আমার এক প্রতিবেশী গ্রাম থেকে ঈদ উৎসব করে শহরে ফিরলেন। কিন্তু বাসায় ওঠার আগেই তার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল। তাকে দেখেই আমি জোরসে হাসা শুরু করে দিলাম। কারণ তার মাথায় তখন চানাচুরওয়ালাদের মাথার চিকন লম্বা টুপির মতো একটা টুপি। রঙচঙা। একটা বয়স্ক ভদ্রলোক যদি চানাচুর বিক্রেতার টুপি পরে থাকে, হাসি না এসে উপায় আছে বলেন! প্রতিবেশী আমাকে মৃদু ধমক মেরে হাসি থামালেন। জিজ্ঞেস করলেন হাসছি কেন। আমি আবার হাসতে শুরু করলাম। প্রতিবেশী বিরক্ত হয়ে চলে যেতে লাগলেন। আমি এবার হাসির কারণটা বলে দিলাম। প্রতিবেশী বললেন, ভাইরে, এখানে দাঁড়িয়ে হয়তো টুপিটাকে হাস্যকর মনে হচ্ছে। কিন্তু লঞ্চঘাটে গেলে মনে হতো এরচেয়ে উপকারী বস্তু আর দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি নেই। আমি বললাম, কেন বলেন তো? প্রতিবেশী বললেন, লঞ্চঘাটে কেমন ভিড়, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। আমি এই ভিড়ের মধ্যে বারবার হারিয়ে যাচ্ছিলাম। আপনার ভাবী আমাকে খুঁজেই পাচ্ছিল না। তাই এক চানাচুরওয়ালার কাছ থেকে টুপিটা কিনে নিয়ে পরলাম। টুপিটা সবার মাথার উপর দিয়ে দেখা যেতে লাগল। আমাকে ভিড়ের মধ্যে খুঁজে পেতে আপনার ভাবীর আর কোনো সমস্যাই হলো না। পাশ দিয়ে তখন যাচ্ছিলেন আমার আরেক প্রতিবেশী। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ভাবী যাতে আপনার মাথা ভিড়ের মধ্যে খুঁজে পায়, এই জন্য আপনি আরেকটা কাজ করতে পারতেন। ভাবীর হাইহিল পরে হাঁটাচলা করতে পারতেন। বেশি না হোক, অন্তত ফুটখানেক তো লম্বা হতেন নাকি! আমার এক বন্ধু বলল, আমি মনে করি, ঈদের পর অন্য পেশার লোকেরা ঢাকায় ফিরতে দেরি করলেও দর্জিদের ঢাকায় ফিরতে দেরি করা একদমই উচিত না। পারলে ঈদের পরদিনই দর্জিদের ঢাকায় ফিরে আসা উচিত। আমি বললাম, হঠাৎ তুই দর্জিদের পেছনে লাগলি কেন? বন্ধু বলল, এবার বাড়ি থেকে ফেরার পথে যে যন্ত্রণাটা ভোগ করেছি, কী আর বলব। আমি বললাম, তোর এই যন্ত্রণার সঙ্গে দর্জিদের দ্রুত ঢাকায় ফেরার সঙ্গে সম্পর্ক কোথায়? বন্ধু বলল, সম্পর্ক তো অবশ্যই আছে। ট্রেন থেকে কমলাপুর নেমে দেখি লাখ লাখ মানুষ। ভিড় আর ভিড়। শুরু হয়ে গেল ধাক্কাধাক্কি। আমার পরিচিত একজন সদরঘাট এসে নেমে একই সমস্যায় পড়েন। আমিও ধাক্কাধাক্কির কবলে পরে শার্ট-প্যান্টের সেলাই ছুটিয়ে ফেলেছি। আমার পরিচিতও জনও একই কাজ করেছে। তার শার্ট-প্যান্টের সেলাইও আগের জায়গায় নেই। তার মানে ভিড়ে পড়ে আমাদের মতো অনেকেরই শার্ট-প্যান্টের সেলাই ছুটেছে। কারও কারও পকেট কেটে ফেলেছে পকেটমাররা। কিন্তু মেরামত যে করবে, সেই উপায় নেই। কারণ দর্জিরা এখনো দোকান খোলেনি। তাই বলছিলাম আরকি। আমি বললাম, দর্জিরা না থাকলেও মুচিরা কিন্তু আছে। ঠেকার কাজ চালিয়ে নিতে পারিস। আমার এক বড় ভাই বললেন, প্রতিটি জিনিসই মানুষের মঙ্গল করে। ঈদের পর এই যে জবরদস্ত ভিড়টা হয়, এই ভিড়ও কিন্তু কোনো না কোনোভাবে মানুষের উপকার করে। আমি বললাম, ভাই, পজিটিভ চিন্তা করা ভালো। তাই বলে এত পজিটিভ হওয়া ভালো না। বড় ভাই বললেন, আমার কথা আগে বোঝার চেষ্টা কর, তারপর মন্তব্য করো। আমি বললাম, আপনার কথা আমি ভালোভাবেই বুঝেছি। আপনি কীভাবে বলেন ভিড় মানুষের উপকার করে? বড় ভাই বললেন, মানুষের কথা বাদ দে। আমার কীভাবে উপকার করেছে শোন। আমি ঢাকায় থাকলে ডায়েট কন্ট্রোল করি।
কিন্তু বাড়িতে গেলে মনেই থাকে না আমি কোনো দিন ডায়েট কন্ট্রোল করতাম। খাওয়ার উপরে খাওয়া, বিস্তর খানাপিনা আরকি। প্রতিবারের মতো এবারও খেলাম। যে দিন বাড়ি ফিরব, দেখি শার্ট আর গায়ে ঢুকছে না। এবার বোঝ ভুঁড়ি কী পরিমাণে বড় হয়েছে। তারপর যখন ঢাকায় এসে নামলাম, রেলস্টেশনের ঠেলাঠেলিতে আমার ভুঁড়ি এতটাই চাপের মধ্যে পড়ল যে, দশ মিনিটে ছোট হয়ে গেল। আর দশটা মিনিট ভিড়ের মধ্যে থাকতে পারলে ঋত্বিক রোশনের পেটের সঙ্গে আমার পেটের কোনো ফারাক থাকত না।