শুক্রবার, ১৭ মে, ২০১৩ ০০:০০ টা

আসিতেছে আন্‌ন্‌দলোখ্

প্রশান্ত মৃধা

আসিতেছে আন্‌ন্‌দলোখ্
ট্রেনে ভিড় প্রায় উপচেপড়া! দুপুর গড়িয়ে চলেছে বিকালের দিকে। এতক্ষণ বোঝা যায়নি, এখন মনে হলো, রোদের তেজও বেড়েছে। বাংলার প্রায় চিরকালীন শরতের আবহ এখানে নেই। যাচ্ছি দিল্লি। বর্ধমানের আসানসোল থেকে ট্রেনে উঠেছি। বিহারের ধানবাদ ছাড়ার পরে ভূমি খুব রুখো। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকাই। তাকিয়ে থাকি আর জমির গঠন ও ধরন সবই ধীরে ধীরে অপরিচিত ঠেকে। ঠেকবেই, বাঙালমুলুকের বাইরে জীবনে গেছি নাকি। আসানসোলই তো এই কদিনে ভীষণ ধুলটে ঠেকেছে। আশ্বিনের আকাশে এখানে তুলোটে মেঘ সেখানে নেই। একটা যে শিশিরে ভেজা ভেজা ভাব থাকে সকালের দিকে, তাও ছিল না। দুপুরে চারদিক কেমন যেন তপ্ত হয়ে উঠত। মাটিতে ঘাস আছে, নিচে তার কেমন জানি কঠিন কালটে স্বভাব। তাতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। এখন চলেছি দিলি্ল! ফলে, দিলি্ল বহুৎ দূর জানি বটে, কিন্তু পথও যে মানুষজন সব সমেত বাঙালের জন্য অপরিচিত হয়ে উঠবে তা কোনোভাবেই জানা ছিল না। ধারণাও দেয়নি কেউ। কে দেবে? যাদের কাছে এসেছি, তাদের কাছে তো ওটি রাজধানী, নিজ দেশের অন্তর্গত। গোটা দেশের এ মাথা ও মাথা, সেই হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী, যাকে এক কথায় বলে আসমুদ্রহিমাচল_ পুরোটাই একটি দেশ। সে দেশের প্রদেশে প্রদেশে আলাদা ভাষা, আলাদা পোশাক, আলাদা খাদ্যাভ্যাস_ সবই তাদের হিসেবে থাকে। কিন্তু আমার কাছে তো অপরিচিতের চেয়েও অপরিচিত। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মের মানুষ দেখি। কাউকে কাউকে বাঙালি মনে হয়। কাউকে মনে হয় হয়তো বাঙালি, হয়তো নয়। আলাদা আলাদা জাতের মানুষ দেখার অভিজ্ঞতা তো আগে হয়নি। এখন ভাগ্য ভালো বলতে হবে, এই মানুষ দেখার ভাগ্য। রাজধানী এঙ্প্রেসের টিকিট পাইনি। যেতে হবে এই কালকা মেলে। ট্রেনের এমন নাম কেন? কালকা শব্দের অর্থ কী? জানি না। ভেবে নিয়েছি এটা হবে কোনো জায়গার নাম, দিলি্লর কাছাকাছি। এই ট্রেন ছত্রিশ ঘণ্টায় দিলি্ল পেঁৗছবে, যদি ঠিকমতো পেঁৗছে, নয়তো আরও বেশি সময় লাগতে পারে। তাতে উপরে উপরে ভয় বাড়লেও ভেতরে ভেতরে আনন্দ হয়। একটু বেশিক্ষণ মানুষ তো দেখতে পাব। মানুষ দেখায় আনন্দ আছে, যদি নিজের কাছে সেসব মানুষের কাজকর্ম প্রায় অপরিচিতই ঠেকে। একে বয়স আমার এককুড়িও হয়নি, তাই কোনো কিছুতেই কৌতূহলের অন্ত নেই। যেমন, ট্রেন থেমে আছে। লোকজন মালপত্তরসহ কুলি উঠছে নামছে। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি, একজন মানুষ কলা কিনে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাগর কলা। কিন্তু কলার ছোলা পুরোটাই সবুজ। ভাবি, এমন কাঁচা কলা খায় নাকি। দেখতে দেখতে লক্ষ্য করি লোকটি কলাটা উলটো করে ছোলাটা ছাড়িয়ে নিল। তারপর সেটি ছুড়ে ফেলে কলাটা হাতে ধরে খেতে শুরু করল ওই ধুলোময় রোদ্রতপ্ত প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে। আমার জানালা যেখানে, এই জায়গার প্লাটফর্মে কোনো শেড নেই। লোকটির এমন আচরণে একটু অবাকই হলাম। ভাবলাম, এ লোকটি এমন অদ্ভুতুড়ে, এমনই তার আচরণ। একটু বাদে অন্য একজন চারটে কলা কিনে ছেলে, মেয়ে আর বউকে একটি করে দিল। তারপর তারা প্রত্যেকেই যখন ওইভাবে ছোলা ছাড়িয়ে ফেলে দিয়ে কলাটাকে গলধঃকরণ করল তখন বুঝতে পারলাম সত্যি এক অন্য জগতে এসে পেঁৗছেছি। এটা বিহার। যতই অভিনয় করে সিরাজুদ্দৌলার ভঙ্গিতে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা বলি না কেন, এই ভিন্ন ভূমিতে ভিন্ন ধাতে ও ধাতুকে গড়া এখানকার মানুষ। ফলে নিজের হিসেব মিলিয়ে নিলাম, ভূপ্রকৃতির মতো ধীরে ধীরে আশপাশের মানুষও বদলে গেছে। চারদিকেও তাই। যারা উঠেছে নামছে, তাদেরও যেন আর বাঙালির চেনা গড়নের মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। কথা তো না-ই। তবু প্রায় এক বর্ণ হিন্দি না জেনেও বুঝতে পারছি, এসব কথা হিন্দিও নয়। দেখি হাতের তালুতে একজন কিছু তামাক রেখে ডলছে। ভাবলাম গাঁজা হয়তো। আবার ভাবি, ওই জিনিস যতই চিনি, এমন প্রকাশ্যে খাওয়ার কথা নয়। একটু বাদে দেখি তাতে চুনের মতো কিছু একটা মেশাল লোকটি। অবাক চোখে এই দৃশ্য দেখছি, দেখে পাশের লোকটি, বয়সে আমার চেয়ে বড়, পোশাকে মনে হলো চাকরি করেন, আমার দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছেন। বুঝলাম আমার কৌতূহল বুঝতে পেরেছেন। তখন তালুতে তামাক আর চুন ডলা লোকটি, তালুতে এতক্ষণে দেখতে ছোট্ট কোলবালিশের মতন হয়ে যাওয়া পুঁটলিটা বাম হাতে নিচের ঠোঁট টেনে ডান হাতের দুই আঙুলে সেখানে বসিয়ে দেয়। আমার চোখ আরও বড় হয়ে যায়। বিস্ময়ে পাশের লোকটির কাছে জানতে চাই, 'কী খায়?' পাশের লোকটা বুঝে গেছেন, এ দৃশ্য আমার কাছে একেবারেই অপরিচিত। জানান, 'খইনি'। আমি বলি, 'খইনি'? লোকটা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিছু বলেন না। আমি খইনি খাওয়া লোকটির দিকে দেখি। দেখতে দেখতে বুঝি তার আশপাশে আরও কেউ কেউ একই কাজ করতে শুরু করেছে। এটা খেলে নেশা হয়। সেই খইনিখাওয়া লোকটি একটুক্ষণের জন্য চোখ মোদে। ট্রেনের ঢুলুনিতে হতে পারে। ধীরে ধীরে ট্রেনের গতি কমছে। নতুন স্টেশন আসছে। নতুন মানুষ উঠবে। পাশ থেকে কেউ হয়তো নেমে যাবে। দেখি পাশের লোকটি উঠছে। আমাকে বললেন, 'জায়গা থেকে উঠবেন না। টিটি এলে রিজার্ভেশন বুঝে নেবেন। এখন এমন লোক উঠবে নামবে। সন্ধ্যার পরে কমে যাবে।' বুঝলাম ভুল অনুমান করিনি। তাকে বাঙালি ভেবেছিলাম। সামনের লোকটি কি খাইছে তার উত্তরে খইনি বললে তারপর কথা বলিনি কী বলি কী বলি সেই কথা হাতড়ে। কিন্তু এখন তো আর কথা বলার সুযোগ নেই। তিনি নেমে যাচ্ছেন। বলি, 'আচ্ছা'। শেখালেন, 'কোনো কথা না বুঝলে যে বলছে তাকে ইংরেজিতে বলতে বলবেন।' বললাম, 'আচ্ছা'। তিনি দরজার দিকে যেতেই দেখি আশপাশ বেশ খালি। এরা সবাই লোকাল যাত্রী। নতুন মানুষ উঠবে। সামনের সিটের যাত্রীও কমল। এতক্ষণে বুঝে গেছি এই সিটে কিভাবে তিনজন ঘুমাবে। একজন এই বসে থাকার বেঞ্চিতে, মাঝখানের জন হেলান দেয়ার গদিটা টেনে নিয়ে, আর মাথার উপরের বাংকারে একজন। ওই ভদ্রলোক বলেছেন, টিটির কাছ থেকে আমার শোবার জায়গা কোনটা তা যেন বুঝে নিই। আমি সেই অপেক্ষায় আছি। আমার পাশে এখন আরও দুজন বসেছে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে তাকাতে চোখ ক্লান্ত করে ফেলেছি। দূরে বিকাল ধীরে ধীরে সন্ধ্যায় পেঁৗছুচ্ছে। সে দিকে পুব। পুবে বাংলাদেশ। এসব ভাবতে ভাবতে পায়ের কাছের ব্যাগের সাইড পকেট থেকে আসানসোল স্টেশনে কেনা 'আনন্দলোক' নামের বাংলা সিনেমার কাগজের নতুন সংখ্যা বের করি। পাতা উলটাই। নায়িকাদের ছবি দেখি। শ্রীদেবী। মাধুরী দীক্ষিত। জুহি চাওলা। স্টেশনের টিভিতে এক দো তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট নয় দশ এগারা বারা তেরা... এমন একটা গান শুনেছি। সে গানের কিছু বুঝিনি। তবে একটার পর একটা সংখ্যা বলে বলে এই বিখ্যাত নায়িকা মাধুরী দীক্ষিত নাচতে নাচতে গানের সঙ্গে যে আশপাশের চোখগুলোকে অধরা মাধুরী বিলিয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পেরেছি। হিন্দি ছবি সম্পর্কে জানি না তো প্রায় কিছুই, এই কাগজ পড়ে যদি কোনো জ্ঞান লাভ হয়। এর নায়কদের ভেতরে ভালো চিনি একমাত্র মিঠুন চক্রবর্তীকে। তার বাংলা ছবি 'অবিচার' বাগেরহাটের সিনেমা হলে কয়েকবার দেখেছি। যদিও কলকাতায় এসে শুনেছি সে ছবির অন্য নাম, 'অন্যায় অবিচার'। তারও নাকি হিন্দি ভার্সন আছে। 'আনন্দলোকে'র পাতা উল্টে আনন্দলোকে প্রবেশের চেষ্টা করি। সামনের বাঁ পাশে চোখ দিলে এক একজনকে হঠাৎ হঠাৎ হাতের তালুতে খইনি থাবাতে দেখি। পত্রিকার পাতায় চোখ দিলে ওই শব্দ কানে আসে। দেখার আর শোনার ভেতরে আনন্দলোকে যাত্রা! হঠাৎ খেয়াল করি আমার পাশের দুজনও আমার সঙ্গে 'আনন্দলোকে'র পৃষ্ঠায় চোখ রাখছে। ভাবলাম, বাঙালি হয়তো। কিন্তু তারা নিজেদের ভেতরে যে ভাষায় কথা বলছে, তাতে এই ধারণা নিজের কাছে ভুলই মনে হচ্ছে। একবার আমার দুহাতের মাঝখানে চোখ দেয়, আবার নিজেদের ভেতরে কথা বলে। একটু বাদে একটি পৃষ্ঠায় আমারই চোখ আটকে যায়। সেখানে দুই পৃষ্ঠাব্যাপী বিজ্ঞাপন। বামের পৃষ্ঠায় ছোট ছোট আয়তাকার পৃষ্ঠা-আকৃতির আনন্দলোকের প্রচ্ছদ। সেখানে অমিতাভ বচ্চন, বিনোদ খান্না আর মিঠুন চক্রবর্তীর মুখ, পাশেই শ্রীদেবী, মাধুরী দীক্ষিত আর জুহি চাওলা। এই মুখগুলোই বড় করে পুরো ডানের পৃষ্ঠাব্যাপী আরেকটি প্রচ্ছদ। তাকালে মনে হচ্ছে কোনো ছবির বিজ্ঞাপন। ছবির বিজ্ঞাপনের পোস্টার আসলে এমনই হয়। উপরে লেখা 'আসিতেছে আনন্দলোক'। আর পৃষ্ঠার নিচে একসারিতে কয়েকজন লেখকের নাম। 'দেশ' পত্রিকায় এমন বিজ্ঞাপন দেখেছি। 'আনন্দলোকের' না দেখলেও 'দেশ' বা 'আনন্দবাজার পত্রিকা'র পুজো সংখ্যার এমন বিজ্ঞাপনে এভাবে সারি দিয়ে লেখকদের নাম থাকে। ফলে আমি বুঝে নিয়েছি এটা 'আনন্দলোক' পুজো সংখ্যার বিজ্ঞাপন। সেই সংখ্যার এক কল্পিত প্রচ্ছদে এমন বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই বোঝাবুঝিতে ভিনভাষী প্রায় আমারই বয়সী পাশের দুজনের বোঝাবুঝি মিলবে কেন? আমার কাছ থেকে পত্রিকা নিয়ে ওই পৃষ্ঠা তারা বারবার দেখে। নিজেদের ভেতর কি সব বলে। নায়কনায়িকার নাম শুনে বুঝি এই নিয়েই আলোচনা করছে তারা। তারপর সব জড়তা পাশে সরিয়ে পাশের জন আমার কাছে জানতে চায়, 'উপরে কী লেখা?' তার কথা প্রায় বুঝিই না, কিন্তু অনুমান করতে পারি। সে 'আনন্দলোক' লোগোটার উপরে হাত রাখে। আমিও, প্রথমে আসিতেছের উপর আঙুল রেখে বলি আসিতেছে। তারপর 'আনন্দলোকে'র ওপর রেখে বলি, 'আনন্দলোক'। তখন পাশের জন তার পাশের জনকে বলে, 'আন্ন্দলোখ্'। তারপর নিজেদের কথা। বুঝতে পারি, তারা বলছে, এই নামে, এই 'আন্ন্দলোখ্' নামে অমিতাভ-বিনোদ-মিঠুন আর শ্রীদেবী-মাধুরী-জুহির এক মেগা ছবি আসছে। তারা চোখের সামনে পৃষ্ঠা দুটো মেলে ধরে থাকে। আর বলে, 'আন্ন্দলোখ্'। চোখ হাসে তাদের। বুঝি, ছবিটি তারা দেখবে। আমি তাদের উচ্চারণ শুনে হাসি। মনোভাব বুঝেও মনে মনে হাসি। একবার বিড়বিড় করি : 'আসিতেছে আন্ন্দলোখ্!' জানি না, তারা সেই ছবির শুভ মুক্তির অপেক্ষায় কতদিন অপেক্ষা করেছে!

সর্বশেষ খবর