সোমবার, ৬ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

বড় হচ্ছে নির্মাণসামগ্রীর বাজার

নিজস্ব প্রতিবেদক

বড়  হচ্ছে  নির্মাণসামগ্রীর  বাজার

গত পাঁচ বছরে দেশে সিরামিক পণ্যের চাহিদা বেড়েছে ২২ শতাংশের বেশি। দেশে সিরামিক পণ্যের বাজার প্রায় ১০০ কোটি ডলারের। যার মধ্যে টাইলস পণ্যের বাজার ৬৫ কোটি ডলার। টেবিল ওয়্যারের বাজার ১৮ কোটি ডলার ও স্যানিটারি ওয়্যারের বাজার সাড়ে ৭ কোটি ডলারের...

 

বাংলাদেশের একটি ক্রমবর্ধমান উৎপাদন খাত নির্মাণসামগ্রী শিল্প। আবাসনের চাহিদা বাড়ায় বড় হচ্ছে নির্মাণসামগ্রীর বাজার। রড, সিমেন্ট, ইট, বালু, পাথর, সিরামিক টাইলসসহ সব ধরনের উপকরণের চাহিদা বেড়েছে। সিরামিকস পণ্য টাইলস এসব পণ্যের মধ্যে অন্যতম। দেশের প্রথম সিরামিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাজমা সিরামিক। চিনামাটির থালাবাসন উৎপাদনের মাধ্যমে ১৯৫৮ সালে এ শিল্পের যাত্রা শুরু হয় বগুড়ায়। বর্তমানে দেশে ৭০টির বেশি সিরামিক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার মধ্যে ৩২টি প্রতিষ্ঠান টাইলস উৎপাদন করছে। ২০টি টেবিল ওয়্যার এবং ১৮টি প্রতিষ্ঠান স্যানিটারি ওয়্যার উৎপাদন করছে। গত পাঁচ বছরে দেশে সিরামিক পণ্যের চাহিদা বেড়েছে ২২ শতাংশের বেশি। দেশে সিরামিক পণ্যের বাজার প্রায় ১০০ কোটি ডলারের। যার মধ্যে টাইলস পণ্যের বাজার ৬৫ কোটি ডলার। টেবিল ওয়্যারের বাজার ১৮ কোটি ডলার ও স্যানিটারি ওয়্যারের বাজার সাড়ে ৭ কোটি ডলারের। আগের ১০ বছরের তুলনায় বর্তমানে সিরামিক পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে ২০০ শতাংশের মতো। টেবিল ওয়্যারের বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২১ কোটি বর্গমিটার, টেবিল ওয়্যার প্রায় ৩১ কোটি পিস ও স্যানিটারি ওয়্যার ২ কোটি পিস ছাড়িয়েছে। গত ৩০ বছরে সিরামিক শিল্পে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ১৭০ কোটি ডলার। যার মধ্যে টাইলস উৎপাদনে বিনিয়োগ হয়েছে ৬২ শতাংশ। বর্তমানে এ খাতে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেন ৫২ হাজারের বেশি মানুষ। পরোক্ষভাবে যুক্ত ৫ লাখের বেশি মানুষ। ৯৬ শতাংশ টেবিল ওয়্যার, ৭৭ শতাংশ টাইলস ও ৮৯ শতাংশ স্যানিটারি ওয়্যার পণ্যের চাহিদা পূরণ করে দেশের সিরামিক শিল্প। ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে ৭ শতাংশ হওয়ায় বিশ্বের একটি দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে একটি বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছর দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৩৬০ টাকা। দেশের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ বা ৪ কোটি মানুষ মধ্যবিত্ত। ২০৩০-৪০ সালনাগাদ মধ্যবিত্ত আরও ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হয়। এ ছাড়াও বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে গত ১০ বছরে দ্রুত নগরায়ণ বেড়েছে। নগরায়ণ বৃদ্ধির গড়হার ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং ২০৫০ সালনাগাদ ৫৬ শতাংশ মানুষ নগর এলাকায় বসবাস করবে বলে অনুমান করা হয়। ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, উচ্চ নগরায়ণ বৃদ্ধি দেশের আবাসন ব্যবসাকে প্রসারিত করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সিরামিক যেহেতু নির্মাণ খাতের অন্যতম প্রধান উপকরণ সরবরাহকারী, তাই আবাসন খাতের প্রসারে এই শিল্পও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। গত সাত বছরে শেলটেক, ডিবিএল, গ্রেট ওয়াল, সিবিসি, সিরামিকের মতো বড় কোম্পানিগুলোতে প্রায় ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ এসেছে। যার ফলে মোট বিনিয়োগ ১৭০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) তথ্য মতে, আকিজ গ্রুপ, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের মতো  ২০টি নতুন কোম্পানি প্রায় ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। অন্যদিকে ফু-ওয়াং সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, বিএইচএল সিরামিক কোম্পানিসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি চীন ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার আশা করছে। বাংলাদেশের সিরামিক পণ্য যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, নরওয়ে, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়াসহ ৫০টির বেশি দেশে রপ্তানি করা হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সিরামিক রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৪ কোটি ১৩ লাখ ডলারের বেশি। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পেলে আগামীতে সিরামিক পণ্য রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে গ্রেট ওয়াল সিরামিকস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সামছুল হুদা বলেন, বর্তমানে শুধু টাইলসের বাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি এবং আমাদের দেশে প্রায় ৩২টির মতো টাইলসের কারখানা আছে। সব কারখানা কমবেশি উৎপাদনে আছে। আমাদের দেশের মোট বাজারের প্রায় ৮২ শতাংশই এসব দেশীয় কারখানার দখলে। দ্রুত নগরায়ণের কারণে দেশের বাজারে টাইলসের চাহিদা বেড়েছে। আর সে কারণে স্থানীয় বাজারে অনেকেই মনোনিবেশ করছেন এবং স্থানীয় উৎপাদনকারীরা বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদন করায়  টাইলস খাতের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে বর্তমানে টাইলসের বাজার প্রায় ৫ হাজার ১৫০ কোটি টাকার মতো। কিন্তু দ্রুত নগরায়ণ, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের মাঝে টাইলসের ব্যবহার বৃদ্ধি, সরকারের ব্যাপক উন্নয়নমূলক প্রকল্প থাকায় আগামী এক দশকে টাইলসের বাজার ১০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।  এনপলি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) মো. মাহমুদুল ইসলাম শামীম বলেন, দেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন কার্যক্রম বাড়ার ফলে বাংলাদেশে বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালসের চাহিদা প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ চাহিদা পূরণে আমরা বিভিন্ন ধরনের ইউপিভিসি পাইপ অ্যান্ড ফিটিংস, সিপিভিসি, এইচডিপি, পিভিসি ডোর অ্যান্ড শিট, ওয়াটার ট্যাংক অ্যান্ড ট্যাপ, প্লাস্টিক হাউজহোল্ড ও ফার্নিচার পণ্য তৈরি করি। এ মুহূর্তে আমরা বাজারের মোট চাহিদার ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত পূরণ করতে পারি।  তিনি আরও বলেন, ন্যাশনাল পলিমারের পণ্য উৎপাদনে বিশ্বের সেরা প্রযুক্তি ব্যবহার হয়। কারখানার নিজস্ব ল্যাবে হাইড্রোস্টাটিক প্রেসার টেস্ট, ইমপ্যাক্ট স্ট্রেন্থ টেস্টসহ অন্যান্য সব ধরনের টেস্টে উত্তীর্ণ হওয়ার পর বুয়েট ও বিএসটিআই          টেস্টে উত্তীর্ণ আমাদের পণ্য। এ ছাড়া আমাদের পণ্য ভারত, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মান নির্ধারণী প্রতিষ্ঠানসহ বৈশ্বিক মান নির্ধারণী সনদ প্রাপ্ত। এ বিষয়ে আকিজ সিরামিকসের জিএম মোহাম্মদ আশরাফুল হক বলেন, দিন দিন টাইলস শিল্পের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। তবে বিগত এক দশকে এই শিল্পের প্রবৃত্তি ২০% থাকলেও এখন সেটা ডিক্লাইন্ড করছে। প্রধান কারণ হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি; ব্যাংকিং সেক্টরের সমস্যা (এলসি ও অন্যান্য)। এ ছাড়া কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি; গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। তারপরও আমরা টিকে আছি। কিন্তু গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ না থাকার কারণে আমাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। আমাদের নিয়মিত উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাহত হচ্ছে। যেহেতু এটি শতভাগ গ্যাসনির্ভর শিল্প তাই গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ অত্যাবশ্যক। তবে নগরায়ণ বৃদ্ধির ফলে দিন দিন এই শিল্পের বাজার বাড়ছে। আমরা আশাবাদী। এটা ঘুরে দাঁড়াবেই ইনশা আল্লাহ। তিনি আরও বলেন, সামগ্রিকভাবে টাইলস শিল্পে ইতোমধ্যে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ইনভেস্ট রয়েছে। আরও পাইপলাইনে ইনভেস্টমেন্ট আছে। এই শিল্পে সরাসরি (প্রত্যক্ষভাবে) প্রায় ২০ হাজার এবং পরোক্ষভাবে ২ লাখ কর্মী কাজ করছেন। এই মুহূর্তে টাইলসের বাজার প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা; যার সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা লোকাল কোম্পানিগুলো কন্টিবিউট করছে। বাকি ৫০০ কোটি টাকা ইম্পোর্ট ম্যাটিরিয়ালস ক্যারি করছে। বর্তমানে বাংলাদেশের হার্ডওয়্যার ও ভবন নির্মাণ শিল্পের গ্রোথ রেট ২.৪৯ শতাংশ। এর মধ্যে শুধু সিরামিক খাতের বার্ষিক গ্রোথ ২০ শতাংশ। এই সম্ভাবনাময় শিল্পটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের যে প্রতিবন্ধকতাগুলো আছে সেগুলো লাঘব করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাই।

সর্বশেষ খবর