বুধবার, ৫ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

দেশেই তৈরি বিশ্বমানের ফ্রিজ

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশেই তৈরি বিশ্বমানের ফ্রিজ

এখন অত্যাধুনিক ও টেকসই স্মার্ট রেফ্রিজারেটর প্রস্তুত করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও করছে। এতে  একদিকে আমদানির প্রয়োজন কমায় বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। আবার রপ্তানি হওয়ার কারণে উল্টো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে দেশ। একই সঙ্গে রেফ্রিজারেটর কোম্পানিগুলো দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে...

 

একটা সময় ছিল রেফ্রিজারেটর ছিল এক ধরনের বিলাসী পণ্য। ধনী ও বণিক শ্রেণির লোকেরাই কেবল ব্যবহার করতেন রেফ্রিজারেটর। শুধু তাই নয়, সে সময় কেবল শহরবাসীর ঘরেই শোভা পেত এ পণ্যটি। খাবার ঠান্ডা ও সতেজ রাখতে রেফ্রিজারেটরের বিকল্প নেই। আবার দামও ছিল অনেক বেশি। সে অনুপাতে মানুষের রোজগার ছিল কম। ফলে গ্রামের মানুষকে তিন বেলাই আলাদাভাবে রান্না করতে হতো। আর শহরের মানুষের বাড়িতে ফ্রিজ থাকার সুবাদে একবার রান্না করেই তিন বেলা এমন কি পরের দিনও খেতে পারতেন। একই সঙ্গে কাঁচা শাকসবজি, ফলমূল, জ্যাম, জেলি টাটকা রাখতে ফ্রিজ ব্যবহার করতেন; যা গ্রামের মানুষের জন্য ছিল এক উচ্চাভিলাষী ও অবাস্তব চিন্তাভাবনা।

এখন আর চিত্র তেমন নেই। অবস্থা পাল্টে গেছে। প্রত্যন্ত গ্রাম ও শহর সবখানেই ফ্রিজের ব্যবহার হচ্ছে। শুধু রেফ্রিজারেটর নয়, স্মার্ট রেফ্রিজারেটরের ব্যবহারও বাড়ছে গ্রাম-শহর সবখানেই। মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে ঘরে ঘরে শোভা পাচ্ছে স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের রেফ্রিজারেটর। একসময় যখন চাহিদার পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো, সেখানে এখন দেশি ব্র্যান্ডের অত্যাধুনিক ফ্রিজই দেশের চাহিদা পূরণ করছে। এর পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের তৈরি রেফ্রিজারেটর। বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোকে পেছনে ফেলে দেশি কোম্পানি ওয়ালটন, র‌্যাংগ্স, যমুনা, কনকা, মিনিস্টারের আধিপত্য চলছে ফ্রিজের বাজারে। এ কোম্পানিগুলো ভিন্ন ব্র্যান্ডের ফ্রিজ উৎপাদন করছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুারো (ইপিবি)-এর তথ্যমতে, প্রতি বছর অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯০ শতাংশের বেশি পূরণ করছে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। একই সঙ্গে সাফল্য আসছে রপ্তানিতেও। গত পাঁচ বছরে এ খাতে রপ্তানির গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫২৩ শতাংশ।

এখন এমন একটা সময় আমরা পার করছি যখন জীবনের প্রতি মুহূর্তেই রেফ্রিজারেটর যেন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত ছোট সংসার আর যত গহিন গ্রামেই বসবাস হোক না কেন, যেখানেই বিদ্যুৎ আছে সেখানেই পৌঁছে গেছে রেফ্রিজারেটর। এ পণ্যটির সুবাদে মানুষের শহর-গ্রামের সুযোগসুবিধা নিয়ে গেছে প্রায় শূন্যের কোঠায়। বিশেষ করে কর্মজীবী মানুষের জীবন করেছে আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্যময় ও সহজতর। যে পরিবারের গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী দুজনই বাইরে কাজ করেন তাদের জীবনে এ রেফ্রিজারেটর এক দারুণ স্বাচ্ছন্দ্যের পণ্য। প্রতি বেলায় রান্না এবং বাজার না করেও টাটকা খাবার খাওয়ার উত্তম পন্থা এ রেফ্রিজারেটর। এমনকি প্রতিদিন রান্নারও প্রয়োজন হয় না। খাবার সংরক্ষণ ও সতেজ রাখতে রেফ্রিজারেটরের বিকল্প নেই।

রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ এখন প্রতিটি বাসাবাড়ির গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। স্মার্ট জীবনযাপনের অংশ হিসেবে ফ্রিজও এখন স্মার্ট বা আধুনিক। খাবারের গুণগত মান ঠিক রাখাই স্মার্ট ফ্রিজের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এখন শুধু খাবার ঠান্ডা রাখার সুবিধাই নয়, ফ্রিজ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে কি না, কম ভোল্টেজেও চলে কি না, বরফ জমে খাবারের গুণগত মান নষ্ট হয় কি না-এসব বিষয়ও বিবেচনায় রাখেন ক্রেতারা। দেশি কোম্পানিগুলো এখন অত্যাধুনিক ও টেকসই স্মার্ট রেফ্রিজারেটর প্রস্তুত করে দেশের চহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও করছে। এতে একদিকে আমদানির প্রয়োজন কমায় বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। আবার রপ্তানি হওয়ার কারণে উল্টো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে দেশ। একই সঙ্গে রেফ্রিজারেটর কোম্পানিগুলো দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে এ পণ্যের ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলছে বিপুলসংখ্যক মানুষ।

বর্তমানে প্রায় সব ব্র্যান্ডের ফ্রিজেই সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ফ্রিজের ‘হৃদয়’ (হার্ট) হচ্ছে কম্প্রেসার। আধুনিক ফ্রিজের কম্প্রেসার হচ্ছে ইনভার্টার প্রযুক্তিসমৃদ্ধ। ফ্রিজের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি হচ্ছে ইনভার্টার। ইনভার্টার থাকার কারণে ফ্রিজ হয় বিদ্যুৎসাশ্রয়ী। ফলে বিদ্যুৎ বিল অনেক কম আসে। আধুনিক ফ্রিজগুলোয় আরও রয়েছে স্মার্ট নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। রয়েছে ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) প্রযুক্তি। অর্থাৎ ইন্টারনেটেও যুক্ত হতে পারে ফ্রিজ। ফ্রিজে রাখা খাবারদাবারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

আধুনিক রেফ্রিজারেটরে রয়েছে আরও কিছু বৈশিষ্ট্য। টুইন কুলিং প্লাস প্রযুক্তি থাকায় দুটি কুলিং ফ্যান ও দুটি ইভাপোরেটর কাজ করে। এতে দুর্গন্ধ ছড়ায় না, ৭০ শতাংশ আর্দ্রতা বজায় থাকে। রয়েছে স্মার্ট কনভারশন। ডিজিটাল ইনভার্টার প্রযুক্তির ফলে    ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়। আরও আছে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধক, কুল প্যাক (সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা ব্যাকআপ), কুল সিলেক্ট জোন বা ফ্লেক্স জোন, বিল্ট-ইন স্ট্যাবিলাইজার, ডোর অ্যালার্ম ও ডিওডোরাইজিং ফিল্টার।

এদিকে দুই দশক ধরে ফ্রিজের বাজার বেড়েছে দ্রুতগতিতে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতায়ন ও সহজ কিস্তিতে কেনার সুবিধা থাকায় দ্রুত বড় হচ্ছে এ বাজার। এ খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে দেশে ফ্রিজের বাজার ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বছরে ৩২ থেকে ৩৫ লাখ ফ্রিজ বিক্রি হচ্ছে। দেশি কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত ফ্রিজ দিয়েই অভ্যন্তরীণ চাহিদার বেশির ভাগ মিটছে। একই সঙ্গে দেশে উৎপাদিত ফ্রিজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও হচ্ছে। বিশ্বের অন্তত ৪০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে শুধু ওয়ালটনের তৈরি ফ্রিজ।

পবিত্র ঈদুল আজহা ঘিরে ফ্রিজের চাহিদা এরই মধ্যে বেড়েছে বলে জানান বিক্রেতারা। প্রতি বছর ৬০ শতাংশের বেশি ফ্রিজ দুই ঈদে বিক্রি হয়। তবে কোরবানির ঈদে ফ্রিজের চাহিদাটা একটু বেশিই থাকে। কারণ মানুষ কোরবানির পশুর মাংস ভালোভাবে সংরক্ষণে ফ্রিজ কিনে থাকেন। ঈদ মাথায় রেখে দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলোও ফ্রিজের নতুন নতুন মডেল সংযোজন করেছে।

ক্রেতা টানতে মূল্যছাড়সহ বিভিন্ন অফার দিয়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি ফ্রিজ বিক্রির আশা করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারে একাধিক ফ্রিজের ব্যবহার রয়েছে। এর বাইরে আবাসিক হোটেল, মোটেল, রিজর্ট, ফাইভ স্টার হোটেল-রেস্টুরেন্ট, সুপার শপ, ওষুধের দোকান, হাসপাতাল, অফিসসহ প্রায় সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেই একাধিক ফ্রিজ ব্যবহৃত হচ্ছে।

দেশে এক যুগ আগে ফ্রিজের বার্ষিক চাহিদা ছিল ১০ লাখের মতো। তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ থেকে ৩৫ লাখে। গত দেড় দশকে সরকারের নীতিসহায়তা, দেশি বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর বিনিয়োগের কারণে বর্তমানে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশের বেশি মার্কেট শেয়ার দেশি ব্র্যান্ডগুলোর। দেশি-বিদেশি ১৩টি কোম্পানি দেশে ফ্রিজ উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। বছরে ১৫ শতাংশ হারে ফ্রিজের বাজারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় গৃহস্থালি পণ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান আরএফএল গ্রুপ ২০১৩ সালে ‘ভিশন’ ব্র্যান্ড নামে ফ্রিজ উৎপাদন শুরু করে। সাশ্রয়ী মূল্যে আধুনিক প্রযুক্তির রেফ্রিজারেটর ভোক্তার হাতে পৌঁছে দিতে নরসিংদীর ডাঙ্গায় নিজস্ব কারখানায় এ পণ্যটির উৎপাদন শুরু হয়। কারখানায় বছরে ৬ লাখ ফ্রিজ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।

বাজারে শীর্ষে থাকা ওয়ালটন ২০০৮ সালে ফ্রিজের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি ফ্রিজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কম্প্রেসার উৎপাদন শুরু করে। বর্তমানে দেশের পাশাপাশি রপ্তানি বাজারেও ভালো অবস্থান তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। গত বছর ওয়ালটন ১ লাখের বেশি ফ্রিজ রপ্তানি করেছে। ফ্রিজের বাজারে আরও রয়েছে র‌্যাংগ্স ও যমুনা কোম্পানির নানা ব্র্যান্ড। এসব কোম্পানিও ঈদুল আজহা উপলক্ষে বিভিন্ন অফার ঘোষণা করেছে।

২০২১ সালে প্রকাশিত মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশ (এমডব্লিউবি)-এর গবেষণা বলেছে, ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশের ফ্রিজের বাজার বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। বর্তমানে দেশে ফ্রিজের বাজারের বেশির ভাগই দেশি ব্র্যান্ডের দখলে। এর মধ্যে এককভাবে দেশি ব্র্যান্ড ওয়ালটনের দখলে অনেকখানি অংশ। বাকিগুলো মিনিস্টার, ভিশন, যমুনা, মার্সেলসহ অন্যদের দখলে। আর বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে সিঙ্গার, স্যামসাং, কনকা, শার্প, এলজি উল্লেখযোগ্য। এমডব্লিউবির এক জরিপে বলা হয়, দেশি-বিদেশি মিলে মোট ফ্রিজের চাহিদার ৯৫ শতাংশই দেশে উৎপাদন করা হয়। এর বাইরে বিদেশ থেকে সরাসরি আমদানি করা হয় ৫ শতাংশ।

দেশে রেফ্রিজারেটর উৎপাদনের প্রথম উদ্যোগ নেয় দেশি প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন। তারপর একে একে যমুনা, মিনিস্টার, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ভিশন, ট্রান্সকম ও ওরিয়ন কারখানা স্থাপন করে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে দেশে ফ্রিজ উৎপাদনের কারখানা গড়ে তুলেছে স্যামসাং, সিঙ্গার, ওয়ার্লপুল, কনকাসহ বেশ কয়েকটি বিদেশি ব্র্যান্ড। অন্যদিকে দেশের ফ্রিজের বাজার একসময় আমদানিনির্ভর ছিল। সে নির্ভরতা থেকে বের হয়ে অভ্যন্তরীণ বাজার এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্থানীয় বাজারের ৯০ শতাংশের বেশি চাহিদা পূরণ করছে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। সাফল্য আসছে রপ্তানিতেও। গত পাঁচ বছরে রপ্তানির গড় প্রবৃদ্ধি ৫২৩ শতাংশ।

ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, সদ্যবিদায়ী অর্থবছরে (২০২২-২৩) রেফ্রিজারেটর রপ্তানিতে আয় হয়েছে ১ কোটি ৫৮ লাখ ২৮ হাজার ৭৮৩ ডলার। দেশি মুদ্রায় প্রতি ডলার ১১৭ টাকা দরে ১৮৫ কোটি ১৯ লাখ ৬৭ হাজার ৬১১ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ আয় ছিল ৫ লাখ ৮২ হাজার ৮১১  ডলার। সে হিসেবে গত পাঁচ বছরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১ কোটি ৫৭ লাখ ৭০ হাজার ৫০২ মার্কিন ডলার। পাঁচ বছরে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫২৩ শতাংশ।

সর্বশেষ খবর