একক পরিবারের দাপটে ভেঙে বিলুপ্তির পথে যৌথ পরিবার ধারণা। বর্তমান সময়ে সামাজিক বিপর্যয়ের কারণগুলো নিয়ে চিন্তা করতে গেলে যে বিষয়গুলো সামনে এসে দাঁড়ায় তার ভিতরে অন্যতম হল যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে এসে শহরমুখী একক পরিবার গঠন। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছেন এবং পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে। এটা নিঃসন্দেহে একটা ইতিবাচক দিক। তবে রোগ সারাতে ওষুধ যেমন দরকারী, তেমনি ওষুধের ভুল প্রয়োগ মৃত্যু ডেকে আনতে পারে এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। একইভাবে যারা যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে এসে দু'জনেই বাইরে কাজ করেন, সন্তানদের রেখা যান গৃহকর্মীর কাছে, সেই সন্তানও ভুল ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার শিকার হয়। শিক্ষিত ভদ্র পরিবারের সন্তানগুলো দিনের পর দিন বেড়ে উঠতে থাকে শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত অশিক্ষিত গৃহকর্মীর আচার-আচরণ, ভাষা অনুসরণ ও অনুকরণ করে। সারাক্ষণ গৃহকর্মীর সংস্পর্শে থেকে তাদের সন্তানদেরও মানুষিক বিকাশ হয় নিম্নমানের। স্বজনের সান্নিধ্য ছাড়া শিশুটি বেড়ে উঠতে থাকে টেলিভিশন, কম্পিউটার আর ভিডিও গেমকে সঙ্গী করে। ফলে তার মধ্যে সৃষ্টি হয় বিচ্ছিন্নতাবোধ।
আমাদের শিশুদের বেড়ে ওঠার কথা ছিল বাবা-মা, আত্নীয়-স্বজনের ভালবাসায়, পরিবারের নিবিড় স্পর্শে। দাদার হাত ধরে তার যাওয়ার কথা ছিল মসজিদ-মন্দিরে, দাদীর বুকে শুয়ে গল্পের ছলে তার শেখার কথা ছিল মহা মানবদের জীবনী। বাবা-মায়ের ভালবাসায় তার বেড়ে ওঠার কথা ছিল মানুষের মত মানুষ হয়ে। অথচ সন্তানের ভবিষ্যতের ছুঁতোয় আমরা বাবা-মায়েরা তাদের কোথায় ছেড়ে যাচ্ছি একবারও কী সেটা কেউ ভেবে দেখেছি? যে শিশুকে আমরা শৈশবে, কৈশোরে কলকব্জার খেলনা ছাড়া কিছুই দিতে পারিনি যৌবনে তাদের কাছে আমরা কী আসা করতে পারি? যে শিশু কখনো দেখল না আত্নীয়তার বন্ধন, কখনো পেল না নীতি-নৈতিকতার স্পর্শ, যার জীবনে কোনো ধর্মীয় শিক্ষা নেই, পারিবারিক শিক্ষা নেই, যে বড় হয়েছে ডোরেমন অথবা হিন্দি সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকাকে আদর্শ ভেবে তার কাছে এই সমাজ সংসার কী আশা করতে পারে? একবার ভেবে দেখবেন কী? যুগের দোহাই দিয়ে আমরা যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে এসে শুধু যে সন্তানদের ক্ষতি করছি তা কিন্তু নয়, নিজেদেরও ঠেলে দিচ্ছি এক অতল অন্ধকারে। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, সুশিক্ষার অভাব ও সামাজিক-পারিবারিক বিধিনিষেধের জাল ছিন্ন হওয়ায় আজ ঘরে ঘরে ভাইসারের মত ছড়িয়ে পড়েছে পরকীয়া, বিবাহবহির্ভুত যৌনতা, লিভটুগেদারের মতো অপসংস্কৃতি। স্বামী একদিকে তো স্ত্রী অন্য দিকে। ফলাফল গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ব্যাপকহারে বিবাহবিচ্ছেদ। প্রতিদিন এসব অপকর্মের ফসল হিসেবে আমরা প্রায়ই খবরের কাগজে দেখতে পাই ডাস্টবিনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানব ভ্রুণ। আবার যারা বাইরে কাজ করেন না তাদের বেশিরভাগ মায়েরা ইদানিং আসক্ত হয়ে পড়েছেন হিন্দি সিরিয়ালে। রান্না, খাওয়া আর সিরিয়ালের সিডিউল মনে রাখা ছাড়া তাদের জীবনে যেন আর কোনো কাজ বা দায়িত্ব নেই। তাদের সন্তান কী খায়, কোথায় যায় বা কাদের সাথে মেশে এগুলো খোঁজ রাখার সময় বা প্রয়োজনটুকু হয়ত তারা বোধ করেন না। অনেক বাবারাও এখন এ থেকে পিছিয়ে নেই। সুতরাং, একটা অবক্ষয়ের প্রজন্ম সৃষ্টিতে কি আমরাই ভূমিকা রাখছি না?
সামান্য একটু পিছনে ফিরে তাকালে আজ থেকে বিশ বছর আগেও এসব চিত্র ছিল শতকরা ১ ভাগেরও কম। তখন পুরো পরিবার একসাথে বসবাস করত, সাময়িক মনমালিন্য থাকলেও সুখে দুখে সবাই একসাথে মিলেমিশে থাকত। একে অপরের বিপদে ঢাল হয়ে সামনে দাঁড়াত। আর এখন ভাই ভাইকে, সন্তান পিতা-মাতাকে খুন করছে। মায়া, মমতা, ভালবাসা, শ্রদ্ধাবোধ সবটুকুই বিলুপ্তির পথে। দায়ভার কার?
লেখক: একজন মা, নারী উদ্যেক্তা ও উপন্যাসিক
ইমেইল: [email protected]