৯ অক্টোবর, ২০২৩ ১৮:৫২

ন-কাটা ও মুপ্পোছড়া ঝর্ণা

সাদিকুল নিয়োগী পন্নী

ন-কাটা ও মুপ্পোছড়া ঝর্ণা

মুপ্পোছড়া ঝর্ণা

এক.

ভ্রমণপ্রিয় ছোট ভাই ইমরানকে বলেছিলাম আমাকে ঝর্ণার পানি দিতে। দুষ্টুমি করে এ কথা বললেও সে ঠিকই দুইটা ঝর্ণা থেকে পানি সংগ্রহ করে প্লাস্টিকের বোতলে ঝর্ণার নাম লিখে উপহার হিসেবে দিয়েছে। পানির বোতল দুটি বুক সেলফে ওপরে এমনভাবে রেখে দিয়েছি কেউ দেখলেই প্রশ্ন করে, তুমি পানি পড়াতে বিশ্বাস কর নাকি?

আমি মুচকি হাসি দিয়ে বোতল নামিয়ে ঝর্ণার নাম দেখিয়ে বলি, ঝর্ণার পানি সংগ্রহের কাজ শুরু করেছি। সুযোগ পেলে একটা প্রদশর্নী করব।

অন্যের দেওয়া পানিতে ভরসা পাচ্ছিলাম না। নতুন পানি সংগ্রহ করতে হলে নিজেকেই মাঠে নামতে হবে। মনে মনে খুঁজছিলাম কারও সঙ্গে যাওয়া যায় কি না।

হঠাৎ ফেসবুকের একটা গ্রুপে দেখি তারা রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার ন-কাটা, মুপ্পোছাড়া ও ধুপমানি ঝর্ণার ট্রিপের আয়োজন করেছে।  আগস্টের ৩ তারিখ বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা থেকে দলটি রওনা দিবে। আমি অফিস শেষে বাসায় এসে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। বাস ছাড়বে রাত ১০ টায় ধানমন্ডি থেকে। রাতের খাবার শেষ করে বাসা থেকে তিন রাতের ছুটি নিয়ে বের হলাম ঝর্ণার উদ্দেশ্যে।

ধানমন্ডি থেকে যাত্রা শুরু। গ্রুপের এডমিন জানালেন তাদের গ্রুপ থেকে মোট ৫ জন যাচ্ছি। কাপ্তাই যাওয়ার পর অন্যগ্রুপের সাথে আমরা যুক্ত হব। গ্রুপে পূর্ব পরিচিত এক আপু ও তার স্বামী তপন ভাই আছেন। তারা টিকাটুলি এলাকা আমাদের সাথে যুক্ত হলেন। কুমিল্লায় যাত্রা বিরতির পর বাস ছুটে চলছে কাপ্তাইয়ের উদ্দেশ্যে। চট্টগ্রাম পৌঁছার আগে থেকে বৃষ্টি শুরু হল। ভোরে বাস আটকা পড়ল চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। ঝড়ে রাস্তায় গাছ ভেঙে পড়ায় যান চলাচল বন্ধ। ফায়ারসার্ভিস কর্মীরা গাছ সরালে আবার যাত্রা শুরু। কাপ্তাই গিয়ে আমরা বিভিন্ন গ্রুপের সাথে যুক্ত হওয়ার পর লোকজনের সংখ্যা দাড়ালো ৫০ জনে। অন্য গ্রুপের পূর্বের পরিচিত একজনকে পেয়ে গেলাম। সকালের নাস্তার আয়োজন করা হল কাপ্তাই লেকের ঘাটে। ডিম খিচুরী খাওয়ার সময় পরিচয় হল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোটভাই মোজাম্মেলের সাথে। সে দেড় প্লেট খিচুড়ী খেয়ে বলল, ভাই সব টাকা উশুল করে যেতে হবে।

দুইটি নৌকায় চড়ে বিশাল বহর বিলাইড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল বারোটার দিকে। ঝিরঝির বৃষ্টিতে মোবাইলকে একটা প্রটেক্টরের ভিতরে ঢুকিয়ে চলে গেলাম নৌকার ছাদে। অন্য নৌকার পর্যটকদের প্রস্তুতি ছিল বেশ ভালো। তারা বাদ্যযন্ত্রসহ নৌকায় উঠেছে। ওই নৌকার গান শুনে আমরাও সাথে তাল মেলানোর চেষ্টা করছি। বৃষ্টির কারণে লেকের পানিতে স্রোতের তীব্রতা বেড়েছে। দুই পাশে সবুজ পাহাড়, মাঝে মধ্যে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের ছোট ছোট পাড়ার সৌন্দর্য ছিল নজর কাড়ার মত। প্রায় আড়াই ঘণ্টার জলপথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছালাম বিলাইছড়ি উপজেলার সদর বাজারে। আমাদের জন্য বরাদ্ধকৃত রুমে ব্যাগ রেখে চলে এলাম হোটলে খাবার খেতে। খাবার শেষ করতে প্রায় ৪টা বেজে গেলে। এখান থেকে ট্রেকিং করে যেতে হবে ন-কাটা ও মুপ্পোছড়ি ঝর্ণায়। সময় স্বল্পতার জন্য স্থানীয়রা মানা করছিলেন।

পঞ্চাশ জনের পঞ্চাশ কথা। শেষে সবাই দল বেধে হাঁটা শুরু করলো ঝর্ণা দেখার উদ্দেশ্যে। প্রটেক্টরের মধ্যে মোবাইল ও প্রয়োজনীয় টাকা ছাড়া সাথে আর কিছু নেই। শুরুতে ইটের রাস্তা। কিছুদূর পর মাটির খাড়া ঢাল। বৃষ্টিতে কাঁদায় মাখামাখি হয়ে পিচ্ছিল হয়ে আছে পথ। সবাই বাঁশের লাঠি পেলেও আমার ভাগ্যে ঝুটল বাঁশের টুকরো। কাঁচা বাশের খুটির ওজন কাঁদায় যুক্ত হয়ে কয়েকগুণ ভারী হয়ে গেল। পা টিপে টিপে হাঁটছি। বাঁশের সাকু ও ঝিরিপথ পার হয়ে চলা এ পথ মোটেও সুগম ছিল না। টানা বৃষ্টিতে ফ্লাশ ফ্লাড হয়েছে। কয়েকটা ঝিরিতে পানির স্রোতের  তীব্রতার এতো বেশি ছিল যে, হিউমেন চেইন করে পার হতেও কষ্ট হচ্ছিল। ঘড়ির কাটা যখন প্রায় ৬টার ঘরে তখন পৌঁছালাম এন্ট্রি পয়েন্টে। এখানে তথ্য দিয়ে গাইড নিয়ে যেতে হবে ঝর্ণায়। সময় স্বল্পতার জন্য অনুমতি দিতে চাচ্ছিলেন না দায়িত্বরতা। অবশেষে আমাদের অনুরোধে শর্ত সাপেক্ষ অনুমতি দিলেন। সাথে দিলেন দুইজন গাইড।

বেশি লোকজন হওয়ায় যে যার মত ছুটে চলছে। গ্রুপে চললে সব দেখতে পারবে না এ কথা বলে মোজ্জামেল শুরুতেই দলছুট হয়ে গেল। প্রায় পনের বিশ মিনিট পথ ট্রেকিং করার পর ঝর্ণার পানি পতনের শব্দ শুনতে পেলাম। একজন বললেন, এটাই ন-কাটা ঝর্ণা। মূল ঝর্ণায় যেতে হলে কিছুটা পথ নিচে নামতে হবে। কিন্তু আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল আগে মুপ্পোছড়া ঝর্ণা দেখবো। তাই এখানে সময়ক্ষেপন না করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। ন-কাটা ঝর্ণার পানি প্রবাহের উপরের দিকের পথ পারি দিয়ে যেতে হবে মুপ্পোছড়ার দিকে। দিনের আলো প্রায় শেষ। গাইড বললেন দ্রুত গেলে চোখের দেখা হয়ত দেখা যাবে। আমাদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি দেখা দিল। শেষে দশ পনের জন রাজি হলো প্রবল স্রোতে  ঝিরিপথ পারি দিতে। বাকিরা ন-কাটার পাশেই অবস্থান নিলেন।

মুপ্পোছড়ার দেখতে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবার আগ্রহ সৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে মোজাম্মেল। সে আগেই ন-কাটা ঝর্ণা দেখে অপেক্ষরত অবস্থায় ছিল।

আলো-আধারীতে পাথরের ওপর দিয়ে প্রবাহমান পানির স্রোতকে ভয়ংকর মনে হচ্ছিল। কিছুদূর ছয় সাতজন ছাড়া কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। মোজাম্মেল গাইডসহ বাকিদের নিয়ে অনেক আগেই উধাও হয়ে গেল। অন্ধকার হয়ে আসছে। কিছুসময় হাঁটার পর আটকে গেলাম ওয়াই জংশনে। আমাদের সাথে থাকা এডমিন নিজেও বুঝতে পারছেন না তিনি কোনদিকে যাবেন। এডমিনের সিন্ধান্ত অনুযায়ী ঝিরিপথ বাদ দিয়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে ওপরে উঠলাম। সবার চোখে-মুখে আতংক। কোন পথ না পেয়ে আমরা ফিরে আসার সিন্ধান্ত নিলাম। পিচ্ছিল কাঁদা মাটি পারি দিয়ে নিচে নামতে শরীর ঘাম দিয়ে দিল। কিছুদূর আসার পর মারমা জনগোষ্ঠীর এক নারীর সাথে দেখা হল। আগ্রহ নিয়ে তাকে মুপ্পোছড়া ঝর্ণার কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি দেখিয়ে বললেন, এখান থেকে তোমাদের কমপক্ষে পনের বিশ মিনিট হাঁটতে হবে। এখন না যাওয়াই ভালো।

আমরা আর ওই পথে পা বাড়াইনি। আতংক, ক্ষোভ ও পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে যখন ফিরে এলাম ন-কাটা ঝর্ণার প্রবেশ মুখে তখন প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে। প্রথম দেখা হল মোজাম্মেলের সাথে। আমাকে দেখেই মোজাম্মেল বলল, ভাই আপনাদের হারিয়ে ফেলেছিলাম।

আমি বললাম, তোমাকে অনেক ডাকাডাকি করেছি। কোন সাড়া পাইনি।

ভাই পানির শব্দে কিছু শোনা যায়নি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা ঝর্ণা দেখেছ।
অন্ধকারের মধ্যে মোজাম্মেলের দাঁতের ঝলক দেখতে পেলাম।
সে বলল, ভাই অনেক সুন্দর। আপনারা মিস করলেন। 
আমার মেজাজ বিগড়ে গেল।
বললাম, তুমি গাইড নিয়ে না গেলে আমরাও দেখতে পেতাম।
সে নানা চলচাতুরি করে আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। এদিকে সন্ধ্যায় হওয়ায় বিভিন্ন গ্রুপের এডমিনরা তাড়া দিচ্ছিলেন ফেরার জন্য।
সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় আমরা ন-কাটা ঝর্ণাও দেখতে পারিনি। বলতে গেলে একটা ব্যর্থ অভিযান। 

প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছি। চেক পয়েন্ট পর্যন্ত গাইড এগিয়ে দিলেন। তারপরের প্রায় দুই আড়াই ঘন্টার পথ আমাদের নিজেদের আসতে হবে। ৫০ জনের দলের মধ্যে চার পাঁচ জন এডমিন বিভিন্নভাবে বিভক্ত হয়ে আমাদের চলার পথে সাহয্য করছেন। যাদের মোবাইলে চার্জ ছিল তারাও সহযোগিতা করছেন আলো ছড়িয়ে। আমার ফোনের চার্জ শেষের দিকে। মোবাইলের স্ক্রিন লাইট অন করে গলায় ঝুলিয়ে হাঁটছি। দলবদ্ধ আমাদের এ পথচলা দূর থেকে দেখতে মনে হবে রাতের আঁধারে একদল ঝোনাকি পোকা নতুন পথের সন্ধানে যাত্রা করছে।

ফেরার পথে বৃষ্টি আরও বেড়েছে। কর্দমাক্ত পথে হাঁটতে গিয়ে একটু পরপর কেউ না কেউ হোঁচট খাচ্ছে। একে অপরকে টেনে তুলছে। এভাবে এক দেড় ঘণ্টা পথ চলার পর পাড়ার কাছে এলাম। বিকালে যে ঝিরি পথে কোমড় সমান পানি ছিল সেখানে এখন সাঁতার পানি। পানির ¯্রােতও কয়েকগুন বেশি। ঝিরির এ পাশে দুইটা দোকান আছে। নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন খাবারের পাশাপাশি চায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। আমি একটা দোকানে জমিয়ে রাখা পানি দিয়ে পা ধুয়ে পরিষ্কার করলাম। এডমিনরা একসাথে আলোচনা করছেন কীভাবে পার করাবেন আমাদের। স্থানীরা শেরপার মত আমাদের ঝিরিপথ পার করতে রাজি হলেন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দুই যুবক আমাদের নির্দেশ দিলেন পরিধানের জামা কাপড় ছাড়া সবকিছু তাদের কাছে দিয়ে দিতে। আমাদের কাছে যা ছিল তা দিয়ে দিলাম। এগুলো দুই তিন ধাপে তারা পার করলেন। এবার মানুষ পারাপারের পালা। ঝিরিতে তিন চারজন নামলেন। স্রোত বেশি হওয়ায় একজন একজন করে পার করবেন বলে সিন্ধান্ত নিলেন তারা। আমাদের যেকোন একজনকে এগিয়ে যেতে বলা হল। সবাই একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না দেখে আমি সবার আগে গেলাম।

আমি সাঁতার জানি বলার পরও উনি বললেন, এমন স্রোতে সাঁতার জানা আর না জানার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আপনি আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখবেন।

খালের মতো ঝিরির মাঝে যাওয়ার পর মনে হল স্রোতে আমার ট্রাউজার ও টি শার্ট খুলে চলে যাবে। অবশেষে বস্ত্রসহ ওই পারে গিয়ে পৌছে খুশিতে চিৎকার দিলাম। এভাবে একে একে সবাইকে পার করতে তাদের আধ ঘণ্টা চেয়ে বেশি সময় লেগে গেল।

আরও ঘণ্টাখানেক পথ বাকি। সামনে এত বড় ঝিরি নেই এটাই স্বস্তির বিষয়। সবার যাত্রা শুরু। হাঁটার একপর্যায়ে মনে হল আমার ডান কানের নিচে চুলকাচ্ছে। হাত দেওয়ার পর বুঝতে পারলাম জোঁক। একজনকে বললাম মোবাইলের লাইট ধরতে। এমনভাবে জোঁক বসেছে যে হাতের নখের খামচিতেও সহজে উঠছিল না। কয়েক দফা চেষ্টার পর তা ছাড়াতে সক্ষম হলাম। মনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মনে হল আরও কোথাও জোঁক আছে। মোবাইলের লাইট দিয়ে দেখি হাঁটুর ওপরেও একটা রক্ত খাচ্ছে। শরীর জোঁক মুক্ত করার পর হাত রক্তাক্ত মনে হল। বৃষ্টির পানিতে হাত পরিষ্কার করে আবার হাঁটা শুরু করলাম। গন্তব্য থেকে প্রায় আধ ঘণ্টা পথ বাকি। এখন পুরো রাস্তাই খাড়া। সবচেয়ে ভয়ানক হল ইট বিছানোর আগের রাস্তাটুক। প্রায় ৭০ ডিগ্রি খাড়া এ পথটুকু বৃষ্টির পানিতে সাবানের মত পিচ্ছিল হয়ে গেছে। উপরের দিকে আমরা উঠছি বাঁশের লাঠিতে ভর দিয়ে। তবুও পা বারবার পিছলে যাচ্ছে। কিছু পথ হাঁটার পর কাঁদায় আটকে আমার ডান পায়ের জুতার এক অংশ ছিড়ে গেল। নতুন বিপর্যয় মাথায় নিয়ে খোড়া মানুষের মত এ পথটুকু পারি দিতে বৃষ্টির মধ্যেও শরীর ঘাম দিয়ে দিল। ইটের রাস্তায় যাওয়ার পর একটু স্বস্তি পাওয়া গেল। বিলাইছড়ি বাজারের পৌছাতে রাত দশটার মত বাজল। আমি ফ্রেশ হয়ে যখন খেতে এলাম নির্ধারিত রেস্টুরেন্টে, তখন দেখি মোজাম্মেল বসা। সে আমকে দেখেই বলল, ভাই আগে এসছিলাম বলে খেয়ে নিয়েছি। আপনি খেয়ে নেন। আমি শুতে গেলাম।

আমি ও তপন ভাই খেয়ে দেয়ে গিয়ে মোজাম্মেলের সাথে একরুমে শুলাম। এডমিনদের একজন জানিয়ে গেলেন আগামীকাল ভোর পাঁচটার মধ্যে উঠতে হবে। ছয়টার মধ্যে ধূপপানী ঝর্ণার উদ্দেশ্যে তারা রওনা দিবেন।

দুই.
দ্বিতীয় দিন মোবইলের এলার্মে ঘুম ভাঙল। তপন ভাই ও মোজাম্মেলকে ডেকে দিলাম। দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে রেস্টেুরেন্টের সামনে দাঁড়ালাম। সবাই আসতে আসতে প্রায় ৬টা বেঝে গেল। এডমিনরা সিদ্ধান্ত নিলেন খাবার সাথে নিয়ে ট্রলারে উঠবেন। নৌকায় উঠার পর পরই আমাদের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিলেন এডমিনদের একজন। তখনও টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। ইঞ্জিন চালিত নৌকা চলছে কাপ্তাই লেকের স্রোতের বিপরীতে। কিছুদূর পর সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট। নৌকার চালক জানালেন সকালের নৌকার যাত্রীদের যেতে দেওয়া হয়নি স্রোতের  জন্য। আমাদের এডমিনদের একজন জাতীয় পরিচয়পত্র একসাথে করে ক্যাম্পে গেলেন। ফিরে এলেন ঘুমড়া মুখে। একজন সেনা সদস্য এগিয়ে এসে আমাদের জানালেন স্রোতের জন্য নিষেধাজ্ঞা। মন খারাপ হয়ে গেল। পুরা ট্রিপটাই ব্যর্থ। কিছুই দেখা হল না। নৌকা ঘুরানো হল বিলাইছড়ি বাজারের দিকে। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এলো। গতকাল যেহেতু ন-কাটা ও মুপ্পোছড়া ঝর্ণা দেখা হয়নি আজ দেখতে যাবো। আমাদের গ্রুপের এডমিনসহ অন্যগ্রুপের একজন এডমিন রাজী হলে। আরও অনেকে আগ্রহ দেখালেন। সিন্ধান্ত হল নেমেই রওনা দিব।

ট্রলারের বসে সবাই নাস্তা সেরে নিল। সবাই আবার জড়ো হলাই বিলাইছড়ি বাজারের প্রবেশপথে। আবার দ্বিমত দেখা দিল। আমরা কয়েকজন ছাড়া বাকিরা যেতে চাইলেন গাছকাটা ঝর্ণা দেখতে। অন্যগ্রুপের যে এডমিন আমাদেরকে মধুর কথা শোনাচ্ছিলেন তিনিও ঘুরে গেলেন ৯০ ডিগ্রি এঙ্গেলে। আমি অনড় ছিলাম সিন্ধান্তে। ন-কাটা-মুপ্পোছড়া না দেখে ফিরব না। অতি হিসাবী ছোটভাই মোজাম্মেল আমাদের গ্রুপ থেকে চলে যাওয়া এডমিনসহ আমরা মাত্র চারজন রওনা দিলাম ন-কাটা ঝর্ণার উদ্দেশ্যে। সাথে বিলাইছড়ি বাজার থেকে গাইড হিসেবে যুক্ত হলেন রাহাত নামের সতের আঠার বছর বয়সী এক কিশোর। দল ছোট হওয়ায় আজ তেমন ঝামলো নেই। ছেড়া জুতা বাদ দিয়ে আগেই বিলাইছড়ি বাজার থেকে পরে নিয়েছি এংলেট। দ্বিতীয়বার হওয়ায় পথ পারি দিতে তেমন কষ্ট হচ্ছে না। চেকপয়েন্ট পৌছানোর পর রাহাত বলল, এখান থেকে গাইড যাবে। তার আর যাওয়ার অনুমতি নেই।

আমাদের অনুরোধে রাহাতকেও সাথে দেওয়া হল। চাকমা জনগোষ্ঠীর গাইড চলছেন সবার সামনে। আমরা তৃষ্ণার্ত মনে এগিয়ে চলছি। বৃষ্টির পরিমান বেশি হওয়ায় মোবাইল বের করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রটেক্টরের মধ্য থেকেই যতটুকু আসছে তাই তোলা হচ্ছে। ঝিরিপথে ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছি। ন-কাটা ঝরণার প্রবেশপথ পানিকে সাদা দুধের মত ধবধবে মনে হচ্ছে। বেশ কয়েকটা ছোট ছোট ঝরণা পার হলাম। পথে একটা ঝরণাকে মুপ্পোছড়া মনে করে নেমে ফটোসেশন শুরু করে দিয়েছিলাম। তখন গাইড ও রাহত জানালেন আরও সামনে এগুতে হবে। দীর্ঘ দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার পর পৌছলাম মুপ্পোছড়া ঝর্ণার কাছে। দূর থেকে ঝর্ণা দেখে মন জুড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছে নায়াগ্রা জলপ্রপাত। বৃষ্টির পানিতে ঝর্ণা জেগে উঠেছে। অনেক ওপর থেকে পাথরের গা ঘেষে তরঙ্গের মতো বিশাল পরিধি নিয়ে ঝর্ণার পানি পতিত হচ্ছে। জলীয় বাষ্পের মতো ঝর্ণার পানি ছড়িয়ে পরেছে চারদিকে। পুরো এলাকায় শীতল আবহওয়া বিরাজ করছে। পানি পতনের ছন্দময় শব্দ বিমোহিত করছে চারপাশকে। মুপ্পোছড়ার এ সৌন্দর্য নিজ চোখে না দেখলে বর্ণনায় বোঝানো সম্ভব নয়। আমাদের আগে সেখানে অবস্থান করছিল দশ বারো জনের একটি দল। তাদের ফটোসেশন শেষ হলে আমরা এগিয়ে গেলাম। স্ত্রীর মন রক্ষায় পুরুষজাতি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন তার প্রমাণ দিলেন স্বপন ভাই। তিনি তার কাঁধের ব্যাগের পলিথিনের ভেতর থেকে বের করলেন লাল টুকটুকে শাড়ি।

আমি বললাম, ভাই কেমনে পারলেন? আমি তো এতোক্ষণ ভাবলাম ড্রাইফুড বহন করছেন।

ভাই বললেন, বউয়ের ইচ্ছে পূরণ না করলে সকল ফুড বন্ধ হয়ে যাবে। আমি আপনার আপুকে শাড়ি পরাতে গেলাম। আপনি এ নিয়ে ঠাট্টা না করে আমাকে সহযোগিতা করেন।  
আমারও বাসায় যেকোন সময় বিপদ হতে পারে। এই ভেবে চুপ হয়ে গেলেম।
আপু ভাইয়ের সহযোগিতায় পূর্বের পোশাকের ওপর শাড়ি পরে নিলেন। সবুজ পাহাড়, ঝর্ণার স্বচ্ছ পানির পাশে তিনি দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল খুলে দিলেন।  সত্যি বলতে এ দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল নারী ছাড়া প্রকৃতি, এমনকি পৃথিবীই অসুন্দর। আপুর ফটোসেশন চলল দশ পনের মিনিট।

তারপর আমার এবং তপন ভাইয়ের পালা। ঝর্ণার পাশে দাঁড়ানোর পর ওপরের জলারশিতে আবৃত হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছে ঝর্ণা তার আঁচল দিয়ে ঢেকে নিয়েছে। প্রকৃতির পাগল করা এ সৌন্দর্যে দিশেহারা হয়ে গেলাম। দুইহাত ছড়িয়ে চিৎকার করে নিজেকে সপে দিলাম প্রকৃতির বুকে। ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছিল না মুপ্পোছড়া থেকে। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় অবস্থান করে রওনা দিলাম ন-কাটা ঝর্ণার উদ্দেশ্যে। দেহ মনে প্রশান্তি বিরাজ করছে। প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা পৌছে গেলাম ন-কাটা ঝর্ণার কাছে। দুর্গম ঝিরি ও পাহাড়ি পথ হলেও ফেরার সময় তা টের পাইনি। মূল পথ থেকে অনেকটা খাড়া পথ বেয়ে নামতে হল ন-কাটায়।

মুপ্পোছড়ায় দেখা হওয়া গ্রুপের লোকজন এখানে অবস্থান করছিল। তাদের ফটোসেশন শেষ হলে আমরা এগিয়ে গেলাম। মুপ্পোছড়ার মত এ ঝর্ণার জলরাশি এতো উচু থেকে পতিত না হলেও এটিও বেশ উপভোগ্য। আর ঝর্ণাটির খুব কাছ থেকে জলের পতন উপভোগ করা যায়। ন-কাটা ঝর্ণার সৌন্দর্য উপভোগ করে আমাদের ফেরার পালা।

গতদিনের মত পূর্ব পরিচিত পথে আবার ফিরে এলাম বিলাইছড়ি বাজারে। বেলা তখন প্রায় সাড়ে তিনটা। ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে রেস্টুরেন্টে এসে খবর নিলাম মোজাম্মেল ফিরেনি। রাতের বাসে আমাদের ফিরতে হবে। পরদিন তিনজনেরই অফিস। এডমিনকে বললাম, সবাই না আসলেও আমরা নিজ ব্যবস্থাপনায় ফিরে যাব। খাবার খেয়ে অপেক্ষা করছি অন্যদের জন্য। ওই গ্রুপের সমন্বয়ক জানালেন তাদেরর ফিরতে সাড়ে পাঁচটার মত বেঝে যাবে। নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে বিলাইছড়ি বাজার থেকে সন্ধ্যায় নৌকা বা ট্রলার চলাচলে নিষেজ্ঞাধা রয়েছে। ওই গ্রুপের ফেরার কোনো লক্ষণ না দেখে আমরা একটা এডমিনকে জানালাম, নিজেদের ব্যবস্থাপনায় কাপ্তাই যাব। যেকোনভাবেই পরদিন ঢাকায় ফিরতে হবে।

রেস্টুরেন্টের মালিক নিজাম ভাই আমাদের জন্য রিজার্ভ নৌকার ব্যবস্থা করে দিলেন। ছাদহীন নৌকায় পলিথিনে ব্যাগ মুড়িয়ে বসে আছি। আরেকটা পলিথিন দিয়ে কোনোক্রমে মাথা রক্ষার চেষ্টা চলছে। তরুণ চালক অন্ধকারের মধ্যে লাইটের আলোতে নৌকা চালিয়ে যাচ্ছেন। চারদিকে শুনশান নীরবতা। মনে ভয় ও আতংক বিরাজ করছে। মোজাম্মেলের জন্য অপেক্ষা না করলে এ বিপদ হতো না। কিছুদূর যাওয়ার পর চেকপোস্ট। চালক ইঞ্জিন বন্ধ করলেন। নৌকা ঘাটে গিয়ে থামল। পাশেই আটকা আছে আমাদের পূর্বের গ্রুপ। রাত বেশি হওয়ায় তাদেরকে কাপ্তাই ফিরে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাদের ব্যাগ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অন্য একটি নৌকায় করে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন নিজাম ভাই। 

বৃষ্টির মধ্যে মাথা গুজে বসে আছি। চেকপোস্ট থেকে কাপ্তাই যাওয়ার অনুমতি পাওয়ার পর নৌকার ইঞ্জিন চালু করলেন চালক। চারদিকে নীরবতা থাকায় কেমন জানি আতংক লাগছে। একটা জায়গা এসে কুচুরিপানার দলের মধ্যে নৌকা আটকে গেল। নৌকা কোনক্রমেই এগুচ্ছে না। আমি নৌকার সামনের দিকের কুচুরিপানা সরাচ্ছি। চালক নেমে পরিষ্কার করলেন কিছুটা পথ। তপন ভাই লগি দিয়ে ঠেলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। চালক নিরুপায় হয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন। লেকের মাঝপথে এমন পরিস্থিতি। আশপাশ থেকে আমাদের নৌকাকে লক্ষ্য করে লাইট মারছেন পাড়ার লোকজন। আতংকে শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল। যেভাবেই হোক নৌকা চলার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনজনের অক্লান্ত চেষ্টায় পনের বিশ মিনিট পর পথ কিছুটা পরিষ্কার হল। নৌকার ইঞ্জিন চালু হওয়ার পর প্রথমে ধীর গতিতে সে পথ পাড়ি দিল। চার পাঁচ মিনিটের পথ পাড়ি দেওয়ার পর আবার স্বচ্ছ পানির পথের দেখা মিলল। চালক হাসি দিয়ে বললেন, আপনারা সহযোগিতা না করলে রাত ওইখানেই কাটাতে হত। এখন ভয় নেই।

সামনে এমন পরিস্থিতি হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। চুপচাপ বসে সামনের পথের দিকে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর পরই কুচুরিপানার দল ভেসে আসে। চালক নিজ দক্ষতায় তা এড়িয়ে চলেন। এটাকে এডভ্যাঞ্জার না বলে নিজেদের বোকামির খেসারত বলা চলে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার পর দূর থেকে কাপ্তাই বাজারের লাইট দেখা যাচ্ছিল। তখন প্রাণে পানি এল। রাত সোয়া ৮টার দিকে আমরা পৌছালাম কাপ্তাই বাজারে।

আমাদের জন্য বাস আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। বাসে উঠে ভেজা কাপড় বদলে নিলাম। বাস ছুটে চলল ঢাকার উদ্দেশ্যে।

বাসায় ফেরার পর যখন ঝর্ণার ছবি ও ভিডিও দেখছিলাম তখন মন ভরে গেল আনন্দে।

যেভাবে যাবেন: 

রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি কাপ্তাই যাওয়া যায় বাসে। তাছাড়া বাস, ট্রেন বা আকাশ পথে চট্টগ্রাম হয়েও কাপ্তাই যেতে পারবেন। তারপর বিলাইছড়ি যেতে হবে লঞ্চ বা ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে। বিলাইছড়ি বাজার থেকে দুই আড়াই ঘণ্টার পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে ন-কাটা ও মুপ্পোছড়ি ঝর্ণায়।

যেখানে থাকবেন

বিলাইছড়ি বাজারে বিভিন্ন রেস্ট হাউস রয়েছে। বাজেট অনুযায়ী সেখানে থাকতে পারবেন।

খাবেন যেখানে

কাপ্তাই বাজার ও বিলাইছড়ি বাজারে খাবরের রেস্টুরেন্ট রয়েছে। তাছাড়া বিলাইছড়ি থেকে ঝর্ণায় যাওয়ার পথে কিছু দোকান পাবেন। চাইলে সেখানে হালাকা খাবার খেতে পারবেন।

বিশেষ সতকর্তা

এসব ট্যুরে যাওয়ার আগে আবহাওয়া সম্পর্কে খবর নিয়ে যাওয়া ভালো। কোনো সর্তক সংকেত থাকলে না যাওয়াই উত্তম। ফ্লাশ প্লাডে পড়লে জীবন ঝুঁকিতে পড়তে হয়। যাওয়ার সময় সাথে অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি নিয়ে যেতে হবে। সাথে শুকনো খাবার ও প্রয়োজনীয় ওষুধ, টর্চ লাইন নিয়ে গেলে ভাল হয়। এ ধরনের ভ্রমণ গ্রুপে গেলে যেমন নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না তেমনি খরচও কম হয়।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর