শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা

বাঘিনী

শাহনেওয়াজ বিপ্লব

বাঘিনী

শফি ভাই বললেন, বাঘ মারা এমন কিছু হাতি-ঘোড়া নয়। খুব সোজা। কেবল হাতের তাগ থাকা চাই, আর ঠিক জায়গায় বাঘকে জখম করতে জানা দরকার।

আলোচনা চলছিল কাপ্তাইয়ের এক চায়ের দোকানে। একটা নড়বড়ে টেবিল ঘিরে আমরা চারজন। দুটো বেঞ্চে আমি, খোকন, মানিক আর শফি ভাই।

চাটগাঁ শহর ছেড়ে আমরা কাপ্তাই কেন গেলাম, সে কথাটাই শুনুন তবে আগে।

আমরা তিনজন। মানে আমি, খোকন আর মানিক একই বছরে ম্যাট্রিক পাস করি। তারপর ঢুকি কম্পিউটার শেখার স্কুলে। কম্পিউটারের কী-বোর্ড টিপতে টিপতে ভাবতাম, আর বছর দুই। তারপর আমাদের নিয়ে অফিসে অফিসে কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে। তার ওপর আমি আর মানিক আবার ফুটবল খেলতে পারি।

তখন স্বপ্নেও ভাবিনি, আমাদের অবস্থা ফুটবলের মতোই হবে। এক অফিস থেকে গড়িয়ে দেবে আরেক অফিসের দরজায়। একটানা আড়াই বছর এ খেলা চলল। দরখাস্ত পাঠানো আর নো-ভ্যাকেন্সির বোর্ডে মাথা ঠুকতে ঠুকতে কেবল বাড়ি ফিরে আসা। দুই-একবার অবশ্য ডাক পেয়েছিলাম কিন্তু ইন্টারভিউর বেড়ার ওপারে আর পেঁৗছতে পারলাম না। মারাত্দক সব প্রশ্নের খোঁচায় চোখে সরষে ফুল দেখার অবস্থা।

টেঙ্টাইল মিলের চাকরি কিন্তু প্রশ্ন করল, ইলেকট্রিসিটির আবিষ্কর্তা কে? মানিক বলল, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। খোকন বলল, গ্যালিলিও।

আমাকে অবশ্য আরও প্যাঁচে পড়তে হয়েছিল। বেসরকারি এক স্কুলের ইন্টারভিউতে এক অধ্যক্ষ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এডিশন কিসের জন্য বিখ্যাত! উত্তরটা জানা ছিল। বললাম, এডিশন না এলে সাবস্ট্রাকশন, ডিভিশন কিছুই আসত না। পৃথিবীর বহু সমস্যার সমাধানই হতো না। অধ্যক্ষ সাহেব ঢক-ঢক করে দুই গ্লাস পানি খেলেন, তারপর দপ্তরিকে বললেন, প্লিজ টেক হিম আউট অব মাই সাইট।

কিন্তু তিনজনই খেপে গেলাম। বিশেষ করে খোকন। দুপুরবেলায় স্কুলমাঠের বটতলায় তিনজনে বসলাম। খোকন বলল, চাকরি খোঁজা আর নয়। চাকরি মানেই দাসত্ব। বরং মাছের ব্যবসা করব। লক্ষ্মীর বাস বাণিজ্যে।

আমরা একটু ইতস্তত করলাম। চাটগাঁ শহরে খোকনের বাপের একটা বাড়ি আছে, টাকা-পয়সাও আছে বেশ। কিন্তু আমার আর মানিকের পারিবারিক অবস্থা খোকনের মতো অত সুবিধার ছিল না। ব্যবসা দরখাস্ত পাঠিয়ে হয় না, তার জন্য মূলধন দরকার।

খোকন বলল, যে যা পারবি নিয়ে আয়। আমি মোটা টাকা দেব। যে যেমন টাকা দেবে তার তেমনি বখরা। কাপ্তাই থেকে মাছ কিনে চট্টগ্রাম শহরে রিয়াজউদ্দিন বাজারে পাঠাব। দুদিনে একেবারে লাল।

আমাদের দুজনের ভেতর আমি আংটি বাঁধা দিয়ে সামান্য কিছু নিয়ে এলাম। আর মানিক তার মায়ের গলার হারটাও নিয়ে এসেছিল। একবার ব্যবসা জমে উঠলে তার মাকে আরও বড় একটা হার বানিয়ে দেবে, সেটাই তার মাকে বুঝিয়ে এসেছে।

কাপ্তাই পেঁৗছলাম। তখন সমস্যা হলো একজন মুরবি্ব জোগাড় করতে হবে। পাকা লোক। ব্যবসার ফন্দিফিকির যার নখদর্পণে।

দুই-একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই নামটা পাওয়া গেল। শফি ভাই। সবজান্তা লোক। গানে, বাজনায়, শিকারে, ব্যবসা, বুদ্ধিতে একেবারে অদ্বিতীয়। বহুদিনের বাসিন্দা। কাপ্তাইয়ের নাড়িনক্ষত্র হাতের মুঠোয়।

খোকন খুশি হলো। বলল, এরকম লোকই আমাদের দরকার।

-তার ঠিকানাটি কি?

-ঠিকানায় তাকে পাবেন না। বরং রুবেলের চায়ের দোকানে খোঁজ করুন। কর্ণফুলী নদীর ধারে।

সেখানে রুবেলের চায়ের দোকান মিলল। শফি ভাইকেও। হাত মুখ নেড়ে রুবেলকে চা তৈরি করার কায়দা শেখাচ্ছেন।

আলাপ হলো। ব্যবসার কথা শফি ভাই মন দিয়ে শুনলেন। তারপর খোকনের পিঠ চাপড়ে বললেন, ঠিক আছে ভাই। এজন্য ভাবতে হবে না। কাপ্তাইয়ে মাছের সবচেয়ে বড় আড়তদার ইলিয়াস লস্করের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। তার আগে দিন কয়েকটা বাজার দেখ। মাছের দর, বিলি ব্যবস্থা, পাইকারদের কায়দা-কানুন।

সেই ক'দিন ধরে আমরা রুবেলের দোকানে এসে আড্ডা দিচ্ছি। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি আর শফি ভাইয়ের কাছে গল্প শুনছি। ফাঁকে ফাঁকে পাইকারদের সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দিচ্ছেন। এত রকম মাছ যে পৃথিবীতে আছে এখানে আসার আগে জানাই ছিল না।

একদিন এ কথা সে কথায় শিকারের কথা উঠল। পাখি শিকার।

শফি ভাই হাসলেন। অবজ্ঞার হাসি। বললেন, পাখি শিকার যদি হয়, তাহলে মশা, মাছি শিকারও হয়। দুটো একই ব্যাপার। কিন্তু শিকার বলতে আমি বাঘ, সিংহ শিকারই বুঝি। তা এ পোড়া দেশে তো আর সিংহ শিকারের সুযোগ নেই। বাঘ অবশ্য এখনো কিছু আছে। শিকার করেও সুখ।

বাঘ শিকারের প্রসঙ্গেই শফি ভাই বললেন, বাঘ শিকার শক্ত কিছু নয়, যদি কায়দাটা জানা থাকে। রাতের বেলা বাঘের দুটো চোখ জ্বলে। টর্চের সবুজ বাল্বের মতন। গুলি চালাতে হয় ঠিক তার মাঝখানটায়। ব্যস, আর দেখতে হবে না। যত বড় জাঁদরেল বাঘই হোক, মৃত্যু তাকে বরণ করতেই হবে। তবে একটু এদিক-ওদিক হলেই সর্বনাশ। বাঘ ঘায়েল হবে কিন্তু মরবে না। আহত বাঘের চেয়ে ভয়ঙ্কর জানোয়ার আর দুনিয়ায় নেই। সে বাঘ, তোমার জান নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করবেই।

-আপনি জীবনে কটা বাঘ মেরেছেন শফি ভাই? প্রশ্নটা আমিই করলাম।

শফি ভাই অমায়িক হাসলেন। এ কি আর গুণে বলা যায় ভাই, না কোনোদিন গুনেছি।

-বাঘের চামড়াগুলো বাড়িতে রাখেননি?

শফি ভাই ঘাড় নাড়লেন। না, ওতে বরং অহংকার বাড়ে।

বাঘ মারা আমার নেশা। ওইটুকুই করি। তারপর মরা বাঘটা জন্তু-জানোয়ারের হাড্ডি দিয়ে যারা ওষুধ বানায়, তাদের দিয়ে দিই।

দোকানী রুবেল সচরাচর কথা বলে না। কথা শোনে। সেদিন কিন্তু বলল, আচ্ছা শফি ভাই, সেবার যে এক সাহেব এলো ঢাকা থেকে বাঘ শিকার করতে। আপনাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য অত খোঁজাখুঁজি করল, কোথায় ঘাপটি মেরে ছিলেন, বলুন তো?

শফি ভাই চটলেন। কার ধার করে খেয়েছি যে, ঘাপটি মেরে থাকব? কথাটা বলেই সংশোধন করে নিলেন, অবশ্য তোর কাছে ছাড়া। তারপর আমাদের দিকে ফিরে নাক-কান মলে বললেন, সেই ব্যাপার থেকে নাক-কান মলেছি ভাই, সাহেব নিয়ে আর শিকারে যাব না।

-কি রকম? কি ব্যাপার? শ্রোতারা চঞ্চল হয়ে উঠল।

শফি ভাই রুবেলের দিকে চেয়ে বললেন, এক কাপ চা, একটা ডবল ডিমের পোচ। খরচটা অবশ্য চিটাগং ফিশিং করপোরেশনের। অর্থাৎ আমাদের। চা এলো, সঙ্গে ডবল ডিমের পোচ।

শফি ভাই শুরু করলেন। শরীফ সাহেব, শুনলাম সিলেটের খুব বিখ্যাত শিকারি। বাঘ মারতে চট্টগ্রাম এলেন। খুঁজে বের করলেন আমাকে। তিনি জানেন, কাপ্তাইয়ের প্রত্যেকটি বাঘের ঠিকানা আমার মুখস্থ।

রাজি হলাম, তখন কি জানি, শরীফ সাহেব জীবনে বাঘের ডাকও শোনেননি।

মাচা বাঁধা হলো। একটু দূরে একটা মরা ছাগল ফেলে রাখা হলো গাছের নিচে। আমি আর শরীফ সাহেব উঠলাম মাচায়। বন্দুক বাগিয়ে বসলাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল। বাঘ আর আসে না। শরীফ সাহেব তো মহা খাপ্পা। শক্ত শক্ত ইংরেজিতে আমাকে গাল দিতে শুরু করলেন। আমি চুপচাপ। একটি কথাও বললাম না। বাঘ শিকারে উত্তেজিত হলেই সর্বনাশ।

ভোর তিনটা নাগাদ বাঘ এলো। এত বাঘ শিকার করেছি কিন্তু এমন প্রকাণ্ড বাঘ আমি এর আগে দেখিনি। কাঁচা সোনার বর্ণ, অন্ধকারেও বন যেন আলো করে রয়েছে। গায়ে কালো কালো ডোরা। লাল টকটকে জিভটা দাঁতের ফাঁক দিয়ে ঝুলছে। ছাগলটাকে একবার শুঁকেই মুখ ফেরাল। বোঝা গেল বুড়ো বাঘ। বয়সকালে সাবধানী হয়েছে। পচা, বাসি মাংস মুখে তোলে না।

ছাগলের দিক থেকে মুখ ফেরাতেই আমরা বাঘের নজরে পড়ে গেলাম। আমি আর শরীফ সাহেব। তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে বাঘটির কী প্রচণ্ড চিৎকার! ইউরেকা জাতীয়। মাচাটা থরথর করে কেঁপে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ডালপালা আর পাতা। তাক করতে করতেই আড়চোখে চেয়ে দেখলাম শরীফ সাহেব থরথর করে কাঁপছেন।

নিচে বাঘটা গোঁ গোঁ করছে, ওপরে শরীফ সাহেব। এই দুরকম গোঁ গোঁর মধ্যে আমার অবস্থাটা বোঝ। সমানে তাক করে চলেছি। হিসাব করে দুই চোখের মধ্যের জায়গাটা।

বাঘটা লাফিয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে ট্রিগার টিপলাম। দ্রুম। বাঘটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। বাঘটা লাফিয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গেই ভয়ে হাত-পা ছেড়ে নিচে গড়িয়ে পড়েছিলেন শরীফ সাহেব। তারপর এক কাঁধে বাঘ আর অন্য কাঁধে শরীফ সাহেবকে নিয়ে ভোরবেলা বন থেকে বের হলাম। সেই থেকে প্রতিজ্ঞা করেছি, কোনো সাহেব নিয়ে আর শিকারে যাচ্ছি না।

-আচ্ছা শফি ভাই, এ পর্যন্ত আপনার শিকার ফসকায়নি কোনোদিন, তাই নয়? একেবারে বেকুবের মতো প্রশ্ন করে বসল মানিক।

আমরা রীতিমত শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। মানিকের এহেন অর্বাচীন প্রশ্নে শফি ভাই হয়তো ফেটে পড়বেন। কিন্তু আশ্চর্য শফি ভাই সেরকম কিছুই করলেন না। কেবল ডান হাতের একটা আঙ্গুল উঁচু করে দেখিয়ে বললেন, একবার।

-একবার? কোথায়? কাপ্তাইয়ে?

-হ্যাঁ, এই কাপ্তাইয়েই, জীবনে এই একবার।

আমরা ঘন হয়ে বসলাম। বিচিত্র এক কাহিনী শোনার আশায়।

ওই রকম গাছে মাচা বেঁধে বসে আছি। একদিন, দুদিন। শিকারের দেখা নেই। মনে মনে ভাবলাম, সেনাবাহিনী ক্যাম্প করতে গিয়ে বাঘের বংশ নাশ করে গেছেন সম্ভবত। ঠিক সে সময় বিকট গর্জন করে একেবারে মাচার নিচে এসে দাঁড়াল বাঘ নয়, বাঘিনী। দুটো চোখ জ্বলছে দপদপ করে। আমি হামাগুড়ি দিয়ে বসে লক্ষ্য ঠিক করলাম। দুটো জ্বলন্ত অগি্নপিণ্ডের মধ্যস্থল, মানে ঠিক দুই চোখের মাঝে। সহজ, সরল হিসাব।

গুলি ছুড়লাম। লাগলও ঠিক। কিন্তু আশ্চর্য বাঘ কোথায় মাটিতে লুটিয়ে পড়বে, তা নয়। একবার আর্তনাদ করে তীরবেগে জঙ্গলে ছুটে পালাল। আমি হতভম্বের মতো রাতটা মাচায় কাটিয়ে সকালে ফিরে এলাম।

_এটা কি করে হলো, শফি ভাই? আমরা একযোগে বিস্ময় প্রকাশ করলাম। আপনার তাগ তো ভুল হওয়ার নয়।

শফি ভাই হাসলেন। হিসাবে একটু গোলমাল হয়েছিল। সেই বাঘিনী ধরা পড়ল আড়াই বছর পর। মাথার ঘা ভীষণ বেড়েছে। ব্রেনের গোলমাল শুরু হয়েছে। আপনপর জ্ঞান লোপ পেয়েছে। তাই জঙ্গল ছেড়ে বাঘিনী ধুঁকতে ধুঁকতে লোকালয়ে এসে হাজির। সেই সময় গোলমালটা ধরা পড়ল।

-কিসের গোলমাল?

-ওই হিসাবের।

-ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমরা অবাক চোখে শফি ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইলাম।

বাঘিনীটা ট্যারা। সে জন্যই দুচোখের মাঝখানের হিসাবটায় একটু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। নয়তো আমার লক্ষ্য ফসকাবার নয়।

শফি ভাই চায়ের কাপ নিঃশেষ করে সবার দিকে চেয়ে একটু মুচকি হাসলেন।

 

চিটাগং ফিশিং করপোরেশন পাল গোটাল। খোকনই উদ্যোক্তা, সেই পিছিয়ে গেল। বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। বাড়ির অবস্থা ভালো। কাজেই চাকরি না হলেও পাত্রী জুটে গেল।

খোকন বলল, এ ব্যবসায় থাকা চলবে না। শ্বশুরবাড়ির লোকজন জানতে পারলে বিয়েবাড়িতে খ্যাপাবে।

আমাদের বলবার কিছু ছিল না। যা সম্বল ছিল, সব পাইকারদের হাতে তুলে দিয়েছি। রুবেলের দোকানেও দিয়েছি কম নয়।

ঠিক হলো, যাওয়ার আগে শফি ভাইয়ের সঙ্গে একবার দেখা করে যাব।

চায়ের দোকানে দেখা মিলল। সব শুনে তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন, তোমাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালোই লেগেছিল। তা ব্যবসা না কর, এসো মাঝে মাঝে। বেড়ানোর জন্যও কাপ্তাই খারাপ জায়গা নয়।

রুবেল মাঝখান থেকে গণ্ডগোল করল। বলল, একটা কাজ করুন শফি ভাই। শেষ দিনটা আর দোকানের চা খাবেন না, এদের নিয়ে যান আপনার বাড়ি। একটা ফেয়ারওয়েল পার্টি হোক।

মনে হলো শফি ভাইয়ের মুখে যেন ক্ষণিকের জন্য একটা ম্লান ছায়া দেখা গেল কিন্তু তিনি সামলে নিলেন। আমতা, আমতা করে বললেন, বেশ তো, চল না তোমরা। এ আর বেশি কথা কী? তোমাদের ভাবী চা টা বেশ ভালোই বানায়।

আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালাম।

কর্ণফুলী নদীর পাড় দিয়েই রাস্তা। কিছুটা গিয়েই টিনের চালা দেখা গেল।

আমাদের দিকে ফিরে শফি ভাই বললেন, তোমরা আস্তে আস্তে এসো ভাই। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে গিনি্নকে খবর দিই।

শফি ভাই এগোলেন। আমরা গতি কিছুটা মন্থর করলাম।

মিনিট পনেরো কাটল। শফি ভাইয়ের দেখা নেই। খোকনই বলল, কি ব্যাপার? শফি ভাই বিরাট আয়োজন করছেন না কি? এত দেরি।

কথার সঙ্গে খোকন পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। আমরা পিছন পিছন।

বেশিদূর যেতে হলো না। বজ্র কঠোর কণ্ঠের আওয়াজে আমরা থমকে দাঁড়ালাম।

বলি লজ্জা-ঘৃণার মাথা কি একেবারে খেয়েছ? একটি পয়সা রোজগারের মুরোদ নেই, একপাল বন্ধু-বান্ধব ডেকে আনছ চা গেলাতে!

মনে হলো শফি ভাই ফিসফিস করে কি বললেন। সব কথা শোনা গেল না কিন্তু ওদিকের গর্জন আরও তীব্র।

তোমার বন্ধুদেরও যেমন আক্কেল! বাড়িতে কিছু জোটে না, তাই তোমার বাড়িতে চড়াও হয়েছে চায়ের আসর জমাতে।

আমরা আশ্চর্য হয়ে গেলাম। সেই শফি ভাই, যিনি অব্যর্থ লক্ষ্যে বহু বাঘ-বাঘিনীকে চিরকালের জন্য খতম করে দিয়েছেন একটিমাত্র গুলিতে। তিনি আজ কত অসহায়, কত শক্তিহীন।

এ গর্জন থামানোর তার কোনো শক্তি নেই।

কি, চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ যে? এবার কণ্ঠস্বর আরও নিকটে, তোমার বলতে লজ্জা করে? তবে আমিই বলছি। হার-হাভাতেদেরও শরম নেই। নির্লজ্জ আর বেহায়া সব।

খোকন সামনে ছিল। শফি ভাইয়ের বউয়ের খিস্তিখেউর শুনে ছুটে পালাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ল। একেবারে কাঁটা ঝোপের ওপর।

আমরা সবাই মিলে তাকে টেনে তুললাম। অনেক জায়গায় ছিড়ে গেছে। রক্তও ঝরছে।

খোকনকে কিছুটা শুশ্রূষা করে আমরা ফিরব বলে যেই পা বাড়িয়েছি, দেখলাম।

একেবারে সামনে। প্রায় পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে মহিলাটি। এক হাতে কিছু আধ ময়লা কাপড়। বোধ হয় ধোয়ার জন্য নদীতেই যাচ্ছেন।

শফি ভাই কেন সুবিধা করতে পারছেন না, এবার বুঝতে পারলাম। দুই চোখের ঠিক মাঝখানে লক্ষ্য করার অসুবিধা রয়েছে। ভদ্রমহিলা রীতিমত ট্যারা।

 

 

সর্বশেষ খবর