আমাদের নিচতলায় থাকেন এক ভাবি। শুনেছি তিনি খুব ভালো কেনাকাটা করেন। আমি কেনাকাটায় একেবারেই আনাড়ি। জামাকাপড়ের দাম সম্পর্কে কিছুটা আইডিয়া থাকলেও দেশি মুরগি বা কাঁচাবাজারে জিনিস দামাদামি করে কেনার সাহস হয় না। বাজার আমার জামাই করে। কোনো কারণে আমাকে করতে হলে সুপারশপে চলে যাই। ওনারা যখন গল্প করেন যে ৮০০ টাকার জিনিস ৩০০ টাকায় কিনে এনেছেন তখন আমি ভাবী, এত সস্তা! আমি তবে কী ঠকাটাই ঠকি। দামাদামি করাটা এবার শেখা দরকার। সেই থেকে যখনই কোনো কিছু এসে হাঁক দেয় আমি কান খাড়া করে থাকি। ভাবীর দামাদামি শোনার চেষ্টা করি। হকাররা কী বলে হাঁক দেয় সেটা অবশ্য বেশিরভাগ সময় বুঝতে পারি না। সেদিন ‘এইমুরো’ বলে এক লোক ডেকে যাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারলাম না কী বিক্রি করতে এসেছে। শুনলাম ভাবী ডাক দিলেন। পরে বুঝলাম ওটা ছিল মোরগ। এ মোরগ কথাটাই সুর করে বলায় ওরকম শোনাচ্ছিল। আমি জানালার আরেকটু কাছে এগিয়ে গেলাম। ভাবী আর মোরগওয়ালার কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। ‘কত করে মোরগ?’ ‘একদাম ষোল শ। খালি আপনে নিলে এক শ কমায়া রাখুম। পনের শ হালি। নেন কয় হালি নিবেন?’ আমি মনে মনে ভাবছি এখন ভাবী কী বলবেন? কত হতে পারে? ১ হাজার? ৮০০? শুনলাম ভাবী বলছেন, ‘নাহ, যান ভাই, নেব না।’ ‘কী কন আপা, এত বড় মোরগ এই দামে আর পাইবেন?’ ‘না পাইলে নাই। নেব না ভাই। যান আপনে।’ আমার খারাপ লাগল। লোকটা আশা করে এসেছে। না কিনলে ডাকার কী দরকার ছিল। শুনলাম মোরগওয়ালা বলছে, ‘আচ্ছা আপা আরও ২০০ কমায়া দিয়েন। তিন হালি দিয়া দেই নাকি?’ ‘না ভাই, হবে না।’ ‘কি কন আপা? এর কম কেউ দিব নাকি? আইচ্ছা যান আপনে একটা দাম বইলা দ্যান। হইলে দিয়া যামুগা।’ এবার ভাবী বোধহয় মোরগ টিপেটুপে দেখছেন। কোনো কথা নেই। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি। ভাবী নিশ্চয়ই ৮০০ বলবেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আমাকে অবাক করে দিয়ে ভাবী বললেন ৫০০ টাকা দেব।’ আমি হাঁ করে আছি। মোরগওয়ালা সাংঘাতিক খেপে গেল। ‘ নিবেন না ভালো কথা। এসব আজেবাজে দাম কন ক্যান? না নিলে না নিবেন। বইলা দিবেন যামুগা। এই দাম কইতে ডাকছেন? এগুলা নেওনের দাম? কিনার দামও কন নাই। এই দামে আর যাই পান মুরগ পাইবেন না।’ ভাবী বললেন, ‘যান তাইলে।’ শুনলাম দরজাও বন্ধ করে দিয়েছেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ১ হাজার ৫০০ টাকার মুরগি কেউ ৫০০ টাকায় দেবে? শুধু শুধু লোকটাকে খাটালেন। সময় নষ্ট করলেন। একটু পরে আবার কথা শুনে কান পাতলাম। মোরগওয়ালা বলছে, ‘ঐ আপা নিয়া যান, কয় হালি নিবেন?’ আমি কি ঠিক শুনছি! ভাবীর দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। ‘দুই হালি দেন। ভালোমতো পরিষ্কার করে দেবেন। পশম যেন না থাকে।’ ‘আরও দুই হালি রাইখা দেন আপা।’ ‘না দুই হালিই দেবেন।’ এত সস্তায় পেলে আমি কম করে হলেও তিন হালি রেখে দিতাম। উনি মাত্র দুই হালি রাখছেন কেন বুঝলাম না। আমার কাছে শ পাঁচেক টাকা আছে। আমিও ভাবীর সঙ্গে গিয়ে এক হালি নিয়ে এলাম। আমার জামাই ভালো বাজার করে বলে বেশ ভাব নেয়। আজ দেখবে আমিও কেমন পারি। ১ হাজার ৫০০ টাকার মুরগি ৫০০ টাকায় কিনেছি শুনলে ও অবাক না হয়ে পারবে না। সন্ধ্যায় জামাই বাসায় ফিরল। আমি বেশ ভাবে আছি। হালকা করে দুই-একটা খোঁচাও দিলাম। ও খুব জানতে চাইল কী হয়েছে। আমি বেশ কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে তারপর ফ্রিজের কাছে নিয়ে এলাম। দেখালাম কী কিনেছি। ওকে বললাম বলতো কত হতে পারে। আমি আগেই দাম বলে ফেলব আর ও সেটা শুনে আর কমিয়ে বলবে অত বোকা আমি নই। ও প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বলল, মোরগ হালি সাড়ে ৪০০ করে আনি। মাঝে মাঝে ৪২০/৪৩০ পাওয়া যায়। তবে এগুলো আরও কম হবে। আমি যেগুলো আনি সেগুলো আরও বড়। এগুলো বাচ্চা মুরগি হিসেবে বিক্রি করে। তুমি কত করে নিলে? আমি ঠিক কী বলব বুঝতে পারলাম না। আসল দাম বলার প্রশ্নই আসে না। বানিয়ে বললে ও বুঝে ফেলবে। এরপর উঠতে-বসতে খেপাবে। তাই ভাবটা ধরে রেখে বললাম, তুমি যা দিয়ে নিতে তার চেয়ে কম। ওর অবশ্য বুঝতে বাকি রইল না। মুচকি মুচকি হেসে বলল, বল, আমারও জানা থাকল। পরেরবার সুবিধা হবে। আমি আর সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা করলাম না।