সন্ধ্যায় একগাদা খাবার সাবাড় করে দেলু মিয়া রাতে আবার দুই প্লেট খিচুড়ি খেয়েছে। এই মহাখাদককে মা আমার কাছে কেন পাঠিয়েছে এখনো বুঝতে পারছি না। মা বলেছিল ছেলেটা বেশ কাজের। এইটুকু পিচ্চি আর কি হাতি ঘোড়া করবে। দেখা যাক চা-টা বানাতে পারে কি না। আমি ডাক দিলাম, ‘দেলু’। এক ডাকে দেলু হাজির।
: জি, আপা।
: চা বানাতে পারিস?: হ, আপা। ফাসক্লাস।
: তাহলে যা, চট করে এক কাপ রং চা বানিয়ে নিয়ে আয়। চিনি দিবি না। একটু তেজপাতা আর দারুচিনি দিস।
: আইচ্ছা।
মুখে বললেও জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। বললাম, ‘দাঁড়িয়ে আছিস যে?’
: একটা কথা কই?
: বল।
: আমার জন্মের সময় আমার বাপে অনেক খুশি হইছিল। এমুন খুশি হইছিল যে, দুই হালি ডিম কিন্না ফকির মিসকিনরে দিছিল। আমার বাপে নাকি কইছিল, হের যদি বেশি টেকা থাকত তাইলে আস্তা মুরগি কিন্না বিলাইত।
: আরও বেশি টাকা থাকলে একটা গরু কিনে সবাইকে খাওয়াত। ঠিক তো?
: ওমা গো! আপনে ক্যামনে জানলেন আপা!
দেলু চোখ গোল গোল করে জানতে চাইল। বললাম, ‘তোর কথা শুনলে যে কেউ বলতে পারবে।’
: না গো আপা। আপনের অনেক বুদ্ধি। এই জন্য পারছেন।
: দেলু, তোকে যে চা বানাতে বললাম।
: যাইতাছি আপা। এট্টু শুনেন। এই যে আমার নাম দেলু মিয়া, এইডাও কিন্তু আমার বাপে রাখছে। আমার আরও যে ছয়ডা ভাই বইন আছে হেগো নাম কিন্তু আমার বাপে রাখে নাই। মাইনসে রাখছে।
: দেলু মাথা ধরেছে। এগুলো পরে বলিস। চা-টা করে আন।
: এক্ষনি যাইতাছি আপা। শুনেন।
দেলু আবার শুরু করল, ‘আমার বাপে আমারে সব সময় দেলু মিয়া বইলা ডাক দিত। মেজাজ গরম হইলেও দেলু মিয়াই কইত। কয় বছর আগে দেলু মিয়া কইয়া ডাক দিয়া বাড়ি থিকা খেদায়া দিছে।’
আমি বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকালাম। ও মুখ নিচু করে বলল, ‘আমারে দেলু মিয়া বইলা ডাকবেন। আপা, আপনে শুধু দেলু কন। শুধু দেলু না, দেলু মিয়া কইবেন। বাপে অনেক শখ কইরা রাখছে। খালি আকিকা দিতে পারে নাই দেইখা...।’
এই বলার জন্য এত কথা! এই ছেলে দেখছি কানের পোকা খসিয়ে দেবে। বললাম, ‘দেলু, তোকে না বলেছি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলবি না। যা বলার সোজাসুজি বলবি।’ ও মিন মিন করে বলল, ‘দেলু মিয়া বইলেন আপা।’
: আচ্ছা, দেলু মিয়া, এইবার আপনি চা-টা করে আনেন।
ও আর দাঁড়ালো না। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতে লাগলাম কোন দোষে এই অদ্ভুত জিনিস আমার ঘাড়ে এসে জুটল। আধ ঘণ্টা বসে রইলাম দেলু মিয়ার খবর নেই। কাজ ফেলে উঠতে পারছি না। শেষে বাধ্য হয়ে উঠলাম। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে আমার চোখ ছানাবড়া। সব মসলার কৌটা ফ্লোরে নামানো। ঢাকনা খোলা। দেলু মিয়া রান্নাঘরের সবচেয়ে ওপরের তাকে উঠে বসে আছে। ওখানে রাখা মসলার কৌটাগুলো এক এক করে খুলছে। আমি চিৎকার করে উঠলাম। ‘দেলু, কি হচ্ছে এসব? নেমে আয় ওখান থেকে।’ দেলু মিয়া পোকার মতো বেয়ে বেয়ে নেমে এলো। আমার অগ্নিমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে পিন পিন করে বলল, ‘দারুচিনির ছাল খুঁইজা পাইতাছি না আপা। পাইলেই চা হইয়া যাইব। আমারে দেলু মিয়া বলবেন।’ রাগে আমি আর কথা খুঁজে পেলাম না।