শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ঘাড়ের কাছে

গল্প

স্বকৃত নোমান

ঘাড়ের কাছে

রবিবার রাতে চতুর্থ দফা ভূমিকম্প আঘাত হানার পর মনোয়ার হোসেন স্থির সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আর এই শহরে থাকছেন না। তার মনে প্রথম মৃত্যুভয় ঢোকে সাভারে রানা প্লাজা ধসের পর। টেলিভিশনে ইট-সুরকির নিচে শত শত মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুদৃশ্য দেখে রাতের ঘুম তার চিরদিনের জন্য উবে গেল। কেবলই মনে হতো ঘুমের মধ্যে যদি তার তিনতলা ‘নাজ ভিলাটা’ ধসে যায়! বাড়ির অবকাঠামো সব ঠিকঠাক আছে কিনা, ভূমিকম্পে বা অন্য কোনো কারণে ধসে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা, বড় বড় আর্কিটেক্ট আর ইঞ্জিনিয়ার ডেকে ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালেন। সবাই এক মত দিলেন, আগামী ১০০ বছরেও, এমনকি ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও, বাড়িটার কোনো ক্ষতি হবে না।

তবু তার ভয় কাটে না, ধীরে ধীরে মনের আরও গভীরে গাঁথতে থাকে। বাড়ির ফাউন্ডেশন, স্ট্রাকচার এবং রডের ইল্ড স্ট্রেংথও না হয় ঠিকঠাক আছে কিন্তু ভূমিকম্প তো ৮.৫ মাত্রারও হতে পারে, তখন তো বাড়িটা কারুণের বালাখানার মতো সাত হাত মাটির নিচে দেবে যাবে। খবরের কাগজে প্রকাশিত বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের এক অধ্যাপকের সাক্ষাৎকার সূত্রে জানতে পেরেছেন, ঢাকার আশপাশে ১০০ কিলোমিটারে মধ্যে ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে অন্তত তিন-চার লাখ মানুষ হতাহত হতে পারে। ৩০ শতাংশ ভবন ধসে যাবে, যার আর্থিক ক্ষতি হবে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। নাজ ভিলা না হয় ১০.৫ মাত্রার ভূমিকম্পও ঠেকানোর সক্ষমতা রাখে কিন্তু বাড়িটার সামনে-পেছনে ১৩ এবং ১৮ তলা ভবন দুটির পরিণতি তো রানা প্লাজার চেয়েও ভয়াবহ হবে। ভবন দুটি যে তার বাড়িটির ওপর ধসে পড়বে না তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে!

এসব দুশ্চিন্তা তাকে সারাক্ষণ অস্থির করে রাখত। যতক্ষণ রাস্তায় থাকতেন ভালো থাকতেন। ভোরে পার্কে জগিংয়ে বেরুলে আর ফিরতে ইচ্ছা করত না, পৃথিবীটা তার কাছে তখন স্বর্গ মনে হতো, ইচ্ছা করত পার্কের মধ্যে একটা কুঁড়েঘর বেঁধে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে। বাড়িতে ফিরলেই মৃত্যুচিন্তাটা চাগা দিয়ে উঠত। শেষরাতে ঘুমের ঘোরে প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখতেন, ভবন ধসে তার শরীরটা একটা রডে গেঁথে আছে কিংবা ধ্বংসস্ত‚প থেকে তাকে টেনেহেঁচড়ে বের করে উদ্ধারকর্মীরা স্ট্রেচারে তুলে হাসপাতালের দিকে ছুটছে। তার একটা হাত কেটে ফেলতে হবে, হয়তো পা-টাও। অথবা দেখতেন, চারদিকে ধ্বংসস্ত‚প, নড়াচড়া করা যায় না এমন একটা ছোট্ট পরিসরে তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি বসে আছেন। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তখন বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে নিচতলার চাকর-বাকরদেরও জাগিয়ে তুলতেন। হৃদকম্পনটা তখন এতই বেড়ে যেত, থামতে লাগত অন্তত আধা ঘণ্টা।

রাতের পর রাত নির্ঘুম থাকতে থাকতে প্রেসার গেল বেড়ে এবং দিনের বেলায় মাথা ব্যথার তীব্রতায় চোখে অন্ধকার দেখতেন। ল্যাব এইডে পরিচিত এক মেডিসিন বিশেষজ্ঞের কাছে গেলে তিনি পরামর্শ দিলেন, রোগটা শারীরিক নয় মানসিক, আপনি বরং ভালো কোনো মানসিক ডাক্তারের কাছে যান।

দারুণ মন খারাপ হলো তার। শেষ পর্যন্ত তাকে কিনা পাগলের ডাক্তারের কাছে যেতে হবে! মান-সম্মানের প্রশ্ন। বন্ধু-বান্ধবরা জানতে পারলে ইজ্জত নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু হয়ে যাবে।

কিন্তু অবস্থার বিপর্যয় এতটাই ঘটল, শেষ পর্যন্ত মানসিক ডাক্তারের শরণাপন্ন না হয়ে পারলেন না। ডাক্তার হাসতে হাসতে বললেন, মৃত্যু আমাদের ঘাড়ের রগের চেয়েও নিকটবর্তী। মৃত্যু নিয়ে টেনশন করে কী লাভ বলুন? মৃত্যু তার সময়মতো আসবেই। তখন শত চেষ্টা করেও কোনো লাভ হবে না।

তিনি বললেন, মৃত্যু নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র টেনশন নেই ভাই, টেনশন তো ভূমিকম্প নিয়ে। এমন ভয়াবহ অপঘাতের কথা ভাবতেই পারি না। আমি চাই স্বাভাবিক মৃত্যু।

অন্য ওষুধের সঙ্গে হাই পাওয়ারের ঘুমের ওষুধও দিলেন ডাক্তার। সপ্তাহখানেক খাওয়ার পর ইতিবাচক ফল পেতে শুরু করলেন, ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতে লাগলেন ঘুমের সমস্যাটা, একটু দেরিতে এলেও ঘুম সাত ঘণ্টাই থাকে।

কিন্তু যতই দিন যায় একটা বিষয় তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে খেয়াল করলেন, তার বিশেষ অঙ্গের শক্তি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে এমন লজ্জাজনক দুর্বলতা তাকে মানসিকভাবে আরও বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। রোজ রাতে নাজনীন তাকে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেন, বয়স হয়েছে, কমাটা তো খুবই স্বাভাবিক। এসব নিয়ে টেনশন করে শরীরটা আরও খারাপ করার তো কোনো মানে হয় না।

স্ত্রীর কথায় তিনি সান্ত্বনা খুঁজে পান না। কী করে পাবেন? তার এক বন্ধু ৫৭ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিয়ে করে দুই সন্তানের বাবা হয়েছে। অথচ চুয়ান্নতেই তার সব শেষ! হতেই পারে না। তার ধারণা, ওষুধগুলোই গোপন সমস্যাটার মূল কারণ। ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে আকারে-ইঙ্গিতে ডাক্তারও তার ধারণাকে সত্য বলে মেনে নিলেন। বললেন, এ ধরনের ওষুধে সমস্যা একটু হতেই পারে। রোগ সেরে গেলে সমস্যাও ধীরে ধীরে সেরে যাবে। টেনশনের কিছু নেই।

বললেই হলো? টেনশন তো বাসার কাজের বুয়া নয় যে, বলামাত্রই রুম থেকে বেরিয়ে চলে যাবে। টেনশনকে যতটা পারলেন তুঙ্গে চড়িয়ে ওষুধের বাক্সটাকে তিনি ময়লার ঝুড়িতে নিক্ষেপ করলেন। পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলেও এমন ওষুধ তিনি খাবেন না। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। সমস্যাটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, দুঃস্বপ্ন আর মৃত্যুভয় আবার তাকে তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল। মিথের সেই নমরুদের মতো, যার নাকের ফুটো দিয়ে একটা মশা ঢুকে মগজে বসে কুটকুট করে কামড়াত, তার মাথায়ও মৃত্যুচিন্তা মশার মতো হুল ফোটাতে লাগল।

একটা সময় দারুণ হাঁফিয়ে উঠলেন মনোয়ার হোসেন। আর কত? এভাবে চলতে থাকলে তো শেষ পর্যন্ত সত্যি তাকে পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হবে। বাধ্য হয়ে আবার ওষুধ খাওয়া শুরু করলেন। কিছু পেতে হলে কিছু তো ত্যাগ করতেই হবে। জীবনের অন্যসব প্রয়োজনের চেয়ে ঘুমের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। মানবজীবনে আহার, ঘুম ও যৌনতার চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই সত্য, তবে সবাই একসঙ্গে আবার তিনটি নাও পেতে পারে। মনকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি।

এপ্রিলের ২৫ তারিখ শনিবার দুপুরে হিমালয়কন্যা নেপালে ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানার সময় তিনি রাস্তায় চলন্ত গাড়িতে ছিলেন, টের পাননি। আধা ঘণ্টা পর দ্বিতীয় দফায় ভূমিকম্পের সময় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিলেন বলে তাও টের পেলেন না। অফিসে ঢুকে ভূমিকম্পের খবর শুনে তার মুখটা শুকিয়ে গেল, প্রেসারটাও বেড়ে গেল দ্রুত। তবে কিছুক্ষণ পর অনলাইন নিউজ পোর্টালের একটা নিউজ পড়ে প্রেসারটা কমতে শুরু করল। ৪০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে আর বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা নেই, এটাই ছিল নিউজটার মূল প্রতিপাদ্য। সংবাদটার সত্যতা যাচাই করতে ইউনিভার্সিটির ভূতত্ত¡ বিভাগের এক অধ্যাপককে ফোন দিলে অধ্যাপক তাকে অভয় দিলেন, ঘাবড়াবেন না মনোয়ার সাহেব, ফাড়া কেটে গেছে, আর ভয় নেই।

পরদিন দুপুরে ১০ সেকেন্ড স্থায়ী ভূমিকম্পের সময় তিনি অফিসের কম্পিউটারে ফেসবুকে চ্যাটিং করছিলেন তার এক আমেরিকান বন্ধুর সঙ্গে। হঠাৎ মনে হলো পেছন থেকে কেউ যেন তার চেয়ারটাতে ধাক্কা দিল। পেছনে ফিরে দেখলেন কেউ নেই। অবাক কাণ্ড! ভাবলেন প্রেসারের সমস্যা বুঝি। দুই মিনিট পর ভূমিকম্পের খবর জানিয়ে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেখতে পেয়ে তো তার মূর্ছা খাওয়ার জোগাড়! পড়িমরি করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ডান হাতে চোট পেলেন প্রচণ্ড। ভাগ্যিস হাতটা ভাঙেনি, কনুইয়ের কাছে খানিকটা চামড়া ছড়ে গেছে মাত্র।

সারা দিন আর অফিসে ফিরলেন না। বাসায়ও না। দুপুরে পল্টনের এক হোটেলে লাঞ্চ করে বিকালটা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের রবীন্দ্র সরোবরে কাটিয়ে সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরলেন। জামাকাপড় বদলে বাথরুমে যাবেন, তখনই চতুর্থ দফার ভূমিকম্প। রান্নাঘর থেকে নাজনীন চিৎকার করে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাক থেকে একটা ডেকচি পড়ে গেলে তিনি দ্বিতীয়বার চিৎকার দিলেন। বড় ছেলে মেঝেতে কনুই রেখে ভূমিকম্প উপভোগ করতে বসে গেল। ছেলেকে, নাকি ভূতত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপককে ‘হারামজাদা’ গালি দিয়ে তোয়ালে পরা অবস্থায় নিচে নামার জন্য ছুট দিলেন মনোয়ার হোসেন। ছুটতেই ছুটতেই তিনি সিদ্ধান্তটা পাকা করে ফেললেন, এই শহরে আর একমুহূর্তও নয়, সব ছেড়ে তিনি গ্রামে চলে যাবেন।

বাড়ির মালিককে তোয়ালে পরা অবস্থায় দৌড়াতে দেখে জোর চেষ্টা করেও অট্টহাসিটা চেপে রাখতে পারল না দারোয়ান। এই অপরাধে সেদিনই তার চাকরিটা চলে গেল। তার কোনো আকুতিই তিনি কানে তুললেন না।

গ্রামের বাড়ি থাকলে সেদিনই তিনি চলে যেতেন। দুই ভাইয়ের একজন ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, অন্যজন প্রাইভেট ফার্মের বড় কনসালটেন্ট, বোনটারও বিয়ে হয়েছে ঢাকাতেই। গ্রামে পৈতৃক যে ভিটাটা ছিল, মেঘনার করালগ্রাসে বহু বছর আগেই তলিয়ে গেছে।

কী করা যায় তবে? কোথায় গেলে ভূমিকম্পের হাত থেকে রেহাই মিলবে? ভেবে ক‚লকিনারা পান না তিনি। একবার ভাবলেন একটা স্টিমার কিনে বাকি জীবনটা নদীতেই কাটিয়ে দেবেন। যত বড় ভূমিকম্পই হোক, স্টিমারে থাকলে টেরই পাওয়া যাবে না। কিন্তু নাজনীনের ধমকে স্টিমার কেনার চিন্তাটা মাথা থেকে মুহূর্তে উবে গেল। নাজনীন তাকে শেষবারের মতো আল্টিমেটাম দিয়ে দিল, এসব পাগলামি চলতে থাকলে ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি বাপের বাড়ি চলে যাবেন।

যত যাই হোক, এই শহর তাকে ছাড়তেই হবে। প্রয়োজনে সব ছেড়ে পালিয়ে যাবেন। তিনি যদি না-ই বাঁচলেন স্ত্রী-সন্তান দিয়ে হবেটা কী! স্ত্রীকে তিনি অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা শহরের করুণ পরিণতি সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, কথা তুমি বোঝার চেষ্টা কর।

যে হারে মানুষ বাড়ছে আগামী ১০ বছর পর এমনিতেই শহরটা অচল হয়ে পড়বে। রাস্তায় জ্যামের কারণে গাড়ি চলবে না, ঠিকমতো গ্যাস-বিদ্যুৎ থাকবে না। বসবাসের অযোগ্য একটা শহরে পরিণত হবে। আর ভূমিকম্প হলে তো কথা নেই, দেড়-দুই কোটি মানুষ মুহূর্তেই শেষ।

না, নাজনীন তার টলার পাত্র নন। তার জম্ন এবং বেড়ে ওঠা এই শহরে, সব স্মৃতি এই শহরকে কেন্দ্র করেই। বাঁচলে এই শহরেই বাঁচবেন এবং মরলেও এই শহরেই। তাছাড়া ছেলেমেয়েরা শহরের কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ছে। তাদের এখন বড় হওয়ার সময়। এখন ঢাকার বাইরে চলে গেলে ক্যারিয়ারের মারাÍক ক্ষতি হবে তাদের।

স্ত্রীকে টলাতে না পেরে মনোয়ার হোসেন অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন, মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে মেঘনার তীরে বহু বছর আগে যে বাগানবাড়িটা কিনে রেখেছিলেন আপাতত কিছুদিন তিনি সেখানে গিয়ে থাকবেন। মানসিকভাবে কিছুটা সুস্থবোধ করলে আবার ফিরে আসবেন শহরে। অমত করলেন না নাজনীন। ঢাকা থেকে মুন্সীগঞ্জ তো বেশি দূরের পথ নয়, রাস্তা ফাঁকা থাকলে দেড় ঘণ্টায় পৌঁছানো সম্ভব। শহরের প্রতি স্বামীর যেহেতু এতই ভয়, কিছুদিন না হয় বাইরেই কাটিয়ে আসুক। খোলা পরিবেশে থাকলে ভয়টা হয়তো কেটেও যেতে পারে।

দুই মাস পর, মধ্য আষাঢ়ের এক ভোরে ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্বামীকে দেখতে এলেন নাজনীন। এই কয়দিনে চাকর-বাকররা দিনরাত খেটে বাড়িটাকে এমন সুন্দরভাবে সাজিয়েছে, শহর থেকে কেউ বেড়াতে এলে আর ফিরতেই ইচ্ছা করবে না। পেয়ারা বাগানটার মাঝখানে তোলা চৌচালা টিনের ঘরটাতে একা থাকেন মনোয়ার হোসেন, বাগানের একেবারে শেষ মাথায় অন্য একটা টিনের ঘরে চাকর-চাকরানীরা থাকে। গ্রামের তাজা শাক-সবজি, মেঘনার তাজা মাছ খেয়ে মনোয়ার হোসেনের শরীর-স্বাস্থ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। রাতে ঘুমও হয় ঠিকঠাক। ভূমিকম্পের কথা প্রায় মনেই পড়ে না।

বিকালে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও বহুদিন পর স্বামীকে পেয়ে ফিরতে মন চাইল না নাজনীনের। ছেলেমেয়েদেরও ইচ্ছা বাবার সঙ্গে রাতটা কাটানোর।

পরদিন সকালে জগিং শেষে বাড়ি ফিরছিলেন মনোয়ার হোসেন। হঠাৎ আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে এলো। হাঁটার গতি দ্বিগুণ বাড়িয়েও বাড়ি পৌঁছানোর আগেই তুমুল বৃষ্টি পেয়ে বসল তাকে। চৌচালা টিনের ঘরের ভিতর বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে ছেলেমেয়েরা এতটা আনন্দে মেতে উঠল, বাবার কথা তাদের খেয়ালেই থাকল না। হঠাৎ বজ পাতের শব্দে তাদের হট্টগোল থেমে গেল। বিজলির চমকানি দেখে মনে হলো বজ টা বাড়ির আশপাশে কোথাও পড়েছে।

বিপদের গন্ধ টের পেলেন নাজনীন। কী ভেবে দরজা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন আতাফল গাছটার তলায় আকাশের দিকে তাকিয়ে তার স্বামী দাঁড়িয়ে। অনড়। ঢাবি টিএসসি মোড়ের ভাস্কর্যগুলোর মতো। স্বামীর নাম ধরে ডাক দিলেন তিনি। সাড়া নেই। বোবা কান্না চেপে ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দৌড়ে গাছটার তলায় এসে বিস্ময়ে তিনি স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তখনো তিনি স্থির চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে।

মেঘনায় ভাটা শুরু হয়ে গেছে। আকাশ তার সঞ্চিত সব জল পৃথিবীতে ঢেলে দিচ্ছে। স্বামীকে বৃষ্টিভেজা মাটিতে শুইয়ে দিতে দিতে নাজনীন আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন এখনো অনেক মেঘ, বৃষ্টি থামতে এখনো অনেক দেরি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর