জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া থেকে রেহাই পেতে এখনি পদক্ষেপ না নিলে বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবন বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে বলে কানাডার তিন জন পরিবেশ এবং জলবায়ু বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে দিয়েছেন।
তারা নানা ধরনের মেরুকরণ এবং রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য নিরাপদ পৃথিবী নিশ্চিত করার তাগিদ দেন।
কানাডার বাংলা পত্রিকা ‘নতুনদেশ’ এর প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগরের সঞ্চালনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ‘শওগাত আলী সাগর লাইভে’র আলোচনায় তারা এই মত প্রকাশ করেন।
স্থানীয় সময় বুধবার রাতে ‘কোভিড থেকে বাঁচা যাবে, জলবায়ু পরিবর্তন থেকে!’ শিরোনামে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
তিন বিশেষজ্ঞই পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া এবং প্রভাব তুলে ধরেন। তারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে পরিবেশ সহায়ক ভূমিকা রাখার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।
আলোচনায় অংশ নিয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. এম মনিরুল মির্জা বলেন, করোনাভাইরাস অস্থায়ী কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন কয়েক দশত ধরে চলতে থাকবে এবং বিশ্বব্যাপী বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। বিশ্বের কোনো অঞ্চলই এই পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা পাবে না।
তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য নানা ধরনের প্রতিক্রিয়ার বিবরণ তুলে ধরে বলেন, ক্রমবর্ধমান পরিবেশ দুষণ দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, জনস্বাস্থ্য এবং খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। ইউরোপের মতো দেশে উত্তাপে শত শত মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
ড. এম মনিরুল মির্জা খাদ্য উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রতিক্রিয়ার আশংকা প্রকাশ করে বলেন, বৈশ্বিক খাদ্য সুরক্ষার জন্য একটি সহযোগিতা পরিকল্পনা করতে হবে। ধনী, দরিদ্র, উন্নত, অনুন্নত সবদেশকেই নিয়েই এটি করতে হবে, কেননা- জলবাযু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া সবদেশকেই খাদ নিয়ে চিন্তায় ফেলবে।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ খাজা মিন্নাত উল্লাহ বলেন, পরিবেশ বা জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টা এখনো এক ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে আছে। অনেকেই বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের মানুষেরা মনে করেন এটি আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। এক শত বছরে কিছু একটা হলে হতেও পারে, নাও হতে পারে। এই ধরনের মনোভাব জলবাযু পরিবর্তনের ব্যাপারে মানুষকে তেমনভাবে মনোযোগি করতে পারছে না।
তিনি বলেন, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংকসহ নানা ধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে, মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছে। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভুমিকার প্রশংসা করে আন্তর্জাতিক সংস্থার সাবেক এই উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, একটি নতুন দেশ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার সচেতনতা এবং কর্মপরিকল্পনায় বাংলাদেশ উল্লেখ করার মতো অগ্রগতি করেছে। বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে ক্লাইমেট চেঞ্জ রিজিলিয়েন্স বা বিসিআর তৈরি করেছে, বাস্তবায়ন মেকানিজমসহ পলিসি ডকুমেন্ট তৈরি করেছে। নিজস্ব তহবিল থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বাংলাদেশ ব্যয় করেছে জলবায়ু পরিবর্তনের পদক্ষেপ বাস্তবায়নে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তানজিনা মোহসীন বলেন, কোভিডের আলোচনায় সবসময়ই মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেয়া হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে বিপর্যয় তৈরি হচ্ছে তাতে কি পরিমান লোক মারা যচ্ছে- সেই হিসাব কখনোই সামনে আসে না। কোভিড হচ্ছে অদৃশ্য শক্তি, তবু এর হাত থেকে রেহাই পেতে আমরা ভ্যাকসিন তৈরি করে ফেলেছি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া তো চিহ্নিত এবং দৃশ্যমান বিষয়। ভ্যাকসিন দিয়ে এটি দুর করে ফেলতে পারবো না। সারা বিশ্বকে এক হয়ে এ থেকে পরিত্রানের পথ বের করতে হবে।
তিনি বলেন, বিশ্বের দেশে দেশে নগর পরিবেশন দূষণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। ফলে সরকারকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেই নগরায়নের পদক্ষেপ নিতে হয়। কিন্তু ঢাকা চট্গ্রামের মতো শহরগুলো গড়ে উঠেছে পরিকল্পনাহীন। সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হচ্ছে- এই শহরগুলোয় সবুজ এলাকা কমে যাচ্ছে।
অধ্যাপক তানজিনা মোহসিন টরন্টো সিটির নানা পদক্ষেপের উল্লেখ করে বলেন, টরন্টোসহ উন্নত দেশের শহরগুলোতে দালান কোঠা নির্মাণের ক্ষেত্রে সবুজায়নকে গুরুত্ব দেয় হয়। তিনি ঢাকা- চট্টগ্রামে সবুজায়নের তাগিদ দিয়ে বলেন, এটি অত্যন্ত জরুরী।
নতুনদেশ এর প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগর তাঁর আলোচনায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার বিভিন্ন দিক নিয়ে সহজবোধ্য ভাষায় আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাংলাভাষাভাষী মানুষকে সচেতন করে তোলার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, আমরা রাজনীতি নিয়ে যতো কথা বলি, পরিবেশ দূষণ বা জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে সেইভাবে কথাবার্তা বলি না। অথচ বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীরা এটিকে কোভিডের মতোই মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে মনে করছেন।
বিডি-প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন