১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ১৭:০০

কৃষিবিদরাই দেশের উন্নয়নে বেশি অবদান রাখছেন

কৃষিবিদ বশিরুল ইসলাম

কৃষিবিদরাই দেশের উন্নয়নে বেশি অবদান রাখছেন

বশিরুল ইসলাম

 ১৩ ফেব্রুয়ারি, কৃষিবিদ দিবস। ১৯৭৩ সালের এ দিনে কৃষিবিদদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার মর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির পিতার এ ঘোষণাটি ছিল কৃষিবিদদের জন্য ঐতিহাসিক মাইলফলক। দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষিবিদ দিবস হিসেবে পালন করছে কৃষিবিদগণ। একজন কৃষিবিদ হিসেবে আজকের এই দিনে কৃষিবিদরা কৃষি বা তার সাব-সেক্টরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর এ স্বীকৃতিস্বরূপ দক্ষতার কতটুকু পরিচয় দিতে পারছেন, তা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

এক সময় খাদ্য ঘাটতির দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত ছিল আমাদের। বিদেশ থেকে আমদানি করেও সাহায্য নিয়ে এই খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলা করতে হতো। যে শ্রমিকের দাবি ছিল ৩ কেজি চালের সমান দৈনিক মজুরি, সে এখন কাজ করে ১৫ থেকে ২০ কেজি চালের সমান দৈনিক মজুরিতে। না খেয়ে দিন কাটে না কোনো মানুষেরই। বাজারে অভাব নেই কোনো কৃষিপণ্যের। শুধু ধানের উৎপাদনই নয়, বেড়েছে শাকসবজি, ফলমূল, ডিম, দুধ, মাছ ও মাংসের উৎপাদন। সারা বছরই পাওয়া যাচ্ছে শাক-সবজি। বিদেশী ফল স্ট্রোবেরী, কমলা, মালটা, ড্রাগন ফল, কাজু বাদামেরমত অনেক ফলের চাষ সফলভাবে হচ্ছে বাংলাদেশে। ফলে এই সকল সু-স্বাদু ফল দেশের সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য হয়েছে। ছাদ-কৃষিতেও ব্যাপক সাফল্য, আগ্রহ ও জনপ্রিয়তা আশাব্যঞ্জক। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সবজি ও ফলের চাষও রয়েছে। দুই যুগ আগেও বাংলাদেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি অর্ধেক এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দুটি ফসল হচ্ছে। 

আমাদের দেশটা আয়তনে বিশ্বের ৯৪তম আর অষ্টম জনবহুল ছোট্ট একটা দেশ। অতিরিক্ত জনগণের জন্য বসতবাড়ি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, দ্রুত শিল্পায়নে এমনিতেই প্রতিনিয়ত আবাদি জমি কমছে। অবশিষ্ট জমিতে এত বিপুল জনসংখ্যা প্রধান খাদ্যের বড় অংশ দেশের ভেতরে উৎপাদিত হচ্ছে, এটা ভাবা যায়। আবার উৎপাদনের নিরিখে দেশের ২২টি কৃষিপণ্য বিশ্বে শীর্ষ ১০ অবস্থান করছে আমাদের দেশটা। আর ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৪তম। এই হিসাব জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, আয়তনে ছোট হলেও কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ ভালো। 

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কৃষি খাতের এ সাফল্যের পেছনের নায়ক কে? অবশ্যই আমাদের কৃষকদের অবদান এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। আর কৃষিবিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিবিষ্ট গবেষণায় উৎপাদন বাড়ার পেছনে প্রধান উজ্জীবক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। সে সঙ্গে সরকারের নানা উদ্যোগে পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে চলেছে এ খাত।  উচ্চফলনশীল ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণু নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন ও প্রবর্তনের ফলে খাদ্যশস্য, সবজি ও ফল-ফসল উৎপাদনে বৈচিত্র্য এসেছে। সেসঙ্গে সমুদ্র ও মিঠাপানির মাছ, গবাদিপশু, পোল্ট্রি, মাংস ও ডিম, উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি, দুগ্ধ উৎপাদনে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে চলছে। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় দেশের খোরপোষের কৃষির রূপান্তর ঘটছে বাণিজ্যিক কৃষিতে।  

কালের পরিক্রমায় কৃষিবিদরা কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মোতাবেক দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কৃষি শিক্ষায় মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের প্রবেশ বাড়তে থাকে; যদিও ১৯৭৭ সালের বেতন কাঠামোয় কৃষিবিদদের সেই মর্যাদা আবারও একধাপ নামিয়ে দেওয়া হয়। কৃষিবিদদের তীব্র আন্দোলনের মুখে তদানীন্ত সরকার কৃষিবিদদের সেই হারানো সম্মান আবার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন। এরপর বিভিন্ন ধারার রাজনীতির ডামাডোলে এই বিশেষ দিনটিকে মনে করার কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি। অবশেষে ‘কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ’-এর তৎকালীন মহাসচিব ও বর্তমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এমপি’র একান্ত চেষ্টায় এই দিনটিকে ‘কৃষিবিদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেসঙ্গে ২০১১ সাল থেকে যথাযোগ্য মর্যাদায় নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটিকে কৃষিবিদ দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। ফলে বঙ্গবন্ধুর কারণে আজকে আমরা কৃষিবিদরা গর্ব করে বলতে পারি, ‘বঙ্গবন্ধুর অবদান, কৃষিবিদ ক্লাস ওয়ান’।

সত্যি কথা বলতে কি, এ দেশে কৃষির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের যাত্রার উল্লম্ফন বঙ্গবন্ধু মধ্য দিয়েই বিস্তার লাভ করা শুরু করেছিল। এর মাধ্যমে তিনি কৃষির উন্নয়নে দেশ-বিদেশের কৃষি গবেষকদের সংযুক্ত করতে পেরেছিলেন। তিনি যথার্থই বুঝতে পেরেছিলেন জনসংখ্যাধিক্য দেশ হিসেবে সারা দেশের মানুষের খাদ্য জোগাতে হলে কৃষির ওপর জোর না দিয়ে উপার নেই। বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদদের ক্লাস ওয়ান মর্যাদা দেওয়া কৃষিবিদরা শুুধু যে কৃষি সেক্টরে অবদান রাখছে এমনটি নয়। কৃষিবিদরা প্রতিটি সেক্টরে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। কী ফসল উৎপাদনে, মৎস্য উৎপাদনে, পশুসম্পদ উন্নয়নে, কী কৃষি যান্ত্রিকীকরণে, এমনকি কৃষি অর্থনীতিতে পলিসি ও পরিকল্পনায় অবদান রেখে চলেছেন। অবদান রাখছেন প্রশাসনে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, কূটনীতিতে, কর কমিশনারের, ব্যাংকার, সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা পেশাসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি সেক্টরে। 

কৃষিতে পড়াশোনা করে দীর্ঘদিন ধরে সফলতার সাথে কৃষিবিদ তারেক হাসান ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের পাইলট হিসেবে বিমান চালাচ্ছে। কৃষিবিদ যুগল কিশোর নাথ চাকরি করে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে। তার অনার্স কৃষিতে এবং মাস্টার্স জেনেটিক্স অ্যান্ড প্লান্ট ব্রিডিংয়ে। শুধু যে, কৃষিবিদ যুগল কিশোর নাথ এয়ারপোর্টে  কাজ করে এমনটা নয়, অনেক কৃষিবিদই আজ দেশ-বিদেশের কাজ করছে। করোনা মহামারীকালীন সময়ে ভ্যাক্সিন এবং কিট সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনায় আসা বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল। সার্স ভাইরাসের কুইক টেস্টকিটের আবিস্কারক। তিনিও একজন কৃষিবিদ! এমনই অসংখ্যা কৃষিবিদরা সুনামসহকারে কাজ করছেন আন্তর্জাতিক ও দেশের বিভিন্ন সংস্থায়। এ ছাড়া স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতিতেও রেখে চলেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার সুবাদে কৃষিবিদরা এ দেশে আজ এক মর্যাদাবান পেশাজীবী হিসেবে স্বীকৃত।

২০২৩ সালের ২৩ আগস্ট প্রতিবেশী দেশ ভারত সফল চন্দ্র অভিযানের পর বাংলাদেশের মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা উঠে। তখন আলোচনা কেন্দ্রে ছিলেন একজন কৃষিবিদ। কারণ ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর চেয়ারম্যান এস সোমনাথ একজন অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার। আর বাংলাদেশের স্পারসোর চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ একজন ‘কৃষিবিদ’। একজন কৃষিবিদকে এমন বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান করায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তখন ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। সমালোচনা করে তারা বলছিল, কৃষিবিদের কাজ আলুর চাষ। ধানের চাষ করা তিনি কি করে মহাকাশ গবেষণার প্রাতিষ্ঠানিক প্রধান হতে পারেন! তিনি  কি চাঁদে গিয়ে আলুর চাষ করবেন? 

দেশের কৃষি গবেষণার সাফল্যে যখন ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের সংস্থান করে চলেছে তখন দেশের কৃষিবিদ ও কৃষি বিজ্ঞানীদের এমন হেয় করে অপপ্রচার  সকল কৃষিবিদের মত আমাকেও ভীষনভাবে আহত করেছে। আসলে, কিছু লোকই আছে জেনে না জেনে অযথা সমালোচনা করা। কী কারণে সমালোচনা করল তা সে নিজেও জানে না। অথচ একটা পেশাকে যে হেয় করা হচ্ছে সে উপলব্ধিও করতে চার না। তেমনি স্পারসো কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা না জেনেই একজন কৃষিবিদকে নিয়ে সমালোচনা লিপ্ত ছিল অনেকেই। কারণ আমাদের দেশের স্পারসো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমকে ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষি, বন, মস্য, ভূ-তত্ত্ব বিভাগে জলবায়ু ও  আবহাওয়াগত তথ্য সরবরাহের জন্য। মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল কখন কোথায় বন্যা হতে পারে, অতিবৃষ্টি তুফান ও টর্নেডোতে ফসলের ক্ষতি হতে পারে তার আগাম সংকেত দেবার জন্য আধুনিক স্যাটেলাইট প্রযুক্তির রিমোট সেন্সরের ব্যবহারের মাধ্যমে। এভাবেই ঝড়ের সংকেত দেয়ার কাজটিও করে থাকে স্পারসোর মোট ১৭ টি বিভাগের মধ্যে একটি বিভাগ। বাকি ১৫ টিই কৃষি তথ্যের কাজ করে। তো সেখানে তো একজন কৃষিবিদকেই প্রধান হিসেবে থাকার কথা। অথচ নানামুখী আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই আব্দুস সামাদকে বদলি করা হয়েছিল।

কৃষিবিদদের কল্যাণে এবং কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে কৃষি খাতে এখন উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। বর্তমানে চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান হলো সবার ওপরে। তাছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম ও আলু উৎপাদনে অষ্টম বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ, গম দুই গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ ও সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে আম, আলু রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। মাছ রপ্তানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। চিরকালের দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে। জমির সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদদের মর্যাদা দিয়ে বলেছিলেন আমার মান রাখিস। বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ঘোষণার মান রেখেছেন বাংলার কৃষক ও কৃষিবিদগণ। বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির কল্যাণে কৃষিবিদ ও কৃষকের অবদানে দেশের কৃষি আজ নতুন উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে।

লেখক: উপ-পরিচালক
শেরে-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর