শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

আমার শিক্ষক অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

মো. ওমর কাজী

আমার শিক্ষক অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী [২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৮-১৪ নভেম্বর, ২০১৪]

শিক্ষাবিদ, কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর (২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৮) নাম আগেই শুনেছিলাম। তখন আমি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ি। স্যার তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের প্রধান এবং কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন। আমাদের গ্রামের মজনু তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র। এক বছরের সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবেশী হওয়ার কারণে আমার নানা বিষয়ে আলোচনা আমরা করতাম। তখন বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। মজনু ও গৌরাঙ্গ আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। মজনুই আমাকে প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দকীর স্যারের কথা বলেছিল। তার পাণ্ডিত্য, প্রজ্ঞা, নীতি, আদর্শ, লেখালেখি ইত্যাদি সম্পর্কে আমাকে ধারণা দেয়। তখন থেকেই মনে মনে ভাবতাম এই শিক্ষকের সান্নিধ্যে যাব। অচিরেই আমার মনোবাঞ্ছনা পূর্ণ হয়। ১৯৭২ সালে আমি উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করি। পছন্দের বিষয় ছিল ইংরেজি ও অর্থনীতি। ইংরেজি বিভাগে ভর্তি পরীক্ষার সময় একবার স্যার পরীক্ষার হলে প্রবেশ করেছিলেন। সৌম্য, সুদীপ্ত চেহারা, বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আমি স্যারকে চিনতাম না। এক পরীক্ষার্থী বলল, ইনিই ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর জিল্লুুর রহমান সিদ্দিকী। লিখিত পরীক্ষায় পাস করার পর মৌখিক পরীক্ষার ডাক পড়ল।

ভেবেছিলাম স্যারেরা মৌখিক পরীক্ষায় ইংরেজিতে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন আমি হয়তো উত্তর দিতে পারব না। আমি যথারীতি বোর্ডের সামনে হাজির হলাম। লক্ষ্য করলাম স্যার আমার একাডেমিক কাগজপত্র দেখছেন। বুঝতে পারলেন আমি মফস্বলের ছাত্র। জিজ্ঞাসা করলেন, What have you read on English literature? প্রকৃতপক্ষে আমি সিলেবাসের বাইরে ইংরেজ সাহিত্যের কিছুই পড়িনি। তাই উত্তরে আমি বললাম, ‘Nothing other than what were in our syllabus.’ তখন তিনি আমার সিলেবাস সংক্রান্ত বিষয়াদি জেনে Wordsworth, Shelley I Alexander Pope-‰i KweZv Daffodils, The cloudes Happy the Man-এর ওপর কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। আমি তার যথার্থ উত্তর দিলাম। স্যার হয়তো আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন বলেই স্যারের ছাত্র হয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। প্রথম বর্ষে স্যার আমাদের শেলি পড়াতেন। প্রথম ক্লাসেই মন জয় করেছিলেন আমাদের। তার সহজ ও শ্র“তিমধুর ইংরেজি বক্তৃতা, বাচনভঙ্গি আমাদের মন ভরিয়ে তুলেছিল। আমরা শিক্ষার্থী ছিলাম মাত্র ১৫ জন। ইচ্ছা করলে তিনি বসেই পড়াতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি। মাঝে মাঝে পায়চারী করে একেবারে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াতেন এবং নানাবিধ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেন। ক্লাসের বাইরেও স্যারের কাছে বহুবার গিয়েছি। তার কর্মব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। একবার আমি প্যারাডাইজ লস্ট কবিতার একটি প্রশ্নের উত্তর তৈরি করতে গিয়ে বেশ হিমশিম খাচ্ছিলাম। তখন ক্লাস বন্ধ ছিল। আমি সাহস করে স্যারের সঙ্গে দেখা করি। তিনি সহজে বুঝিয়ে দিলেন। স্যার উপদেশ দিলেন প্রশ্নের উত্তর খুব একটা লম্বা হওয়ার দরকার নেই; মানসম্পন্ন হলেই হবে। বড়জোর তিন-চার পৃষ্ঠা হলেই ভালো নম্বর পাওয়া যায়। তার উপদেশ আমি চিরদিন মনে রেখেছি। দ্বি^তীয় বর্ষে স্যার আমাদের বিশ্বখ্যাত কবি জন মিলটনের প্যারাডাইজ লস্ট এবং শেক্সপিয়রের ম্যাগবেথ পড়াতেন। আর তৃতীয় বর্ষে পড়াতেন জন মিলটনের অ্যারিওপ্যাজিটিকাঃ ইংরেজি সাহিত্যের অতি পরিচিত এবং কঠিনতম এক দীর্ঘ প্রবন্ধ। অ্যারিওপ্যাজিটিকা পড়তে গিয়ে আমার কঠিন সমস্যা হয়েছিল বুঝতে। লম্বা লম্বা জটিল বাক্য, কঠিন কঠিন শব্দ, পৌরাণিক, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক কিছু টার্ম বুঝতে বেশ সমস্যায় পড়লাম। পরে বাজারে পেলাম স্যারের একটি অনুবাদ গ্রন্থ। এ অনুবাদ গ্রন্থের ভ‚মিকা, টিকা-টিপ্পনি পড়ে আমরা সহজেই অ্যারিওপ্যাজিটিকার ভাববস্তু পুরাপুরি উপলব্ধি করতে পারলাম।

অ্যারিওপ্যাজিটিকা ছাড়াও স্যারের অনূদিত শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ ও সনেট পড়েও আমরা দারুণভাবে উপকৃত হয়েছি। তার অনুবাদ পড়লে বুঝা যায় তিনি যে কত সার্থক একজন অনুবাদক ছিলেন। তার শব্দ চয়ন, বাক্য গঠনশৈলী সবই পাঠকের জন্য অনুকরণীয়। অ্যারিওপ্যাজিটিকার ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক টার্মগুলো তিনি এমন অসাধারণ ব্যাখা করেছেন তাতে শিক্ষার্থীদের আর কোনো রেফারেন্স বই পড়ার দরকার পড়েনি। তৃতীয় বর্ষের মাঝামাঝি সময়ে স্যার ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। তারপরও তিনি আমাদের ক্লাস নিতেন। তার ক্লাসে মজাই ছিল আলাদা। অত্যন্ত উদার, ছাত্রদরদী, ছাত্রহিতৈষী ছিলেন প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। তার জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা সর্বজনসমাদৃত। শুধু যে শিক্ষা দানের ক্ষেত্রেই তার একনিষ্ঠ পদচারণা ও নিপুণতা তা কিন্তু নয়।

১৯৭৪-৭৫ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালে উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে তিনি যে পারদর্শিতা ও বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন তা আমার ভাবনায় অদ্বিতীয়। পর পর দুইবার উপাচার্য হওয়ার ও সফলভাবে কালোত্তীর্ণ করার গৌরব তিনিই অর্জন করেছেন। তার এ দীর্ঘ সময় প্রশাসনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনোরূপ বিশৃঙ্খলা দেখা যায়নি যেমনটি এখন অহরহই ঘটছে। স্যারের হাঁটা চলায়ই তার বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের ছাপ ফুটে উঠত। বাইরে তিনি যখন হাঁটতেন তখন তাকে খুব গম্ভীর মনে হতো। কথা বলার সাহস হতো না আমাদের। কিন্তু যদি কথা একবার সাহস করে বলা যেত তবে তিনি অতি স্বাভাবিক হাস্যোজ্জ্বলভাবে কথা বলতেন। আজীবন শিক্ষক সিদ্দিকী স্যার নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে জ্ঞানের ভাণ্ডার ও সাহিত্যের রস, রুচি বিতরণে। শিক্ষা নিয়ে তার ভাবনার কথা ব্যক্ত করেছেন নানা লেখায় ও বক্তৃতায়। ১৪ নভেম্বর, ২০১৪ তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। মহান এই শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, শিক্ষা, কর্তব্যপরায়ণতা আমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে।

সর্বশেষ খবর