গত বছরের কথা। শুনেছি অনেকেই নাকি ইলিশ কেনার জন্য ব্যাংক লোন নিচ্ছে। আমরা ব্যাচেলর মানুষ। এসব স্বপ্ন টপ্ন দেখি না। কিন্তু সবাই তো আর পারে না। অয়ন মেসের সবচেয়ে নবীন সদস্য। উচ্চশিক্ষার জন্য পরিবার-পরিজন ছেড়ে সদ্য ঢাকায় এসে উঠেছে আমাদের মেসে। এক রাতে তার ঘর থেকে কান্নার শব্দ শুনে ছুটে গেলাম। মেস ম্যানেজার সাজ্জাদ ভাই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই অয়ন কান্দিস কেন? ভয় পেয়েছিস?’
অয়ন মাথা নাড়ে— না, ভাই।
: তাহলে বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ছে?: না, ভাই।
: প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়েছিস?
: না, ভাই
: তাহলে কান্দিস ক্যান?
: ভাই, আমি স্বপ্ন দেখলাম খাইতে বসছি। আম্মা আমার পাতে সবচেয়ে বড় ইলিশের টুকরাটা তুইলা দিলেন। যেমন স্বাদ তেমন ঘ্রাণ। আরেক প্লেট ভাত নিয়ে যখন আরেক পিস ইলিশ নিলাম তখনই লাগল ঝামেলাটা। গলায় কাঁটা আটকে গেল। আম্মা দ্রুত গরম গরম ভাত মুখে পুরে দিলেন। গরম ভাতের গরমে ঘুমটা ভাইঙ্গা দেখি আমি মেসের খাটে শুয়ে আছি!
অয়ন আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল। আহারে ছেলেটা!
সে রাতে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে করেই হোক মেসে ইলিশ খেতে হবে।
তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করে দেওয়া হলো বাজার যাচাই করার জন্য। যাচাই করার পর তাদের মুখ কালো। সাইফুল গলা চড়া করে বলল, ‘না ভাই, কিছুতেই ইলিশ খাওয়া সম্ভব না। এই বাজারে ইলিশ খেতে হলে দাদার দেওয়া ভিটা বিক্রি করতে হবে।’
জব্বার আরও রেগে আছে, ‘ওই ব্যাটা, তোর দাদা কী নবাব ছিল যে, ভিটা বিক্রি করলেই ইলিশ খাইতে পারবি?’
পুরো ঘর থমথমে। নবীন সদস্য অয়নের জন্য ইলিশ আনতে গিয়ে বালিশ পুরায় অবস্থা। ঠিক তখনই সাজ্জাদ ভাই দিলেন এক যুগান্তকারী আইডিয়া—
: আমরা ভাগে ইলিশ কিনব?
: মানে?
: আরে, যেমন ভাগে ইলিশ কিনব!
: অতএব, দুর্দান্ত আইডিয়াটি নিয়ে আমরা নেমে পড়লাম। আশপাশের সব মেসে চিঠি পাঠানো হলো। প্রজেক্ট ইলিশের প্রস্তাব দিয়ে। সেই সব মেসেজ উত্তরগুলো ছিল এমন—
শালারা! ছাগল-পাগল কোথাকার।
আরেকটা মেস থেকে এলো— ইলিশের ছবি প্রিন্ট করে রান্না করে ফেলেন!
উল্টাদিকের মেসের রিপ্লাই ছিল— কুবের মাঝির লগে যোগাযোগ করেন!
উপরের তলা থেকে উত্তর এসেছিল— হালায় ব্যাচেলর, ভাত পায় না, খাইতে ইলিশ চায়!
এসব উত্তর শুনে আমরা দমে গেলাম না। পজেটিভ উত্তরও এসেছিল। এলাকার এক মেস আমাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে সাড়া দিয়েছিল। এক সকালে আমরা গেলাম বাজারে। দুই মেসের সমন্বয়ে ইলিশ কিনতে গিয়ে দেখা গেল, এই টাকায় ইলিশ কিনলে যে পরিমাণ মানুষ প্রত্যেকের ভাগে কাঁটাও জুটবে না!
অতএব, শেষ পর্যন্ত ব্যাচেলর হয়ে ইলিশ খাওয়ার স্বপ্ন দেখা বাদ দিলাম। অয়নকে ডেকে সাজ্জাদ ভাই বলল, দেখ অয়ন, পড়ালেখা করে অনেক বড় হও। বড় হলে ইলিশ খেতে পারবা!
ইদানীং হঠাৎ সবখানে দেখা যাচ্ছে ইলিশ নাকি পানির দরে বিক্রি হচ্ছে। ঢাকা শহরে এক গ্লাস পানির দাম এক টাকা। তাহলে কী এক টুকরো ইলিশের দামও এক টাকা? সে রাতে মেসে সিদ্ধান্ত হলো, আমরা ইলিশ খাচ্ছি। সিদ্ধান্তের পর যেন পুরো মেসে উৎসব শুরু হয়েছে। মিউজিক বাজছে, কেউ নাচানাচি করছে। কেউবা পরিকল্পনা করছে ইলিশ নিয়ে কী স্ট্যাটাস দিলে লাইক বেশি পাওয়া যাবে।
অবশেষে বাজার থেকে ইলিশ আনা হলো। আমি সুযোগ পেয়ে দুইটা ছবি তুলে রেখেছি। আবার যখন দাম বাড়বে এই ছবি ফেসবুকে আপলোড করে দেব। কারও কোনো কাজে মন বসে না। মন পড়ে আছে ইলিশে। বুয়াকে ডিরেকশন দেওয়া হলো কীভাবে সর্বোচ্চ স্বাদের ইলিশ রান্না করা যায় সে ব্যাপারে।
আজ আমাদের মেসে আনন্দের কোনো সীমা নেই। ব্যাচেলর হয়ে ইলিশ মাছ খাবে এ জন্য সবাই যার যা কিছু আছে তা নিয়েই প্রস্তুত। কেউ নতুন জামা পরেছে, কেউ চুলে শ্যাম্পু করেছে। সব এই ইলিশকে কেন্দ্র করে। খাবার রেডি। আমরা পরস্পরের সঙ্গে আনন্দ বিনিময় করলাম।
: শুভ নববর্ষ।
: শুভ নববর্ষ।
: নতুন বছর ভালো যাক।
: নতুন বছর অসাধারণ যাক।
যেহেতু বৈশাখে ইলিশ খাইনি সেহেতু যখনই ইলিশ খেয়েছি তখনই পহেলা বৈশাখ। খেতে খেতে ভাবছিলাম, হে জগৎ দেখ ব্যাচেলররাও ইলিশ খায়!