মঙ্গলবার, ২০ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

জীবন সহজ করেছে রেফ্রিজারেটর

শাহেদ আলী ইরশাদ

জীবন সহজ করেছে রেফ্রিজারেটর

একটা সময় রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ, টেলিভিশন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রসহ (এসি) সব ধরনের ইলেকট্রনিক পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি হতো। দিন বদলে গেছে। চাহিদা বাড়তে থাকায় ধীরে ধীরে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে সরঞ্জাম এনে সংযোজন করে বাজারজাত শুরু করেছে। আর এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে রেফ্রিজারেটর।

দৈনন্দিন জীবনের অত্যাবশ্যকীয় পণ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে রেফ্রিজারেটর। মাছ-মাংস, প্রয়োজনীয় শাক-সবজি, ফলমূলসহ পচনশীল দ্রব্যাদি সংরক্ষণে রেফ্রিজারেটরের জুড়ি নেই। আগের দিনে মানুষ মাছ-মাংস চুলায় জ্বাল দিয়ে রাখত। শুকিয়ে বা বিভিন্ন উপায়ে সংরক্ষণ করতে হতো। এখন নিয়মিত বাজারে যাওয়ার চিন্তা থেকে মুক্ত থাকা যায়। একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা সৃষ্টি করে রেফ্রিজারেটর এসব জিনিস পচন থেকে রক্ষা করে। যেখানে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় অতি ক্ষুদ্র জীবাণু ব্যাকটেরিয়া দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে খাবার বা অন্যান্য জিনিসকে পচিয়ে ফেলে। কিন্তু নিম্ন তাপমাত্রায় ব্যাকটেরিয়া স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় বংশবৃদ্ধি থেমে যায়। এ কারণে এসব জীবাণু খাবার পচাতে পারে না। সুইডেনের বিজ্ঞানী কার্ল লিন্ডে ১৮৭৪ সালে যান্ত্রিকভাবে খাদ্য সংরক্ষণের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তখন রেফ্রিজারেটর  ছিল উচ্চবিত্তের বিলাসী পণ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে রেফ্রিজারেটরের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় ঘটে। এখন রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ আধুনিক জীবনের এক অপরিহার্য পণ্যে পরিণত হয়েছে।

একটা সময় রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ, টেলিভিশন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রসহ (এসি) সব ধরনের ইলেকট্রনিক পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি হতো। দিন বদলে গেছে। চাহিদা বাড়তে থাকায় ধীরে ধীরে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে সরঞ্জাম এনে সংযোজন করে বাজারজাত শুরু করেছে। আর এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে রেফ্রিজারেটর। গত বছর দেশে প্রায় ৪০ লাখ ফ্রিজ বিক্রি হয়েছে। তার মধ্যে বড় অংশই দেশীয় কোম্পানির দখলে। ফ্রিজের বাজারের ৯০ শতাংশই বর্তমানে দেশি কোম্পানিগুলোর দখলে।

রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ বর্তমান সময়ে প্রাত্যহিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। গ্রাহক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে বাজার বড় হচ্ছে দেশি রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ কোম্পানিগুলোর। বিভাগীয়, জেলা ও মফস্বল শহর ছাড়িয়ে এখন গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে ফ্রিজের বাজার। প্রতি বছর দেশে ৪০ লাখের বেশি ফ্রিজ বিক্রি হচ্ছে। টাকার অঙ্কে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। বাজারসংশ্লিষ্টদের ধারণা, আগামী দুই বছরের মধ্যে দেশে ফ্রিজের বাজার সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। উদ্যোক্তাদের মতে, ২০১০ সালে বাংলাদেশে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর মার্কেট শেয়ার ছিল ৮০ শতাংশ। সেখানে ২০২৩ সালে চিত্রটা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। এখন বাজারের মাত্র ২০ শতাংশ শেয়ার বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর দখলে। সাশ্রয়ী মূল্য, গুণগত মান, দেশের মানুষের চাহিদা ও আবহাওয়া উপযোগী হওয়ার কারণে গ্রাহক দেশি ব্র্যান্ডগুলোর ফ্রিজ কিনতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। শহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মফস্বল ও গ্রাম পর্যায়েও প্রতিনিয়ত ফ্রিজের ব্যবহার বাড়ছে।

একাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। আর শহর থেকে প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছে গেছে বিদ্যুতের সংযোগ। আবার নগরজীবনে ব্যস্ততাও বেড়েছে। সব মিলিয়ে তাই গৃহস্থালি ইলেকট্রনিক পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে দেশে এসব পণ্যের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে। প্রতি বছর ২০-২৫ শতাংশ হারে গৃহস্থালি ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজারটি বড় হচ্ছে। সম্ভাবনা থাকায় ইলেকট্রোমার্ট, ওয়ালটন, ভিশন, যমুনা, কিয়াম, মিনিস্টারসহ কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান গৃহস্থালি ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনে মনোযোগী হয়েছে। সরকারও এ খাতে নীতিসহায়তা দিচ্ছে।

যমুনা ইলেকট্রনিক অ্যান্ড অটোমোবাইলসের পরিচালক (বিপণন) সেলিম উল্যা বলেন, ২০২০ সালে মার্কেট রিসার্চ অনুসারে দেখা যায়, ২০১০ সালে মার্কেট শেয়ারের ২০ ভাগ ছিল লোকাল ব্র্যান্ডগুলোতে। ৮০ শতাংশ আন্তর্জাতিক ছিল। ২০২০ সালে এসে দেখা যায়, ৮০ শতাংশ লোকাল ব্র্যান্ড হয়েছে আর ২০ শতাংশ আন্তর্জাতিক  ব্র্যান্ডের হয়েছে। সরকারের ব্যবসাবান্ধব নীতির কারণে রেফ্রিজারেটর শিল্প এ অবস্থানে পৌঁছেছে। এ শিল্পে সরকার আমাদের আগে থেকেই শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে থাকে, যা ২০২৩ সালে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। শুল্কমুক্ত যে সুবিধাটা পাচ্ছি এটা মিনিমাম ২০৩০ সাল পর্যন্ত যেন নেওয়া হয় তাহলে আমাদের এ শিল্পটা আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। বিগত কয়েক বছর ধরে ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহ দিতে নানা রকম ছাড় দিয়ে আসছে সরকার। দেশীয় ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন পণ্যে উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি পেয়েছে। রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার ও তার কম্প্র্রেসারের উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা রয়েছে। গৃহস্থালি ইলেকট্রনিক পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে দেশে এসব পণ্যের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে। প্রতি বছর ২০-২৫ শতাংশ হারে গৃহস্থালি ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজারটি বড় হচ্ছে।

আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর. এন. পাল বলেন, দেশি কোম্পানিগুলোর মধ্যে কোয়ালিটিতে এক নম্বর রেফ্রিজারেটর ব্র্যান্ড ভিশন। গ্রাহকের ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। গত তিন-চার বছর ধরে আমরা যত রেফ্রিজারেটর উৎপাদন করছি তার পুরোটাই বিক্রি হয়ে গেছে। আমি মনে করি এটা আমাদের জন্য বিশাল অনুপ্রেরণা। ভোক্তার চাহিদা পূরণে ভবিষ্যতে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াব। 

র‌্যাংগ্স ইলেকট্রনিক লিমিটেডের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ জানে আলম বলেন, শতভাগ বিদ্যুতায়নের ফলে দেশে রেফ্রিজারেটর শিল্পের বাজার বড় হয়েছে। শহর, নগর, মফস্বলে মানুষের প্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকায় যুক্ত হয়েছে রেফ্রিজারেটর। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৪০ লাখ রেফ্রিজারেটর বিক্রি হয় এই দেশে।

মোহাম্মদ জানে আলম বলেন, এ বছর বৈশ্বিক মন্দার কারণে আমদানির অনেক ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে বিশ্বে যে    ধরনের ডলার ঘাটতি দেখা দিয়েছে তার প্রভাব এখনো কাটেনি। সময়মতো এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে। ফলে চাহিদামতো পণ্য আনতে পারছি না। এমনকি কোনো কোনো পণ্যের দাম ২০-২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। ক্রেতা আগ্রহ বাড়াতে আমরা পণ্যের মান, ডিজাইন এবং সেবায় জোর দিয়েছি। আমাদের রেফ্রিজারেটরে নতুন ফিচারের পাশাপাশি নানা সুবিধাযুক্ত করে আকর্ষণীয় করে তৈরি করার চেষ্টা করছি।

 

 

সর্বশেষ খবর