১৩ আগস্ট, ২০২২ ১৭:৫৯

ফুলের স্বর্গরাজ্য ‘ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার’

মাহবুব সাকিব

ফুলের স্বর্গরাজ্য ‘ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার’

প্রায় ১০ বছরের পরিকল্পনা ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার দেখতে যাব। শুনেছি সে এক স্বপ্নীল উদ্যান। প্রাকৃতিক ভাবে শতশত ফুল ফোটে সেখানে। বহুবার প্ল্যান নিয়েও ভেস্তে যায়, কখনো বন্ধু জোগাড় হয় না, কখনো আবার সময়। যাই হোক অবশেষে দুই বন্ধু ফাইনাল করেই ফেললাম এবার যাবই। তারপর কাঁধব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে প্রস্তুত হলাম ফুলের স্বর্গরাজ্যে যাবার।

১২ জুলাই ঢাকা থেকে রওয়ানা হলাম বেনাপোল স্থলবন্দরের দিকে সেখান দিয়ে বর্ডার পারি দিয়ে কলকাতা যাব। তারপর কলকাতা থেকে গন্তব্যে। ঢাকার মালিবাগ থেকে সোহাগ পরিবহন কাউন্টার থেকে বাস ছাড়লো রাত ১০.৩০ মিনিটে। এবার যাওয়ার আরেকটা আগ্রহ ছিল আমাদের বাস পদ্মা সেতু পারি দিবে, রাতের পদ্মা নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর হবে আর সেই পদ্মা যার অনেক কাছে আমরা যাব। সেই আগ্রহ নিয়ে সামনে যাচ্ছি। রাত প্রায় ১১টার দিকে অপরুপ পদ্মা পারি দিলাম আর উপভোগ করলাম এর বিশালতা। 

যাই হোক রাত ১২টার দিকে ফরিদপুর পারি দিয়ে মাগুরা ঢুকছি আর ভাবছি কত তাড়াতাড়ি কোথায় চলে আসলাম, ব্রিজটা না থাকলে এই সময়ে এখানে কল্পনাতীত।

ভোর ৪টার দিকে বেনাপোল পৌঁছালাম। কিন্তু বর্ডার খুলবে সকাল সাড়ে ৬টায়। এতক্ষণ অপেক্ষা, কী আর করার। দুই বন্ধু বসে অপেক্ষা আর চায়ের কাপে চুমুক। বর্ডার খুলে কার্যক্রম শুরু হলো কিন্তু দুই পারে প্রায় হাজার হাজার মানুষ, বুঝতে পারছিলাম অনেক সময় লাগবে। আমরা বেলা ১২টার দিকে দুই দেশের ইমিগ্রেশন শেষ করে বর্ডারের পাশে এক দোকান থেকে টাকা ডলার চেঞ্জ করে রুপি করিয়ে এবার কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। প্রায় ৫ ঘণ্টা পর গিয়ে পৌঁছালাম কলকাতা শহরে। উফ ভীষণ ক্লান্ত একটা হোটেলে রুম ঠিক করে উঠে পরলাম। এবার রেস্ট। কাল বহুদূরের যাত্রা আবার শুরু করতে হবে।

১৪ জুলাই বেলা ১২টায় আমাদের ফ্লাইট কলকাতা থেকে উত্তরাখন্ডের রাজধানী দেহরাদুনে। যথাসময়েই ফ্লাইট ছাড়লো আমরা দেহরাদুন গিয়ে পৌঁছালাম বেলা ৩টার দিকে। এয়ারপোর্ট থেকে নেমেই দেখি হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়া খুবই আরামদায়ক ছিল। তাপমাত্রা ২০ এর মতো হবে। এয়ারপোর্ট স্ট্যান্ড থেকে একটা ট্যাক্সি রিজার্ভ করলাম ঋষিকেষ বাস স্ট্যান্ডের কাছে। কারণ পরদিন আমাদের বাস স্ট্যান্ড থেকেই যশিমঠ যেতে হবে, তাই হোটেলটা বাস স্ট্যান্ডের কাছে নেওয়ায়ই ভালো হবে। আমরা এসে পৌঁছালাম ঋষিকেষ। 

কিন্তু এখানে এসে একটা সমস্যায় পরতে হলো সেটা হলো ফরেনার থাকার হোটেল পাচ্ছি না। সাধারণত কোন বিদেশি হোটেলে থাকলে হোটেল কর্তৃপক্ষের একটা “সি ফর্ম” ফিলাপ করে থানায় জমা দিতে হয় এটা ইনফরমেটিভ। কিন্তু সাধারণ হোটেলে এই সুবিধা থাকে না। আমরা ঋষিকেষ এলাকায় কোনো হোটেলে এই সুবিধা পাচ্ছি না। অনেকে বুদ্ধি দিল আপনার এখান থেকে ৩/৪ কিলোমিটার দূরে তপোভান চলে যান, ওখানে এই সুবিধা পাবেন অসংখ্য হোটেল আছে। আমরা সেখানে রওয়ানা দিলাম, কিন্তু পথিমধ্যে এক অটোরিক্সা চালকের সাথে সাক্ষাৎ। সে আমাদের ভাঙা ভাঙা হিন্দি শুনে বুঝতে পারলো আমরা বাঙালি, সেই লোকের বাড়ি আবার কলকাতা। তো আমাদের সে খুব সাহায্য করতে চাইলো। আমি বললাম ঠিক আছে দাদা এট লিস্ট একটা হোটেলের ব্যবস্থা করেন, খুব ক্লান্ত রেস্ট দরকার। আমরা অটোতে ঝিম ঝিম অবস্থায় হেলান দিয়ে রইলাম আর বেচারা অটো ড্রাইভার এই হোটেল সেই হোটেল যাচ্ছে কোথাও ব্যবস্থা হচ্ছে না। অবশেষে এক হোটেল ম্যানেজ হলো। হোটেল মালিক হোটেলের সামনে বসে আছে, আমরা বললাম আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি, সে বললো সমস্যা নাই পাসপোর্ট আর ভারতীয় ভিসার কপি দাও আর হোটেলে রেস্ট নাও। যাক অবশেষে শান্তি। হোটেল পাওয়া গেল। হোটেলে উঠে রেস্ট তারপর এক ঘুম। মাঝখানে খাবার এনে খেয়ে নিলাম। পরদিন খুব ভোরে রওয়ানা দিতে হবে।

ভোর ৫টায় রুম চেক আউট করে বের হয়ে গেলাম বাস স্ট্যান্ডের কাছে, এসে বাসের টিকেট কাটলাম দুই জনের। বাস ছাড়লো সকাল ৬টায়। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে বাস ছুটে চললো আর সাথে চলছে গঙ্গা নদী। ঘণ্টাখানেক চলার পর ড্রাইভার সাহেব নাস্তার ব্রেক দিল। বাস থেকে নেমে পাশের এক হোটেলে খেতে বসলাম, এখানে সহজ নাস্তা হল আলু পরাটা আর চা। নাস্তা সেড়ে বাস আবার চলতে শুরু করল। প্রায় ৩০০ কিলোমিটার রাস্তা, সার দিনের ব্যাপার। শুনেছি ড্রাইভার সাহেব মিনিমাম ৩ বার ব্রেক দিবে।
 
প্রায় ৮০ কিলোমিটার পারি দেওয়ার পর আসলাম এক ঐতিহাসিক জায়গায়, নাম তার দেবপ্রয়াগ। নাস্তার ব্রেক আর এই সুযোগে নেমে গেলাম আর অবাক পলকে তাকিয়ে রইলাম কী অপরূপ দুই স্বর্গীয় নদী ভাগীরথী আর অলকানন্দা মিলে তৈরি হল এক পবিত্র নদী যার নাম গঙ্গা। মানে এটাই সে জায়গা যেখান থেকে অফিসিয়ালি গঙ্গা নদী শুরু হয়েছে। মানে আমাদের পদ্মা। চিন্তা করা যায় এখান থেকে বাংলাদেশ প্রায় ১৮০০ কিলোমিটার। এতো পথ পারি দিয়ে এই গঙ্গা বাংলাদেশে পদ্মা নামে প্রবেশ করেছে। কিছু ছবি আর ভিডিও নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে রইলাম।

বাস আবার ছাড়লো পাহাড়ি ভয়ঙ্কর সব বাঁক দিয়ে আমাদের বাস ছুটে চলল যশিমঠের দিকে। বিকেল ৫টার দিকে গিয়ে পৌঁছালাম যশিমঠ। মাঝখানে আরেক বার আমাদের দুপুরের খাবারের বিরতি ও ছিল। যাই হোক বাস থেকে ক্লান্ত শরীর নিয়ে নামলাম। একটা ভয় ছিল আবার সেই হোটেল নিয়ে। ফরেনারদের হোটেলের ব্যবস্থা আছে কি নাই। এক হোটেলে গেলাম, গিয়ে আগেই বলে নিলাম আমরা ফরেনার হোটেলে থাকার ব্যবস্থা আছে কী? ইনি এক কথাই রাজী হয়ে গেল হ্যা ব্যবস্থা আছে রুম দেখেন। আর দেরি করলাম না ১৫০০ রুপি ভাড়া দিয়ে একটা রুম নিয়ে নিলাম। হোটেলে উঠে ফ্রেশ তারপর খাওয়া-দাওয়া এবং ঘুম।

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম কারণ আজ আমাদের অনেক দূরে যেতে হবে। আজ আমাদের ট্রেকিংও করতে হবে। তাই আর দেরি করলাম না চলে গেলাম যশিমঠ থেকে গোবিন্দঘাট যাওয়ার ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। সেখানে গিয়ে হালকা নাস্তা সেড়ে ট্যাক্সিতে উঠে গেলাম। গাড়ি চলতে লাগলো হিমালয়ের বড় বড় পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে, কী চমৎকার সেই দৃশ্য। আমরা কিছু দূর যাওয়ার পর ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দেখালো এই জায়গার নাম বিষ্ণুপ্রয়াগ। এখানে চীন থেকে বয়ে আসা ধোলি গঙ্গা নদী আর অন্য পাশ থেকে সতোপন্থ হিমবাহ থেকে বয়ে আসা অলকানন্দা মিলেছে এবং এটা প্রথম প্রয়াগ। এইরকম ৫টি প্রয়াগ পাড়ি দিয়ে গঙ্গা নদীর সৃষ্টি। মন ভরে সেই জায়গা উপভোগ করলাম। তারপর আবার আমাদের গাড়ি চলা শুরু করল। প্রায় ঘণ্টাখানেক যাওয়ার পর আমরা পৌঁছালাম গোবিন্দঘাট। এখানে থেকে এই গাড়ি আর যাবে না। আমাদের আরেকটা গাড়ি নিতে হবে সেটি এখান থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে নিয়ে যাবে পুলনা গ্রামে। একদম পাহড়ের উপরে। নিচ থেকে সেই রাস্তা দেখেই রক্ত হিম হয়ে আসছিলো। কিন্তু যেতে তো হবেই।

প্রায় ২০/২৫ মিনিট আঁকাবাঁকা রাস্তা পাড়ি দিয়ে আমরা অবশেষে পৌঁছালাম পুলনা গ্রাম। এখন এখান থেকেই আমাদের ট্রেক শুরু হবে গাংগারিয়া গ্রামের উদ্দেশ্যে। শুরুতে আমরা একজন পোর্টার নিয়ে নিলাম। আমাদের দুই বন্ধুর ব্যাগ দিয়ে দিলাম তার কাছে কারণ এই ভারি ব্যাগ নিয়ে ট্রেক খুব কষ্টসাধ্য। পোর্টারের চার্জ নিল এক হাজার রুপি। একজন পোর্টার মিনিমাম ২০ কেজি বহন করতে পারে, এক্ষেত্রে আমাদের দুই জনের ব্যাগ তেমন ভারি হবে না। খুব বেশি হলে ১৩/১৪ কেজি। যাই হোক অবশেষে পাহাড়ের উপরের দিকে উঠতে শুরু করলাম। প্রায় ১০ কিলোমিটার হাঁটতে হবে। হাঁটতে কষ্ট হলেও আশেপাশের প্রকৃতি দেখে সেই কষ্ট দূর হয়ে যায় নিমিষেই। দূরে পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্ণা বয়ে চলেছে। সবুজ পাইন দেবদারু গাছের সারি। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলছে খরস্রোতা নদী। সেই নদীর উপর ছোট ছোট ব্রিজ পারি দিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি।

দুপুর ২টার দিকে এসে পৌঁছালাম পুলনা গ্রামে। প্রায় ৬ ঘণ্টা লাগে আমাদের এই ১০ কিলোমিটার ট্রেক করে আসতে। অনেকটাই ক্লান্ত হয়ে গেলাম, কিন্তু আমাদের সাথে অনেক আভিযাত্রী ছিল, এখানে একটা ব্যাপার আছে। ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার বাদেও এই জায়গাটা খুব উল্লেখযোগ্য কারণ এখানে একটা ট্যাম্পল আছে যার নাম হেমকুন্দ সাহিব ট্যাম্পল। এই হেমকুন্দ সাহিব ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারের পাশে প্রায় ১৪ হাজার ফিট উপরে পাহাড়ের চূড়াতে। এখানে প্রচুর শিখ ধর্মের মানুষ আসে। এই জায়গাটা বিখ্যাত এই জন্য কারণ এই ট্যাম্পল পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত শিখ ট্যাম্পল। আমাদের প্ল্যান ছিল এখানেও যাওয়ার কিন্তু পরে সময়ের স্বল্পতার জন্য যাইনি। শুধু ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার দেখে চলে আসি। যাই হোক অবশেষে পুলনা গ্রামে পৌঁছে এক হোটেল ঠিক করি, অবশ্য এখানেও হোটেল পেতে কোনো সমস্যা হয়নি। আমরা দুই রাত এই হোটেলে ছিলাম, বেশ ভালো হোটেল। আশেপাশে পাইন দেবদারু গাছ আর বরফের পাহাড়।

পরদিন সকালে ১৭ জুলাই আমরা নাস্তা সেড়ে বের হলাম ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার যাওয়ার উদ্দেশ্যে। প্রায় ৪ কিলোমিটার ট্রেক। কিছুদুর যাওয়ার পর এলো চেক পোস্ট। সেখান থেকে পার্মিট নিলাম প্রতিজন চার্জ ৬০০ রুপি ফরেনারদের জন্য, আর ভারতীয়দের জন্য ১৫০ রুপি। পার্মিট নিয়ে সামনে চলা শুরু করলাম। যত সামনে যাচ্ছি তত মনে হচ্ছে প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছি। পুষ্পাবতী নদী পাহাড়ের বুক চিরে জোর শক্তি নিয়ে বয়ে চলছে। সে কি শক্তি পানির। সামনে যাওয়া যাচ্ছে না, পাথরের বুকে পানি আছড়ে পরে কুয়াশার সৃষ্টি হচ্ছে।

আমরা সেই পথ পাড়ি দিয়ে সামনে চলতে শুরু করলাম। সামনে আসল এক বড় পাহাড়। এই পাহাড় পারি দিলেই ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার। কিন্তু এই পাহাড় আর শেষ হয় না, উঠতে উঠতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এই পাহাড়ের রাস্তা আর শেষ হয় না। প্রায় ২ ঘণ্টা লাগল পাহাড়টা পারি দিতে। যেই পাহাড় পারি দিয়ে সামনে গেলাম চোখের সামনে ফুটে উঠলো এক নয়নাভিরাম ভ্যালি। কি যে সুন্দর লাগছিল দেখতে। কিন্তু এটা তো মূল ভ্যালি নয়। সেখানে তো অনেক ফুল ফুটে থাকবে। আমরা চলতে শুরু করলাম ভ্যালি ধরে আর অপেক্ষা কখন আসবে সেই ফুলের ভ্যালি।

আরো প্রায় আধাঘণ্টা চলার পর চোখের সামনে ফুটে উঠলো সেই ভ্যালি। এক স্বর্গীয় বাগান। এই নিরবতা এই প্রকৃতির সুর এই কলতানি এসব তো কিছু একমাত্র স্বর্গীয় বাগানেই মিলবে। প্রায় ২ ঘণ্টার মতো ছিলাম সেই ফুলের ভ্যালিতে। খুব করে উপভোগ করলাম ভ্যালিকে। এর সৌন্দর্য আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। হৃদয়ে অনেক স্মৃতি নিয়ে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার দেখে বিকেলে ফিরে আসলাম পুলনা গ্রামে। আসলে ভ্যালিতে রাতে থাকার অনুমতি নেই। সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এই ভ্যালি খোলা থাকে। এছাড়া অন্য সময় থাকা যায় না। 

ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার ফিরে আসলাম গাঙ্গগারিয়া গ্রামে। এসে বিকেলে খাবার খেয়ে রেস্ট। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুম। সকালে উঠে আবার আমাদের পাহাড়ের নিচে নামতে হবে যেতে হবে পুলনা গ্রাম হয়ে গোবিন্দঘাট। সেখান থেকে আবার ট্যাক্সি নিয়ে যোশিমঠ হোটেলে যেতে হবে। তাই তাড়াহুরো করে সকালে বের হলাম বেলা ১০টার দিকে পৌঁছে গেলাম পুলনা গ্রামে। সেখান থেকে গেলাম গোবিন্দঘাট। তারপর সেখানে কিছু খাবার খেয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম যোশিমঠের উদ্দেশ্যে। অবশেষে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর গাড়ি ছাড়লো। গাড়িটা যখন গোবিন্দঘাট থেকে মেইন রোডে উঠে সামনের দিকে যোশিমঠের দিকে যেতে লাগলো, আমি হুট করে একটু পিছনে ফিরলাম। এমন এক দৃশ্য দেখলাম আমি আবেগাপ্লুত। পিছনে বাদরিনাথের রাস্তায় হিমালয়ের এক সাদা শৃঙ্গ যেন আকাশ ছুয়ে আছে। সে এক অপরূপ দৃশ্য।

ঘণ্টাখানেক পর এসে পৌঁছালাম যোশিমঠ। প্ল্যান ছিল পরদিন চলে যাব কিন্তু সাথের বন্ধু বলছে এখানে যখন এসেছি তাহলে অলি গ্রামটা দেখে যাই, পাহাড়ের একদম উপরে এই গ্রাম। শুনেছি এখান থেকে নাকি নন্দা দেবি পাহাড় দেখা যায়। নন্দা দেবি ভারতের একমাত্র সবচেয়ে উচু পর্বত। অলি খুব সুন্দর কিন্তু সেটা শীতের সময়। শীতে এখানে প্রচুর স্নো-ফল হয়। তখন এখানে অনেক শীতের স্পোর্টস হয়। অলি বিখ্যাত স্নো-স্কেটিং এর জন্য। কিন্তু এই বর্ষা মৌসুমে কী ভালো লাগবে ? সেটা নিয়ে একটু দ্বিধায় ছিলাম। পরে ভাবলাম যেহেতু এখানে আছি তাহলে দেখে আসা যায়। খুব দূরে কেবল কারে গেলে প্রায় ৫ কিলোমিটার। আমরা তারপর গেলাম ক্যাবল কার স্টেশনে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ প্রায় ১ ঘণ্টা বসে রইলাম কিন্তু ক্যাবল কার আর ছাড়ছে না। কারণ মিনিমাম ৮ জন লোক হলেই ছাড়বে তা না হলে নয়। আমরা অনেক সময় বসে রইলাম কেউ আর আসলো না। এর কারণ এখন অফ সিজন অলিতে কেউ যায় না। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর ভাবছি কী করি, তখন টাক্সি বুক করলাম আমাদের নিয়ে যাবে সেখানে ঘণ্টা দুইয়েক থাকবে তারপর গাড়ি আমাদের নিয়ে আসবে। গিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলে আবার গাড়ি পাওয়া যায় না। তাই গাড়ি বুক করে নিলাম। আমরা গিয়ে অবশেষে অলি পৌঁছালাম বিকেলে। যাওয়ার পথে প্রচুর আপেল গাছ দেখতে পেলাম। আবারো আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে গাড়ি মনে হচ্ছে আকাশে উঠে যাচ্ছে। এতো উপরে সেই অলি। অলি জায়গাটা দেখে কাশ্মীরের গুলমার্গের কথা মনে পরল। অনেকটাই এমন। অলি খুব সুন্দর। আমরা গিয়ে পাহাড়ের বুকে শুয়ে উপভোগ করছি আর দেখছি অলিকে। হঠাৎ সামনে আসলো পুরো হিমালয়ে রেঞ্জকে উকি দিয়ে বের হয়ে আসছে নন্দাদেবী পর্বত। সে এক অসাধারণ দৃশ্য।

অলিকে মন ভরে দেখে সেখান থেকে আবার নিচে নেমে আসতে থাকলাম। রেখে আসলাম কিছু স্মৃতি। আফসোস রয়ে গেল আর কিছুদিন এখানে যদি থাকতে পারতাম। তাহলে হয়তো কিছুটা মন শান্ত হতো। কিন্তু কী আর করার ফিরে যেতে হবে আবার বহু দূর। অলি থেকে নিচে নামার সময় দেখতে পেলাম সেখানে প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই আপেল গাছের বাগান, সে কী চমৎকার দেখতে এতো সুন্দর পরিবেশ আবার পাহাড়ের গায়ে গায়ে আপেল গাছের বাগান। আমরা গাড়ি থামিয়ে একটা বাগানের সামনে থামলাম। কিছু আপেল খেলাম আর ক্যামেরায় বন্দি করে নিলাম সেসব দৃশ্য। গাছ-দৃশ্য এসব আর তো আর নিতে পারবো নাম ছবিতেই সব নিয়ে যাই।

অবশেষে এসে পৌঁছালাম যোশিমঠ। হোটেলে রেস্ট নিলাম, পরদিন খুব সকালে হোটেলের নিচেই বাস পেলাম ঋষিকেষ যাওয়ার। বাসে উঠে গেলাম। প্রায় ১০ ঘণ্টার জার্নি শেষে আবারো এসে পৌঁছালাম ঋষিকেষ। এবার প্ল্যান করলাম আমাদের যেহেতু ঋষিকেষ কোনো কাজ নেই তাহলে আমরা দিল্লি চলে যাই। রেল স্টেশন খুঁজে বের করি। অবশেষে স্টেশন খুঁজে পেলাম। ঋষিকেষ থেকে খুব বেশি দূরে না। একটা অটো ভাড়া করে সেখানে গেলাম। দুই বন্ধুর ভাড়া আসলো ১০০ রুপি। রেল স্টেশনে ঢুকে অবাক হলাম এতো সুন্দর সাজানা গুছানো স্টেশন। আসলে স্টেশন নতুন হয়েছে তাই এতো সুন্দর। আমরা গিয়ে টিকেট কাউন্টার খুঁজে বের করে দিল্লির টিকেট কাটলাম-বিকেল ৫টায় ট্রেন। এখন ৪টা বাজে। দেখতে দেখতে সময় চলে গেল। ট্রেন ছাড়লো যথাসময়ে, রাত ১২টার দিকে দিল্লি রেল স্টেশনে এসে পৌঁছালাম। তারপর দিল্লিতে দুই একদিন থেকে সরাসরি ঢাকায় ফ্লাইটে মাত্র আড়াই ঘণ্টায় বাসায় ফিরে আসলাম। আর সাথে নিয়ে আসলাম অসংখ্য স্মৃতি।

লেখক : ট্রাভেলার ও ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট।

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন

সর্বশেষ খবর