৯ ডিসেম্বর, ২০১৬ ১২:২২

ইটভাটা ও পরিবেশ দূষণ: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

আজিজুল হাকিম

ইটভাটা ও পরিবেশ দূষণ: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই মানুষ তার প্রয়োজনে বিশাল ভবন এবং বিভিন্ন নান্দনিক গঠনের অবকাঠামো তৈরী করে আসছে। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে এই বিশাল বহুতল ভবন নির্মানে কংক্রিট, অ্যালুমিনিয়াম সিট, প্লাষ্টিক, কাঁচ ফাইবার, স্টীল এবং ধাতব বস্তুর ব্যাপক ব্যবহার হলেও বাংলাদেশসহ বহু স্বল্পোন্নত দেশে প্রধানত ব্যবহার হচ্ছে ইট। আর এই ইট তৈরীতে ব্যবহার হয় প্রকৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তম উপাদান মাটি, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা নেওয়া হয় কৃষি জমি থেকে যাকে প্রকৃতির বর্জ্যের ঝুড়ি বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে সাধারণত বছরের অক্টোবর থেকে মার্চ মাসকে ইট তৈরীর উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেন ইট কারখানার মালিকেরা। ইট ভাটার মালিকেরা কৃষকদের লোভ দেখিয়ে এককালীন অল্প কিছু টাকা দিয়ে চাষাবাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জমির উপরি অংশের মাটি কেটে নিয়ে যায় ইট তৈরীর কাজে ব্যবহারের জন্য।

আজকের এই আধুনিক বিশ্বে ইটের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু নিয়ম না মেনে এই প্রয়োজনীয় বস্তু তৈরীতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পরিবেশ, মানুষের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস, স্বাস্থ্য, উর্বর মাটি এবং অতি উপকারী বায়ু। ইট তৈরীতে পোড়ানো হচ্ছে শত শত একর জমির উর্বর অংশ। বাংলাদেশে অনুমোদিত ইট ভাটার সংখ্যা ৬,০০০ (দি ডেইলি স্টার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০০৯)। তবে অনুমোদন ছাড়াও রয়েছে অনেক ইট ভাটা যেখানে কাঠ এবং কয়লাকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দি ডেইলি স্টারে (২০১২) প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় আইন থাকা সত্ত্বেও দেশে গতানুগতিক পদ্ধতিতে ইট তৈরী করছে ১,১০০ ইট ভাটা। আর এই সব ইট ভাটার জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কাঠ যা প্রতি বছর বাংলাদেশের ইট ভাটার ২৫% জ্বালানী সরবরাহ করে থাকে। এই প্রাকৃতিক কাঠ পোড়ানোর ফলে একদিকে যেমন নষ্ট হচ্ছে বনজ সম্পদ, অন্যদিকে নষ্ট হচ্ছে ওইসব বনে বসবাসকারী জীবজন্তুর ভারসাম্য। অতিরিক্ত কয়লা পোড়ানোর ফলে নির্গত হচ্ছে ধূলিকনা, পার্টিকুলেট কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, সালফারের এবং নাইট্রোজেনের অক্সাইডসমূহ  যা চোখ, ফুসফুস ও শ্বাসনালীতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

দৈনিক ইত্তেফাক (২০০৯) এ বলা হয়েছে দেশে গতানুগতিক ধারার ৬,০০০ এর মতো ইট ভাটা রয়েছে যা বছরে ৮.৭৫ মিলিয়ন টন কার্বন নির্গত করে। ইউএনডিপি এর মতে বাংলাদেশে ১০০,০০০ ইট প্রস্তুত করতে ২৩ টন কয়লা পোড়ানো হয়, যেখানে চীন ৭.৮ থেকে ৮ টন কয়লা ব্যবহার করেই একই পরিমান ইট প্রস্তুত করে (UPI, ২০১০)। ঢাকার আশেপাশের এলাকাগুলোতে বিশেষ করে আশেপাশের দশটি জেলায় গতানুগতিক ধারার ইট ভাটাগুলোতে যেখানে  কয়লা ও কৃষি বর্জ্য জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সেখান থেকে প্রতি বছর ২৩,৩০০ টন  (পার্টিকুলেটেড মেটার)২.৫, ১৫,৫০০ টন সালফার ডাইঅক্সাইড, ৩০২,০০০ টন কার্বন মনোঅক্সাইড, ৬,০০০ টন ব্ল্যাক কার্বন এবং  ১.৮ মিলিয়ন টন কার্বন ডাইঅক্সাইড  নির্গত হচ্ছে শুধুমাত্র ৩.৫ বিলিয়ন ইট প্রস্তুত করতে (Sarath et al., ২০১২)। জ্বালানীর উপর নির্ভর করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সালফারের এবং নাইট্রোজেনের অক্সাইডসমূহ এর পাশাপাশি বায়ুতে ভারী ধাতুরও নিঃসরণ ঘটে।

কৃষি জমিতে ভারী ধাতুর উপস্থিতি এবং এসব বস্তুর সম্ভাব্য উৎস  সম্পর্কিত একটি  গবেষণায় ২০১৫ সালে বলা হয় মাটির উপরি অংশে ভারী ধাতু ক্যাডমিয়াম এবং লেড এর উপস্থিতি পার্শ্ববর্তী ইট ভাটার বায়ু দূষণের ফল (Sikder et al., ২০১৫)।
 
গতানুগতিক পদ্ধতির ইটভাটা শুধু বায়ু দূষণই করে না বরং বায়ু হতে বিভিন্ন বায়ুমন্ডলীয় উপায়ে মাটিতে এসব দূষণকে স্থানান্তরিত করে এবং ব্যাপকভাবে মাটি দূষণকে তরান্বিত করে, যা নষ্ট করে মাটির প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্য। একটি হিসেব মতে ২৫০ বর্গমিটার ফ্লোরের একটি ৫তলা ভবন নির্মানের জন্য ৫,০০,০০০ ইট প্রয়োজন যা তৈরীতে ১ হেক্টর ফারো স্লাইস (১০০ মি*১০০ মি* ১৫ সে. মি.) এরও বেশি মাটির উপরি অংশ প্রয়োজন (Osman, ২০১৪), যা মাটি ক্ষয়ের একটি অন্যতম কারন।
 
কৃষি প্রধান এই দেশে ইটভাটার সবচেয়ে বড় প্রভাব হল মাটির উর্বর উপরি অংশ পুড়িয়ে ইট তৈরী যা দেশের কৃষির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে কারন প্রাকৃতিকভাবে মাটি তৈরী একটি সময় সাপেক্ষ বিষয়। আবাসিক এলাকা, কৃষি জমি এমনকি কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকায়ও ইটভাটা তৈরী হচ্ছে বলে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে (ঢাকা ট্রিবিউন, ১৯ জুন ২০১৩,) যা এইসব এলাকার জনস্বাস্থ্য, কৃষি ও বনজ বৃক্ষের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে এবং এটি ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন( নিয়ন্ত্রণ)আইনের লঙ্ঘন।

এতদসত্ত্বেও বিশ্বায়নের এই যুগে ইটের চাহিদাকে সামনে রেখে বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে ইট তৈরী করা হচ্ছে। ইউএনডিপি এর সহায়তায় বাংলাদেশে উন্নত প্রযুক্তিতে ইট তৈরী শুরু হয় ২০০৬ সালে। এই উন্নত পদ্ধতিসমূহ ১৫০ বছরের পুরানো পদ্ধতির পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং যা আমাদের পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য সুখবর বয়ে এনেছে। ভারতে একটি গবেষণায় দেখা যায় পাচঁটি বিভিন্ন পদ্ধতির ইট তৈরীর উন্নত প্রযুক্তির মধ্যে জিগ-জ্যাগ ও ভার্টিকেল সাফ্ট ব্রিক ক্লিন (VSBK) পদ্ধতিতে কার্বন মনোক্সাইড এবং পার্টিকুলেটেড বস্তু  নিঃসরন ৬০-৭০% কমানো সম্ভব (Rajarathram et al., ২০১৪)।

এমতাবস্থায় জনসচেতনতা তৈরী করে উন্নত প্রযুক্তিতে ইট কারখানা তৈরীতে সরকারী ও বেসরকারী অর্থায়ন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ বান্ধব উদ্যোগই পারে একটি পরিবেশ বান্ধব, কম দূষক নিঃসরক ইট তৈরীর পরিবেশ সৃষ্টি করতে যা গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের বিপক্ষে বাংলাদেশের সুদৃঢ় অবস্থানকে নিশ্চিত করবে।

লেখক: শিক্ষক (শিক্ষাছুটি), মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে পিএইচডি গবেষক, সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান)।
ই-মেইল: [email protected]


তথ্যসূত্র:
1.    Osman KT (2014) Soil Degradation, Conservation and remediation. Springer
2.     Rajarathnam U et al., (2014) Assessment of air pollutant emissions from brick kilns. Atmospheric Environment 98 549-553
3.    Sikder AHF et al., (2015) Lead and Cadmium accumulation in nearby brick kiln agri-environmental ecosystems. Bangladesh J. Sci. Res. 28(1): 51-59
4.    Sarath K. et al (2013) Air Qual Atmos Health 6:357–365
5.    The Dhaka Tribune (June 19 2013) http://archive.dhakatribune.com/environment/2013/jun/19/brick-kilns-take-their-toll-environment
6.    The Daily Star ( 03 March 2012) http://epaper.thedailystar.net/index.php?opt=view&page=8&date=2012-03-03
7.    The Daily Ittefaq. (2009, August 30). Deal to reduce carbon omission from
brickfield. http://www.carbonoffsetsdaily.com/newschannels/asia/deal-toreduce
carbon-omission-from-brickfield-11219.htm
UPI. (2010, August 6). Bangladesh adopts green brick making http://www.upi.com/Business_News/EnergyResources/2010/04/06/Bangladeshadopts-green-brick-making/UPI-69981270565548/

বি. দ্র. এই বিভাগের সকল লেখা ও ছবির দায়-দায়িত্ব লেখকের।

বিডি-প্রতিদিন/এস আহমেদ

সর্বশেষ খবর