ফেরার পথে কোনো এক স্থান থেকে শামসুল হককে বাড়িতে নিয়ে আসেন। তখন শামসুল হক শারীরিক ও মানসিকভাবে ভীষণ অসুস্থ ছিলেন। মহিউদ্দিন আনসারীর বাড়িতে ৭ দিন থাকার পর তার হঠাৎ খুব জ্বর হয়। স্থানীয় হোমিও চিকিৎসক শুকলাল দাস তার চিকিৎসা করেন। প্রচণ্ড জ্বরে শামসুল হক ১৯৬৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (শনিবার) দুপুর ২টা থেকে আড়াইটার মধ্যে মারা যান।

২০০৭ সালে টাঙ্গাইলের কালিহাতির কদিম হামজানিতে তার কবর আবিষ্কার হয়। একইসঙ্গে জোকারচরের কংগ্রেস নেতা মহিউদ্দীন আনসারির বাড়িতে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হয়। সাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দীন ‘আত্মস্মৃতি : সংগ্রাম ও জয়’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাকে (শামসুল হককে) আটক করা হয়। তখন তিনি বিবাহিত, স্ত্রী নরসিংদীর সেকান্দার মাস্টার সাহেবের কন্যা আফিয়া খাতুন এমএ কলেজের লেকচারার। জেলখানায় শামসুল হকের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে। নিজ পরিবারের প্রতি তার মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। আফিয়া খাতুন তাকে ত্যাগ করেন। আফিয়া এখন পাকিস্তানে মিসেস আফিয়া দিল।’ শামসুল হক সম্পূর্ণ বিকৃত মস্তিষ্ক অবস্থায় জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসেন। শামসুল হক ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন- কখনও বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে টাকা ধার চাইতেন, কেউ সমাদর করলে আহার করতেন।’ টাঙ্গাইলের ওয়ার্টারলু বিজয়ী শামসুল হকের মৃত্যু কোথায় কি অবস্থায় হলো তার কোনো বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে দেখিনি। শোকসভাও করেনি কোনো রাজনৈতিক দল বা অন্যরা। 

লেখক : সহকারী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর