শুক্রবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৩ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্রে নজরুল ও তার একটি কবিতা

অনুপম হায়াৎ

চলচ্চিত্রে নজরুল ও তার একটি কবিতা

আলোকচিত্র এবং চলচ্চিত্রের প্রতি কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) ছিল প্রবল আকর্ষণ। তবে অবশ্যই তা সংশ্লিষ্ট ছিল তার সজ্ঞান অবস্থায়।

২০ শতকের আলোড়িত বিলোড়িত এবং শক্তিশালী গণমাধ্যম চলচ্চিত্র নজরুলকে প্রভাবিত করেছিল নানাভাবে। তিনি চলচ্চিত্রে জড়িত হয়েছিলেন প্রত্যক্ষভাবে চিত্রপরিচালক, গীতিকার, সুরকার, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা, সংগীতকার, গায়ক ও সংগঠক হিসেবে।

১৯৩১ সালে মুম্বাই ও কলকাতায় সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়। মুম্বাইয়ে নির্মিত হয় উপমহাদেশের প্রথম সবাক কাহিনীচিত্র 'আলম আরা' ও কলকাতায় নির্মিত হয় প্রথম সবাক বাংলা কাহিনীচিত্র 'জামাই ষষ্ঠী।' ওই বছরই কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতার প্রখ্যাত চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান ম্যাডান থিয়েটার্সের সুরভাণ্ডারী নিযুক্ত হন। তার দায়িত্ব ছিল সবাকচিত্রে অভিনয়কারী শিল্পীদের কণ্ঠ ব্রাশ-আপ করে দেওয়া। ওই সময় কথা, শব্দ, গান, সুর ও সংগীতে উপমহাদেশের চলচ্চিত্র জগৎ মুখর হয়ে ওঠে। নজরুল সবাকপর্বের এই যন্ত্রবিপ্লবের মাহেন্দ্রক্ষণের অংশীদার হন। ম্যাডান থিয়েটার ছাড়াও তিনি জড়িত হন নিউ থিয়েটার, পাইওনিয়ার ফিল্মস, কালী ফিল্মস, দেবদত্ত ফিল্মস, ফজলী ব্রাদার্স প্রযোজিত বিভিন্ন চলচ্চিত্রের সঙ্গে। চলচ্চিত্রে তিনি অবতীর্ণ হন বিভিন্ন ভূমিকায়।

নজরুল সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে_ 'নারী-আবৃত্তি' (১৯৩১), 'প্রহ্লাদ-গান ও সুর' (১৯৩২), বিষ্ণুমায়া- গান ও সুর (১০৩২), 'ধ্রুব-যুগ্ম' পরিচালনা, সংগীত পরিচালনা, গান, সুর ও অভিনয় (১৯৩৪); পাতালপুরী- সংগীত পরিচালনা, গান, সুর ও অভিনয় (১৯৩৫); গ্রহের ফের-সংগীত পরিচালনা (১৯৩৬); 'হালবাংলা'-অভিনয় (১৯৩৮); 'সাপুড়ে'- (বাংলা ও হিন্দি) কাহিনী, গান ও সুর (১৯৩৯); নন্দিনী-গান ও সুর (১৯৪১); 'চৌরঙ্গী'-(বাংলা ও হিন্দি) সংগীত পরিচালনা, গান ও সুর (১৯৪২)। এ ছাড়া তিনি ১৯৪১-৪২ সালে শেরে বাংলার 'বেঙ্গল টাইগার' পিকচার নামে বাঙালি মুসলমানদের জন্য চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন এবং 'মদিনা' নামে একটি ছবির কাহিনী, গান, সুর ও চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন। নজরুলের অসুস্থতার কারণে এসবের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় ১৯৪২ সালেই।

২. কাজী নজরুল ইসলাম যেমন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়ে চলচ্চিত্র জগৎকে প্রভাবিত করেছিলেন, তেমনি তার কিছু কবিতা এবং গানেও রয়েছে চলচ্চিত্রের প্রভাব। বিভিন্ন সূত্র থেকে এ প্রভাব সম্পর্কে জানা যায়। নজরুলের লেখা চিঠিতে পাওয়া যায় তার চলচ্চিত্র দেখা প্রসঙ্গ, অন্যের স্মৃতিকথায় পাওয়া যায় গান রচনার উৎস, তার লেখা কবিতায় পাওয়া যায় সেকেলের জনপ্রিয় চিত্রতারকা ও চলচ্চিত্রের নানা দর্শক প্রতিক্রিয়ার কথা।

নজরুল ১৯২৮ সালের মার্চ মাসে কাজী মোতাহার হোসেনের কাছে লেখা এক চিঠিতে 'দেবদাস' চলচ্চিত্র দেখার কথা জানিয়েছিলেন। 'দেবদাস' ছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখিত সেকালের তরুণ- তরুণীদের অতি প্রিয় উপন্যাস। ওই উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ করেন নরেশ মিত্র। ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি দেবদাস মুক্তি পায়। নির্বাক দেবদাস দেখার জন্য নজরুলের মধ্যেও আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল নিশ্চয়ই। সে কারণেই নজরুল দেবদাস দেখার তথ্যটি তার প্রিয় বন্ধু কাজী মোতাহারকে জানাতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। নজরুলের সজ্ঞান অবস্থায় সবাকপর্বে আবার দেবদাস নির্মিত হয় ১৯৩৫ সালে প্রমথেশ বড়ুয়ার পরিচালনায়। তখন তিনি সবাক দেবদাস দেখেছিলেন কিনা তা অবশ্য জানা যায়নি।

'দূর দ্বীপবাসিনী চিনি তোমারে চিনি'

নিতাই ঘটকের স্মৃতি থেকে জানা যায়, ১৯৩০-এর দশকে কাজী নজরুল ইসলাম সেকালের বিখ্যাত ইংরেজি চিত্র 'পেগান লাব সং' দেখতে গিয়ে এর নায়ক র্যামন নোভারোর কণ্ঠে 'কাম টু মি হোয়ার দি মুনস বিমস' গান শুনে মুগ্ধ হন এবং বাড়ি ফেরার পথেই মুখে মুখে তিনি রচনা করেন সেই বিখ্যাত গান 'দূর দ্বীপবাসিনী চিনি তোমারে চিনি'র প্রথম পর্ব।

১৯৩২ সালে কলকাতার নয়টি বাংলা, আটটি হিন্দি ও সাতটি উর্দু চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এর মধ্যে একটি ছিল প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত। এই চলচ্চিত্রের প্রথম প্রদর্শনী হয় কলকাতার রূপবাণী প্রেক্ষাগ্রহে, ১৯৩২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। এ উপলক্ষে নজরুল একটি কবিতা লিখেছিলেন বলে রবি বসু সূত্রে জানা যায়। উল্লেখ্য, সপ্তাহখানেক আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেক্ষাগৃহটি উদ্বোধন করেছিলেন, এর 'রূপবাণী' নামটিও রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। তিনিও এ উপলক্ষে 'রূপবাণী' নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। কিন্তু নজরুলের কবিতাটির কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না।

মোর না মিটিতে আশা

'মোর না মিটিতে আশা ভাঙ্গিল খেলা' নজরুলের একটি বিখ্যাত গান। গানটি রচনার পেছনে রয়েছে সেকালের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা ও গায়িকা শান্তা আপ্তের আশাভঙ্গের বেদনার ঘটনা। মারাঠি নায়িকা শান্তা আপ্তে কলকাতায় এসেছিলেন অভিনয়ের জন্য। কিন্তু চিত্রনির্মতাদের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি অভিনয় না করেই ফিরে যাচ্ছিলেন। খবর পান এইচএমভির কর্মকর্তা হেম সোম। তিনি শান্তার সঙ্গে দেখা করে তাকে বাংলা গান গাইতে অনুরোধ করেন। বিষয়টি হেম সোম নজরুলকে জানান এবং শান্তা আপ্তের আশাভঙ্গের মানসিক অবস্থা নিয়ে গান লেখার কথা বলেন। নজরুল সেই অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে রচনা করেন_ 'মোর না মিটিতে আশা ভাঙ্গিল খেলা'। গানটি শান্তা আপ্তের কণ্ঠে রেকর্ড করা হয়, যার নম্বর এইচএমভি-এন ২৭১২, এপ্রিল, ১৯৪১।

এখানে আপ্তে সম্পর্কে আলোকপাত করা যায়। তিনি নয় বছর বয়সে অভিনয় শুরু করেন। ১৬ বছর বয়সে ১৯৩২ সালে তিনি 'শ্যামসুন্দর' নামে ছবিতে অভিনয় করেন। তার গানের গলা ছিল অপূর্ব। রূপে-গুণে ঋদ্ধ এই নায়িকা-গায়িকার অন্যান্য ছবির মধ্যে রয়েছে_ 'অমৃত মন্থন', 'রাজপুত রমণী', 'অমরজ্যোতি', 'দুনিয়া না মানে', 'সাবিত্রী', 'মোহব্বত' প্রভৃতি। তিনি একটি চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনাও করেছিলেন। চলচ্চিত্রকর্মীদের বিভিন্ন দাবি আদায়ের ব্যাপারেও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি।

ট্রেড শো : একটি কবিতা

নজরুল 'রূপবাণী' প্রেক্ষাগৃহে একটি নতুন চলচ্চিত্রের প্রথম প্রদর্শনী 'ট্রেড শো' দেখতে গিয়েছিলেন। পরে তিনি 'ট্রেড শো' নামে ৩৭ লাইনের একটি কবিতা লেখেন। কবিতাটি পরে নজরুল রচনাবলির পঞ্চম খণ্ডভুক্ত হয়। এই কবিতায় কবি রবীন্দ্রনাথ, রাজনীতিবিদ গান্ধী, নেতাজী সুভাস বসু, জহরলালের নামের সঙ্গে সেকালের বিখ্যাত চিত্রতারকা পাহাড়ি স্যানাল, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, কে এল সায়গল, প্রমথেশ বড়ুয়া, অশোক কুমার, সংগীতকার পংকজ মলি্লক, পরিচালক দেবক্ষী কুমার বসু, চলচ্চিত্রকার ভাগ্যচক্র (১৯৩৫), অচ্ছুৎ কন্যা (১৯৩৫), চিত্র প্রতিষ্ঠান এনটি (নিউ থিয়েটার্স), দর্শকদের ওপর চিত্রতারকাদের প্রভাব, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সেকালের জনপ্রিয় হিন্দি গান 'বন কি চিড়িয়া'র প্রসঙ্গ রয়েছে। 'বন কি চিড়িয়া' গানটি ফ্রেন্জ অস্টেন পরিচালিত 'অচ্ছুৎ কন্যা' ছবির। বম্বে টকিজ প্রযোজিত অশোক কুমার এবং দেবিকা রানী অভিনীত এ ছবির সংগীত পরিচালনা করেন পার্শিসম্প্রদায়ভুক্ত খুরশিদ মিনোচের হোম। কিন্তু ধর্মীয় রক্ষণশীলদের আক্রমণের আশঙ্কায় তিনি তার প্রকৃত নাম ব্যবহার করেননি, ছদ্মনাম গ্রহণ করেন সরস্বতী দেবী। চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম ভারতীয় মহিলা সংগীত পরিচালক। কবিতাটিতে নজরুল 'বাণীচিত্র' অর্থাৎ চলচ্চিত্রকে 'মরীচিকা মায়া' হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি। কবিতাটি এখানে তুলে ধরা হলো।

 

ট্রেড শো

'ট্রেড শো' দেখিতে গেছিনু সেদিন সকালে রূপবাণীতে

সাত শ' তরুণ 'সরুন সরুন' চিৎকারি' চারিভিতে

হুটাপুটি করে লুটাপুটি খেয়ে ছুটাছুটি করে সবে;

একটেরে রহি চাহি'_ মহাত্দা গান্ধী কি এল তবে?

 

এল রবীন্দ্রনাথ কি, এল কি সুভাষ, জহরলাল?

গুঁতোগুঁতি করে সাত শ' তরুণ

জুতি ধুতি ছেঁড়া অতি সকরুণ

খুন চ'ড়ে গিয়ে নয়ন অরুণ যেন মদ-মাতোয়াল।

এল কি সুভাষ, এল কি জহরলাল?

 

কোথায় সুভাষ। সুবাস ছড়ায়ে আসে ছায়ানট-নটী

হীরা জহরৎ শাড়ি প'রে লাল বেগুনী ও বরবটি,

হিন্দু-মুসলমানের এমন মিলন দেখিনি আর,

বিড়িওলা আর অফিসের বাবু হ'য়ে গেছে একাকার।

টিকিতে দাঁড়িতে জড়াজড়ি হয়, ছড়াছড়ি পান-বিড়ি,

কোট-প্যান্ট-লুঙ্গি-ধুতি ঠাসাঠাসি সারা ফুটপাত সিঁড়ি।

 

কেহ বলে, 'খ্যাঁদা দ্যাখ্ দ্যাখ্ ওই অনুরাধা টিপ-পরা;

ওই যে কি বলে, উনি এন-টি-র নয়াতারা আন্কোরা।

ভাগ্যচক্র শাড়ি বিজড়িত ওই যে অমুক দেবী_

অ্যালবামে রাখি' উহারি প্রতিমা আমি দিবানিশি সেবি।'

কর্দম-অনুলিপ্ত ভূষণ ভিড় চাপে ঘামে চুবা

অভিনয়-হিরো-মার্কা পিরান-পরা কয়জন যুবা

বলে, 'ওই ওই পাহাড়ি, দুর্গাদাস, সাইগল ওই,

ওই পঙ্কজ, অমর বড়ুয়া_ দেবকীকুমার কই?'

কেহ বলে, 'বীতশোক হইয়াছি অশোককুমারে দেখে,

মনে হয় যাই দূর বোম্বাই অঙ্গে ভস্ম মেখে।"

'বন্কি চিড়িয়া' কোরাসে গাহিয়া একদল যুবা কহে,

হায় রে বিংশ-শতাব্দী, হায় বাঙালীর যৌবন।

নিপট কপট ছায়াপট প্রেম পড়িয়াছে জনগণ।

বলতে পার কি দাদা অচ্ছুৎ কন্যা কোথায় রহে?

বাণীচিত্রে যা ফুটে ওঠে তা কি এই জীবনের ছায়া?

এই বিকৃতি-কাগজের ফুল এই মরীচিকা মায়া?

পর্দায় দেখি যে সব পুরুষ নারী মোরা দিবানিশি

বলিতে পার কি চিনিতে পার কি এরা সব কোন দেশি?

 

ইহাদের বলা, ইহাদের চলা, ইহাদের হাবভাব

দেখেছ কি কেহ- দেখেছ ফলেছে ওক-গাছে যেন ডাব।

পাইন-শাখায় ওল ঝুলিতেছে, আমগাছে পিচ ঝুলে,

ট্যাস্ ফিরিঙ্গি বাজাইবে বাঁশি কবে যমুনার কূলে?

 

 

সর্বশেষ খবর