১৬ অক্টোবর, ২০১৭ ২২:০৩

উখিয়া সীমান্তে রোহিঙ্গা ঢল, আরও অর্ধলক্ষাধিক অনুপ্রবেশ

শফিক আজাদ,উখিয়া (কক্সবাজার):

উখিয়া সীমান্তে রোহিঙ্গা ঢল, আরও অর্ধলক্ষাধিক অনুপ্রবেশ

উখিয়া সীমান্তে ফের রোহিঙ্গা ঢল, স্রোতের মতো প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। রবিবার রাত থেকে সোমবার পর্যন্ত আরও অর্ধলক্ষাধিকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড(বিজিপি) এবং রাখাইন উগ্রবাদীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২৫ আগষ্ট সীমান্তের অর্ধশতাধিক পয়েন্ট দিয়ে একত্রে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটে বাংলাদেশে। 

স্রোতের মতো অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকে অন্তত ১৫দিন। ২০সেপ্টেম্বর থেকে ৮ অক্টোবর পর্যন্ত অনুপ্রবেশে কিছু ভাটা পড়ে। ৯ অক্টোবর ফের অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটে উখিয়ার সীমান্তের আঞ্জুমানপাড়া দিয়ে। ১০ অক্টোবর হতে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত বন্ধ থাকে উখিয়ার সীমান্তে অনুপ্রবেশ। কিন্তু ১৬অক্টোবর গভীর রাতে আবারো রোহিঙ্গা ঢল নামে উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তে। এতে প্রায় অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা রয়েছে বলে স্থানীয়দের দাবী। যদিও বিজিবি অনুপ্রবেশকারী এসব রোহিঙ্গাদের জিরো পয়েন্টে একটু অদূরে আটকে রেখেছে।

সরেজমিনে উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়া চিংড়ি ঘেরে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা মিয়ানমারের বুচিডং এলাকার বাসিন্দা মো. সোয়াইব(৩৮) এর সাথে কথা বলে জানা যায়, মিয়ানমারের ২০/২৫টি গ্রাম থেকে অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলিম রবিবার রাতে আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। সে জানায়, ৮দিন বনে-জঙ্গলে অবস্থান করে হেটে বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছেছি।  তার বাবা-মা ১মাস পূর্বে বাংলাদেশে চলে আসে। 

অনুপ্রবেশকারী বয়োবৃদ্ধ মহিলা, মিয়ানমারের বুচিডং পাঁচকারিবিলা এলাকার ফাতেমা বেগম(৫৯) জানান, তার স্বামী মারা গেছে মিয়ানমারে। ছেলে ও মেয়ে সবাই আগে বাংলাদেশে চলে এসেছে। আমি চেয়েছিলাম মিয়ানমারে থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার বাড়ীঘর পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে উপায়ান্তর না দেখে বাংলাদেশে চলে এসেছি। আমি এখনো কাউকে খোঁজে পাইনি। একা এখানে বসে আছি।

অনুপ্রবেশকারী আরেক রোহিঙ্গা মিয়ানমারের বুচিডং ষ্টেশন বাজারের বাসিন্দা নুরুল আলম (৫৫) জানান, বুচিডং ষ্টেশনে আমার ২টি দোকান রয়েছে। দোকান গুলোতে অন্তত মিয়ানমারের ১০কোটি টাকার মালামাল আছে। কিন্তু ১১দিন আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রাখাইন উগ্রাবাদী যুবকেরা আমার দোকান গুলোতে লুটপাট চালিয়ে মালামাল তছনছ করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। গ্রামের লোকজনকে বন্দী করে রাখে, যাতে কেউ ঢুকে সাহায্য,সহযোগিতা করতে না পারে। কয়েকদিন না খেয়ে অনাহারে অনাধারে থাকার পর ৬দিন পায়ে হেটে আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তের মেদি এলাকায় পৌঁছি। রবিবার রাতে কাটা তারের বেড়া পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকি।'
 
ইলিয়াছ মিয়া নামের (২৫) মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারী এক যুবক মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বলেন, আমরা আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গা সংক্রান্ত সে কথাবার্তা চলতে তা দেখে মনে করেছিলাম মিয়ানমারের পরিবেশ শান্ত হয়ে উঠবে কিন্তু মিয়ানমার সরকার নরম সুরে কথা বললেও রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্যাতন চালায় আরো গরম করে। তিনি আরো বলেন, রাখাইন প্রদেশে সেনা মোতায়েন নতুন করে সহিংসতা, বাড়ী-ঘরে আগুন, এলাকা ছাড়তে রোহিঙ্গাদের মাইকিং করার পর থেকেই ওই এলাকা থেকে পালাচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা।

পালংখালী ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সুলতান আহমদ জানান, রবিবার রাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। অনুপ্রবেশকারী এসব রোহিঙ্গাদের বিজিবি সীমান্তে আটকে রেখেছে। 

বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সীমান্তের জিরো পয়েন্টে রাখা হয়েছে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও মানবিক সেবা প্রদান অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও শারিরিক ভাবে যারা বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছে তাদেরকে আলাদা ভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থা করা হয়েছে।
   
এদিকে রোহিঙ্গা প্রবেশ বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে আবাসন ও স্যানিটেশন, ও চিকিৎসা সমস্যা। সরকারি বনভূমি ও পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে ঝুপড়ি ঘর। তবে পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি বলে দাবি করছেন সার্বিক বিষয়ে দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের সেনা সদস্যদের অত্যাচারে দেশটির মংডু থানার প্রায় সব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন। সেনা সদস্যরা এখন বুচিডং ও রাছিডং এলাকার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় হামলা চালাচ্ছে। বেশ কয়েকটি পাহাড়, বঙ্গোপসাগরের অংশ সামিলার দড়িয়া পাড়ি দিয়ে তারা বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া মায়ানমারের নাইক্ষাংদিয়া অথবা উখিয়া সীমান্তের মেদি এলাকায় জড়ো হচ্ছে। মিয়ানমার ত্যাগ করতে তারা নিচ্ছেন জীবনের ঝুঁকিও। বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে সোমবার ১০সহ ১৮০জন রোহিঙ্গা নারী,পুরুষ,শিশু নিহত হয়েছেন। নিখোঁজ রয়েছেন সহস্রাধিক।

রোহিঙ্গাদের নেতা আরেফ আহমদ জানান, মিয়ানমারের বুচিডং ও রাছিডং এই দুই থানার আওতাধীন ইয়াংমং,ইমাম উদ্দিনপাড়া,চৌপ্রাং,মরিচ্যা বিল, বাদানি, ধামনছড়া, পুন্দুপ্রাং, তমবাজার, নারাইংশং, তিতারবিল, জাংগামা, মইদং, ছালিপাড়া, গোদাম পাড়া, সাংগামা, জোপাড়া ও প্রিংডম সিকদারপাড়া, গেবাংজা, কোয়াংডং, উনাপে, ধামরেশং, কৈমালি সহ ২০/২৫টি গ্রাম থেকে সোমবার অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমারের মেদি হয়ে এপারে  অনুপ্রবেশ করেছে। 

মিয়ানমারের বুচিডং সাংগামা থেকে পালংখালী আঞ্জুমানপাড়া হয়ে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা খলিলুর রহমান (৪৫) জানান, ২০ সেপ্টেম্বর অংসান সুচি সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু ২১ তারিখ থেকে সেনা সদস্যরা গ্রামে ঢুকে ঘরবাড়িতে আগুন দেয়। গরু-ছাগল হাস-মুরগী লুটপাট করে। এতে রোহিঙ্গারা আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ফলে এ সব গ্রামের রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসতে শুরু করেছে। 

মিয়ানমারের বুচিদং থানার থামি থেকে পালিয়ে আসা কামাল হোছনের স্ত্রী দীলদার বেগমের (২৫) সঙ্গে  কথা হলে জানায়, বিভিন্ন পাহাড় টিলা ও মেটোপথ পাড়ি দিয়ে ছয় দিন খেয়ে না খেয়ে তিনি মেদি সীমান্তে পৌঁছেছে।

 

উল্লেখ্য যে, ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনা চৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। এরপর ২৫ আগষ্ট থেকে মিয়ানমারে সহিংসতা শুরু হয়। রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। সেনাবাহিনীর ওই হামলায় এখনও পর্যন্ত ৬ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে, আর প্রাণভয়ে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে। 

জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৫লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। তবে স্থানীয় লোকজন,রোহিঙ্গা নেতা এবং বিভিন্ন এনজিও সংস্থার তথ্যমতে অনুপ্রবেশ আরও বেশি। এতে নতুন করে যোগ হবে সোমবার অনুপ্রবেশ করা অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা।

বিডিপ্রতিদিন/ ১৬ অক্টোবর, ২০১৭/ ই জাহান

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর