বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

যে কথা এর আগে বলতে চাইনি

আবদুল মান্নান

যে কথা এর আগে বলতে চাইনি

অনেক কথা থাকে যা ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় বলা যায় না নানাবিধ কারণে । কখনো কখনো কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, কোনো কোনো সময় সামাজিক কারণে অথবা থেকে পারে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে হয়তো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অস্বস্তিতে পড়তে পারেন। এমন একজন ব্যক্তি বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দেশের ও দেশের বাইরের একাধিক গণমাধ্যম তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন সময় সৃষ্টি হওয়া নানা বির্তক নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে আমি সবিনয়ে তা এড়িয়ে গেছি। তিনি শুধু আমার পূর্বের কর্মক্ষেত্রে আমার অগ্রজপ্রতিম সহকর্মীই ছিলেন না পারিবারিকভাবে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল ও আছে। তাঁর এক ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী। অন্য ভাইদের সঙ্গে আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ও এখনো আছে বলে আমি বিশ্বাস করি। তাঁকে তাঁর অন্য ভাইদের মতো আমি এখনো মেজো ভাই হিসেবে চিনি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ড. ইউনূস ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে আসেন। ফিরেই তিনি বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে যোগ দেন। মূলত তাঁকে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদই এই কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। তাঁর ছোট ভাই সাংবাদিক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, বর্তমানে প্রয়াত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে থাকত। তিনি মাঝে মাঝে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। তার জন্য আমার রুমে অপেক্ষা করতেন। তখন তাঁর কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক গল্প শুনতাম। নূতন পরিকল্পনা কমিশনের কাজ সম্পর্কে তিনি গল্প করতেন। সদ্য স্বাধীন দেশ। একটি ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু দেশটাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। বলতেন পরিকল্পনা কমিশনে বসার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক চেয়ার টেবিল পর্যন্ত নেই। কিছুদিন পর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকের চাকরি নিয়ে চলে গেলেন। তার এক বছরের কম সময়ে আমিও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ে চার শ টাকা বেতনের চাকরি নিয়ে অন্য বিভাগে যোগ দিই। তখন থেকে তাঁর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়া শুরু। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই জোবরা গ্রাম। বেশির ভাগ মানুষ হতদরিদ্র। তিনি সেখানে অনেকটা সমবায় ধাঁচের ‘নবযুগ জোবরা তেভাগা খামার’ নামে একটি ছোট প্রকল্প শুরু করেন। (গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম ১৯৮৩ সালে একটি আইনের মাধ্যমে একটি বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে পরিচালিত ব্যাংক) সেটি ছিল অনেকটা গবেষণাধর্মী প্রকল্প। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব কি না তা তিনি বুঝতে চেয়েছেন। তাঁর সেই পরিকল্পনা কতটুকু সফল হয়ে, ঋণ নিয়ে কত নারী আত্মহত্যা করেছে তা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। তিনি শুধু নারীদের ঋণ দিতেন। সেইসব কথা এখন আর বলতে চাই না। তবে বলা যায়, সেই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হয়তো মহৎ ছিল কিন্তু বাস্তবসম্মত ছিল না। তিনি সেখানে সাধারণ দরিদ্র পরিবারকে তাদের হাতের কাজ যেমন বাঁশের ঝুড়ি বানানো, খেতের পানি সেচ ব্যবস্থায়, জেলেদের মাছ ধরার জাল ক্রয়ের জন্য ঋণের ব্যবস্থা অথবা গবাদি পশু ক্রয়ে তাঁর নিজের পকেটের অর্থ খরচ করে তাদের সাহায্য করতেন। এই দরিদ্র মানুষগুলো সময়মতো ড. ইউনূসের অর্থ ফেরত দেওয়ার জন্য অঙ্গীকার করতেন। এখান থেকেই তাঁর ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা চালু। তিনি সবসময় তাঁর দু-একজন সহকর্মী বা ছাত্রকে সঙ্গে পেয়েছেন। তারা আজ কেউ তাঁর সঙ্গে নেই। এমন একটি ব্যবস্থা রবীন্দ্রনাথও চালু করেছিলেন কিন্তু মহাজনদের বাধার মুখে তিনি সেই ব্যবস্থা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। ড. ইউনূসের সুবিধা ছিল জোবরা গ্রামে কোনো মহাজন ছিল না। সেখানে ক্ষুদ্র কারিগর বলি আর কৃষক বলি তারা দাদন নিয়ে কাজ করতেন। একসময় এই দাদন ব্যবস্থা বাংলার কৃষকদের সর্বস্বান্ত করেছিল। এত বছর পরে এসেও জোবরা গ্রামে গেলে দেখা যায় সেই গ্রামের মানুষ দরিদ্র থেকে আরও হতদরিদ্র হয়েছে।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর জিয়া ক্ষমতা দখল করেন। ড. ইউনূস চট্টগ্রাম ছেড়ে তখন ঢাকায়। জিয়ার কাছে তিনি তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে গেলে জিয়া তাঁকে এই ব্যবস্থা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে পরীক্ষামূলকভাবে টাঙ্গাইলে চালু করতে বলেন। একটি সরকারি ব্যাংক থেকে তাঁকে এই প্রকল্পের জন্য কিছু ঋণেরও ব্যবস্থা করা হয়। জিয়া দেশের উন্নয়নের ১৯ দফার মধ্যে ড. ইউনুসের এই ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত করেন। এর পর ড. ইউনূস নানাবিধ কর্মকাণ্ডে হাত দেন কিন্তু বাস্তবে কোনোটাই তেমন একটা সফলতার মুখ দেখেনি।

ড. ইউনূস প্রথম যে আন্তর্জাতিক পুরস্কারটি পান সেটি ১৯৮৪ সালে ফিলিপাইনের ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড। একই জেলার মানুষ হিসেবে তাঁর এই অর্জনে আমরা তো বটেই দেশের মানুষও খুব খুশি হয়েছিল। তখন তাঁকে চট্টগ্রামবাসী একটি নাগরিক সংবর্ধনা দেয় যার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলাম আমি নিজে। জনহিতকর কাজের জন্য এই পুরস্কার এই দেশের আর বেশ কজন পেয়েছেন। ড. ইউনূসের একটি বড় গুণ হচ্ছে তিনি একজন অসাধারণ জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ । তিনি নিজের কাজ যাই হোক না কেন তা দেশের মানুষের চেয়ে দেশের বাইরে বেশি তুলে ধরতে অত্যন্ত পারদর্শী। এর ফলে আজ বিশ্বে এই মুহূর্তে হয়তো শ খানেক নোবেল জয়ী আছেন কিন্তু তাঁর এই সতীর্থদের নাম কজনে জানে তা গবেষণার বিষয়। কিছুদিন আগে অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী ভারতের আর এক বাঙালি ড. অমর্ত্য সেনকে বিশ্বভারতী সামান্য এক কাঠারও কম (২৫ ডেসিমেলের মতো) জমির জন্য মামলা করলে তিনি কলকাতার আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরেছেন। তাঁর সঙ্গে কেউ ছিল না। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁর পিতা সেই চল্লিশের দশকে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী থেকে যে জমি ক্রয় করেছিলেন তিনি তার বেশি জমি ভোগ করছেন। সেই মামলার এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে তিনি তাঁর কর্মক্ষেত্র যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেছেন। তাঁর পক্ষে পশ্চিমবঙ্গের একটা মানুষও কোনো বিবৃতি দেওয়ার তেমন একটা প্রয়োজন মনে করেননি। আর বাংলাদেশে ড. ইউনূসের শ্রমিক আদালতে বর্তমান চলমান মামলার বিষয়ে কোটি ডলার খরচ করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কত বাঘা বাঘা মানুষের বিজ্ঞাপন আকারের বিবৃতি ছাপা হয় তা কল্পনাতীত। দেশের একশ্রেণির শিক্ষিত নাগরিক তাঁর সঙ্গে তো থাকেনই। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, কখনো তাঁর পরিবারের কোনো সদস্যকে দেখা যায় না।

২০০৬ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে যখন নোবেল পুরস্কার পান তখন বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। তাঁর জন্মস্থান চট্টগ্রামের মানুষ এত উদ্বেলিত হয়েছিলেন যে, চট্টগ্রামের প্রাচীনতম দৈনিক আজাদী পত্রিকা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম করেছিল- ‘আঁরার ইউনুচ নোবেল ফাইয়ে’ (আমাদের ইউনূস নোবেল পেয়েছে)। কোনো কোনো জায়গায় আনন্দ মিছিল পর্যন্ত হয়েছিল। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বড় এক নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখি আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর পক্ষে সব চেয়ে বড় এক পুষ্পস্তবক ও মিছিল নিয়ে সবার আগে হাজির হয়েছেন দলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল। সেই সংবর্ধনায় শামিল হয়েছিলেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ও সংগঠন।

ড. ইউনূসকে নিয়ে প্রথম বিরূপ সমালোচনা শুরু হয় খোদ শান্তিতে নোবেলের জন্মস্থান নরওয়েতে। সেটি ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে। নরওয়ের জাতীয় টিভি চ্যানেল এক প্রামাণ্যচিত্রে অভিযোগ উত্থাপন করে, নরওয়ে সরকার থেকে ১৯৯৬ সালে পাওয়া ১০০ মিলিয়ন ডলার তিনি চুরি করেছেন (এটি নরওয়ের টিভির ভাষা)। তাদের অভিযোগ ছিল সেই দেশের সরকারের গ্রামীণ ব্যাংককে দেওয়া এই অর্থ ড. ইউনূস তাদের অনুমতি ছাড়া ‘গ্রামীণ কল্যাণ’-এ সরিয়েছেন যা তাদের দেশের আইনের পরিপন্থি। কারণ এই অর্থ তাদের জনগণের অর্থ। এটি সবাইকে হতবাক করার মতো একটি খবর ছিল। তখন চাপে পড়ে তিনি এই অর্থের ৩০ মিলিয়ন ডলার ফেরত দিয়েছিলেন। প্রামাণ্যচিত্রটির নির্মাতা টম হেইনিম্যান একধিকবার ড. ইউনূসের সঙ্গে তাঁর মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করে ব্যর্থ হন। পরিবর্তে ড. ইউনূস নরওয়ের কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন- তারা যেন এ বিষয়টি নিয়ে আর বেশিদূর অগ্রসর না হন। কিন্তু ইতোমধ্যে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।

২০০৬ সালে দেশে যখন বেগম জিয়া তার ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য নানা ধরনের ফন্দিফিকির করছিলেন তখন দেশে শুরু হলো চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা। দেশ অনেকটা অচল। এই প্রেক্ষাপটে দেশে এলো এক- এগারোর সরকার। এক-এগারোর কুশীলবরা প্রথমে গেলেন ড. ইউনূসের কাছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে। সেই প্রস্তাব গ্রহণ না করে তিনি বলেন, তাঁর দীর্ঘ সময় দরকার। যার অর্থ হচ্ছে সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নব্বই দিনের যে সময়ের বাধ্যবাধকতা আছে তা তাঁর পছন্দ ছিল না। তাঁর যে এই দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আরোহণ করতে আগ্রহ তা কোনো গোপন বিষয় নয়। তাঁর প্রস্তাব মতো বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ড. ফখরুদ্দিন আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে প্রধান উপেদেষ্টা করা হয়।

২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকার এক অভিজাত কমিউনিটি সেন্টারে কয়েকজন বড় মাপের সুশীলের উদ্যোগে ‘যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন’ নামে এক সমাবেশ হয়েছিল। আসলে মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ঢাকার দুটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক। অন্যদের সঙ্গে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। উদ্যোক্তাদের দাবি ছিল আসন্ন নির্বাচনে (যা তখনো অনুষ্ঠিত হয়নি) প্রত্যেকটি দলই যেন যোগ্য প্রার্থী দেন। তবে যোগ্যতার মাপকাঠি কী হবে তার কোনো ধারণা তারা দিতে পারেনি। সমাবেশ শেষে একজন সাংবাদিক ড. ইউনূসের কাছে জানতে চান কোনো একটি নির্বাচনি এলাকায় যদি তাদের মতে যোগ্য প্রার্থী না থাকে তাহলে তারা কী করবেন? উত্তরে তিনি বলেন তারা সেখানে তাদের একজন ‘যোগ্য প্রার্থী’ দেবেন। এই প্রসঙ্গে সমাবেশে উপস্থিত অধ্যাপক রেহমান সোবহানের কাছে এই প্রসঙ্গে তাঁর মতামত জানতে চাইলে তিনি সরাসরি বলেন ‘কোনো নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়া আমাদের কাজ নয়’। ড. ইউনূসের মতামতের কথা তাঁকে বললে তিনি সরাসরি বলেন, ‘এটি উনার ব্যক্তিগত মত’।

২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ড. ইউনূসের সম্মানে ঢাকায় এক নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করেন। সেই সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি দুটি সংবিধানবিরোধী কথা বলেন। বলেন, আগামী নির্বাচনে যারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হবেন তারা অন্য দলগুলোকে নিয়ে একটি জোট সরকার গঠন করবেন। নির্বাচনের পর কীভাবে সরকার গঠন করা হবে তা প্রত্যেক দেশের সংবিধানে লেখা থাকে। ড. ইউনূসের এমন অদ্ভুত ফর্মুলা কোনো দেশের সংবিধানে লেখা আছে বলে জানা যায় না। তারপর তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ এক বছর হওয়া উচিত। প্রয়োজনে তা দুই বছরও হতে পারে। এখানে বোঝা যায় তিনি কেন এক-এগারোর পর নব্বই দিনের সরকার প্রধান হতে চাননি।

এরই মধ্যে সব রীতিনীতি ও সংবিধানের বাইরে গিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন নিজেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করেন। ৫ নভেম্বর ২০০৬ সালে রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনে নোবেল লরিয়েটের জন্য এক সংবর্ধনার আয়োজন করেন। সেই সভায় ড. ইউনূস ড. ইয়াজউদ্দিনকে সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়ে বলেন, ‘আপনি শক্ত হাতে সব কিছু সামাল দেবেন। সবার কথা শুনবেন কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবেন নিজের মতো করে’। একজন নোবেল লরিয়েটের কাছ থেকে দেশের মানুষ আরও যৌক্তিক পরামর্শ আশা করেছিল। তারপর এলো এক-এগারোর সরকার। ইতোমধ্যে ড. ইউনূসের রাজনীতিতে প্রবেশ করার আগ্রহ জেগেছে। এক-এগারোর সরকার দেশে যখন সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে তখন তিনি ‘নাগরিক শক্তি’ নামের এক রাজনৈতিক দল গঠন করেন। জনগণের কাছে আহ্বান করেন মোবাইল ফোনে খুদেবার্তা দিয়ে তাকে সমর্থন জানানোর জন্য। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তিনি পাঁচটি বার্তা পেয়েছিলেন। তারপর তিনি দলের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ড. ইউনূস দেশের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রাজনৈতিক সংকট নিয়ে কখনো কোনো ভূমিকা রাখেন না অথবা এ নিয়ে দেশের মিডিয়াতে কোনো বক্তব্য দেন না। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট যখন শেখ হাসিনার ওপর ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হলো তখন দেশের শিক্ষিত নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ঘটনার নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তাঁর কাছে নিয়ে গেলে তিনি তাতে সই করতে অস্বীকার করেন। ২০১৩-১৪ সালে যখন বেগম জিয়ার নির্দেশে দেশে এক ভয়াবহ আগুনসন্ত্রাস চলছিল তখন তিনি তা নিয়ে টুঁ শব্দ করেননি। এই সন্ত্রাসে শুধু আগুনে পুড়িয়ে তিন শর মতো মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। কয়েক শ কোটি টাকার দেশের জনসম্পদ ধ্বংস করা হয়েছিল। তিনি সম্ভবত দেশের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বা সম্মানিত ব্যক্তি যিনি কখনো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বা জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাননি।

বর্তমানে দেশে তাঁর বিরুদ্ধে কর ফাঁকি দেওয়ার ও গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনা না দেওয়ার একাধিক মামলা আদালতে চলমান। বিচারাধীন মামলার ব্যাপারে কিছু বলা সমীচীন নয়। তবে তিনি যেদিন আদালতে হাজিরা দিতে যান সেদিন আদালত থেকে বের হয়ে টিভি ক্যামেরার সামনে অনেকটা একজন রকস্টার বা শোম্যানের মতো আচরণ করেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন অবস্থায় তিনি দেশের বাইরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘প্রটেক্ট ইউনূস ক্যাম্পেইন’ থেকে জাতিসংঘ ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে এক আবেদনে বাংলাদেশে বর্তমান অবস্থা অবসানে তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এর পর দেশের উচ্চ আদালতের অনুমোদন নিয়ে তিনি প্যারিসে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে অতিথি হিসেবে যোগ দিতে গিয়ে ভারতের দৈনিক দি হিন্দু পত্রিকায় এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়ে বাংলাদেশে নতুন নির্বাচনের দাবি করেন। এ দুটি ঘটনাই যথেষ্ট ড. ইউনূসের দেশের সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্র প্রধান হওয়ার খায়েস এখনো বিদ্যমান।

শেষে গত ২২ ও ২৩ তারিখ যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ের বর্ণনা দিয়ে লেখাটি শেষ করি। এই প্রেস ব্রিফিংয়ে সবসময় বেগম জিয়ার একজন সাবেক উপ-প্রেস সচিব উপস্থিত থাকেন। সেদিন তিনি স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের কাছে জানতে চান, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে যা ঘটছে তাতে কি যুক্তরাষ্ট্রের কিছুই করার নেই? যুক্তরাষ্ট্র কি মনে করে এমন পরিস্থিতিতে ড. ইউনূসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করে একটি সরকার গঠন করলে সমস্যার সমাধান হবে’? মিলার কূটনৈতিক ভাষায় বলেন, ‘প্রত্যেক সার্বভৌম দেশ তাদের নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করবে’।

ড. ইউনূস কখন দেশে ফিরবেন জানি না। তবে এই দেশের একমাত্র নোবেল লরিয়েটের কাছে প্রত্যাশা থাকবে ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তিনি দেশে হোক বা বিদেশে কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবেন না। এই লেখা কাউকে অসম্মান করার জন্য নয়। বিবেকের তাড়নায় কিছু ঘটনা আর প্রত্যাশা ব্যক্ত করার জন্য। সবার শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর